অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হতে ভ্রমণ

অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হতে ভ্রমণ

Published on

আপনি কি বেড়াতে ভালবাসেন? অনেকের কাছেই কিন্তু জীবনে বেড়ানোটা এক পরিপূর্ণ অভিজ্ঞতা, যাতে শুধু মেজাজটাই ফুরফুরে হয় না, জ্ঞান ও দৃষ্টিভঙ্গিও প্রশস্ত হয়। এই প্রসঙ্গে মার্কিন লেখক মার্ক টোয়েন (স্যামুয়েল ক্লিমেন্স দেখুন) উনিশ শতকের শেষের দিকে তাঁর আত্মজীবনী 'ইনোসেন্টস অ্যাব্রড'-এ বলেছেন, “ভ্রমণ কুসংস্কার, গোঁড়ামি এবং সংকীর্ণ মনের ভাবকে ধ্বংস করে। উদার, স্বাস্থ্যকর এবং দয়ালু মানসিকতা কোনওদিন কুয়োর ব্যাঙদের মধ্যে তৈরী হয় না।” এর বহু দশক বাদে স্প্যানিশ-আমেরিকান দার্শনিক জর্জ সান্তায়ানাও ভ্রমণ সম্পর্কে ঠিক একই কথা বলে গেছেন। ঘুরে বেড়ানো নিয়ে তার মত হল, “চেনাকে অচেনায় পাল্টে দেওয়াই হল জ্ঞানের উৎস। এর ফলে মস্তিষ্ক ক্ষিপ্র হয়, গোঁড়ামি গোড়া থেকে নষ্ট হয় আর রসবোধ বাড়ে।”

একই কথা আধুনিক মনোবিজ্ঞানের জ্যোতিষ্করা যেমন আলফ্রেড এডলার, এরিক এরিকসন এবং কার্ল জংও বলেছেন। জার্মানিতে নিজের উচ্চশিক্ষা শেষ করার পর এরিক এরিকসন (ডেভলপমেন্টাল সাইকোলজি এবং প্লে থেরাপির প্রবক্তা) আর্ট স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগে, নিজেকে চেনার উদ্দেশ্যে প্রায় এক বছর গোটা ইউরোপ ভবঘুরের মতন চষে বেড়ান। পরবর্তী জীবনে এরিকসন যুক্তি দিয়েছেন যে প্রত্যেক তরুণ-তরুণীদেরই উচিৎ পড়াশুনোর শেষে, কর্মজীবনে প্রবেশের আগে নিজেকে চেনার জন্য এই রকম একটা বিরতি নেওয়া। আলফ্রেড এডলার এবং কার্ল জংও কর্মসূত্রে মহানন্দে প্রচুর ঘুরেছেন। তাঁরা শুধু দেশে-বিদেশে তাঁদের কাজের জন্য প্রশংসা পেয়েই খুশি হননি, বরং নানারকম সংস্কৃতি মানুষের ব্যক্তিত্বকে কীভাবে প্রভাবিত করে সেটা লক্ষ্য করেছিলেন। উদাহণস্বরূপ, ১৯২০র গোড়ার দিকে আলফ্রেড ভবিষ্যতবাণী করেছিলেন যে ব্যক্তিস্বাধীনতায় প্রাধান্য দেওয়ার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একদিন মনোবিজ্ঞানে সমগ্র দুনিয়াকে পথ দেখাবে। কাব্যিক ঢঙ্গে তিনি বলেছিলেন, “যুক্তরাষ্ট্র এক মহাসাগরের ন্যায়।” তাঁর বক্তব্য ছিল, এই রকম এক দেশে একজন ব্যক্তির অপরিসীম উন্নতির সুযোগ রয়েছে, কিন্তু পাশাপাশি অনেক বাধাও রয়েছে। একজন নাগরিকের সামনে তাঁর স্বপ্নপূরণের দরজা যেমন খোলা রয়েছে, তেমনই সেই দরজার সামনে বাকি প্রতিযোগীরাও রয়েছেন। এই সবের সামনে ইউরোপের অবস্থা ঠিক একটা চৌবাচ্চার সমান!”

অপরদিকে জং পছন্দ করতেন প্রাচ্য দেশগুলিকে। বিশেষত ১৯৩৭-১৯৩৮ ভারত সফর তাঁর পরবর্তী জীবনের কাজকর্মকে প্রভাবিত করেছিল। এই সফরটির আগে অবধি সুইস বংশোদ্ভূত জং মনে করতেন যে ভারতীয় সংস্কৃতির যোগাভ্যাস বা ধ্যান পশ্চিমী সমাজের উপযুক্ত নয়। কিন্তু পরবর্তী জীবনে তিনি বলেছেন যে পশ্চিমী সমাজের ভারতীয় সংস্কৃতি থেকে মনোবিজ্ঞান সম্পর্কে অনেক কিছু শেখার আছে। ১৯৩৯এ তাঁর লেখা ‘হোয়াট ইন্ডিয়া ক্যান টিচ আস’ প্রবন্ধে তিনি “মানব দেহকে আপাদমস্তক গ্রহণ করার জন্যে” হিন্দু ধর্মের ভূয়সী প্রশংসা করেন এবং বলেন যে ভারতবর্ষ সন্তর্পণে “মানুষের শরীরের ঊর্ধ্বাংশ ও নিম্নাংশকে আলাদা দেখার কুপ্রবণতাকে” এড়িয়ে গিয়েছে।

বর্তমানে ভ্রমণ সংক্রান্ত মনোবিজ্ঞানের অন্যতম একজন গবেষক হলেন নিউজিল্যান্ডের ওটাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ড: সেবাস্টিয়ান ফিলেপ। ভ্রমণ সম্পর্কে সম্পূর্ণ নতুন এক দৃষ্টিভঙ্গিকে সামনে রেখে ডা: ফিলেপ পাঁচ রকমের অভিজ্ঞতা দেখতে পেয়েছেন: ১) প্রমোদভ্রমণ: সার্বিক সুস্থতা এবং অবসর বিনোদনের জন্য; ২) মন-ভোলানো ভ্রমণ: মানসিক চাপ ভুলে মন-মেজাজ হালকা করার জন্য; ৩) অভিজ্ঞতামূলক ভ্রমণ; ৪) পরীক্ষামূলক ভ্রমণ: নিজেকে বোঝার জন্য এবং জীবনকে উপলব্ধি করার জন্য এবং ৫) অস্তিত্ববাদী ভ্রমণ: যা আমাদের চিন্তা-ভাবনা ও আচার আচরণে পরিবর্তন আনতে পারে। বলাই বাহুল্য যে এই অস্তিত্ববাদী ভ্রমণই আমাদের অভিজ্ঞতা বাড়াতে সাহায্য করে।

সম্প্রতি আমি চিনে তরুণ-তরুণীদের উপরে ভ্রমণ নিয়ে একটি সমীক্ষায় নেতৃত্বে দিয়েছিলাম। খুব স্বাভাবিক ভাবেই তাঁদের মধ্যে অধিকাংশই বলেছে যে তাঁরা নান্দনিক সৌন্দর্য্য (স্থাপত্য শৈলীর দর্শন), প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য, পারিবারিক সংসর্গ, গভীর বন্ধুত্ব এবং নিজের স্বাধীনতার মতন টুকরো টুকরো নানারকম খুশির মুহুর্ত উপভোগ করেছে। উদাহরণস্বরূপ, এক ছাত্র জানিয়েছে, “আপনার মন ও শরীর যখন ফুরফুরে হয়ে যায়, তখন জীবন সম্পর্কে আপনার দৃষ্টিভঙ্গিও পালটে যায়। আপনি অনেক কিছু শেখেন এবং আপনার অভিজ্ঞতার ঝুলি আরও সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে।” এক ছাত্রীর বক্তব্য হল, “আমি উপলব্ধি করেছি যে আমি চেষ্টা করলেই আমার স্বপ্নগুলোকে সত্যি করতে পারব কারণ আমার জীবনের লাগাম আমারই হাতে।”

ইচ্ছা হলেই কোথাও বেড়িয়ে আসাটা সবসময় আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়, কিন্তু আপনার আগের অভিজ্ঞতাগুলো থেকেও আপনার অনেক কিছু শেখার রয়েছে। কয়েক মিনিট সময় বের করে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দিন: ভ্রমণ অভিজ্ঞতা আপনার মানসিকতাকে কতটা উদার করেছে? আপনার সৌন্দর্য্যবোধ কি আগের চেয়ে বেড়েছে? আপনার মধ্যে কি কৃতজ্ঞতাবোধ জন্ম নিয়েছে? ভ্রমণ অভিজ্ঞতা আপনার মধ্যে সৃজনশীলতা এবং সমস্যা সমাধানের শক্তি কীভাবে বাড়ায়? সব শেষে, আপনি পরের বার কোথায় ঘুরতে যেতে চান, এবং কেন?

ডা: এডওয়ার্ড হফ‌ম্যান, নিউ ইয়র্ক শহরে ইয়েশিভা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক। উনি একজন অনুমোদিত মনোবিদ যিনি সাইকোলজি নিয়ে ২৫ টিরও বেশি বই লিখেছেন। সম্প্রতি উনি ডা: উইলিয়াম কম্পটনের সাথে ‘পজিটিভ সাইকোলজি: দ্যা সায়েন্স অফ হ্যাপিনেস অ্যান্ড ফ্লারিশিং’ রচনা করেছেন। এছাড়াও তিনি ‘ইন্ডিয়ান জার্নাল অফ পজিটিভ সাইকোলজি’ এবং ‘জার্নাল অফ হিউম্যানিস্ট সাইকোলজি’র সম্পাদক মন্ডলীর সঙ্গে যুক্ত। আপনি তাঁর সাথে columns@whiteswanfoundation.org -তে যোগাযোগ করতে পারেন।

logo
হোয়াইট সোয়ান ফাউন্ডেশন
bengali.whiteswanfoundation.org