স্বেচ্ছায় করা সেবার আপনার মানসিক স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব

স্বেচ্ছায় করা সেবার আপনার মানসিক স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব

আপনি কি স্বেচ্ছায় কোনও সেবার কাজের সঙ্গে যুক্ত আছেন? যদি না থাকেন তাহলে দেরী না করে এখনই এমন কোনও কাজের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার কথা ভেবে দেখতে পারেন।

ইদানীং নানা গবেষণায় ব্যক্তিগত ভালথাকার ক্ষেত্রে এর গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করা হচ্ছে। মোটেই কাকতালীয় ঘটনা নয় যে বিজ্ঞান বিষয়ক সাংবাদিকরা তাঁদের প্রবন্ধে ''ভালো থাকার জন্য ভালো কাজ করুন'' গোছের শিরোনাম ব্যবহার করছেন। সুস্থতা এবং স্বেচ্ছা কর্মের মধ্যে একটা শক্তিশালী ও বাস্তব যোগাযোগ রয়েছে। এই যোগাযোগ শুরু হয় মানুষের বয়ঃসন্ধিকালে এবং বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত এই যোগসূত্র বজায় থাকে। মানুষের যৌবনের ইতিবাচক মানসিকতার বিকাশজনিত গবেষণায় দেখা গিয়েছে, কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে স্বেচ্ছাসেবকের কাজের প্রভাব অত্যন্ত ইতিবাচক হয়। এর প্রভাবে অনিচ্ছাকৃত গর্ভাবস্থা, মাদক দ্রব্যের ব্যবহারের সম্ভাবনা অপেক্ষাকৃত কম হয়। এবং অ-স্বেচ্ছাসেবকদের তুলনায় এই কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে ইতিবাচক শিক্ষা, ইতিবাচক মানসিকতা ও তার বৃত্তিমূলক প্রকাশের সম্ভাবনা বেশি।   

উইসকনসিন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ডঃ জেন পিলাভিন একটা গবেষণায় দেখিয়েছিলেন যে বয়ঃসন্ধিকালের নানারকম ঝুঁকি রয়েছে এমন ছেলে- মেয়েরাও স্বেচ্ছাকর্মের উপকারিতা পায় আত্ম-নির্ভরতা, সামাজিক যোগাযোগ এবং একাত্মতার মধ্য দিয়ে। এই অভিজ্ঞতা তাদের বুলিং-এর ক্ষতিকারক পরিণামের থেকে দূরে রাখতে সাহায্য করে। স্বেচ্ছাসেবকের কাজের মধ্য দিয়ে কিশোর-কিশোরীদের স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটতেও দেখা গিয়েছে। নিউ ইয়র্কের মাউন্ট সিনাই স্কুল অফ মেডিসিনের ডাক্তার ডঃ হান্না শরিয়ার-এর রিপোর্টে দেখা গিয়েছে, হাই-স্কুলের যেসব ছাত্ররা মেন্টোরিং বা পরামর্শদানের কাজে যোগদান করেছিল তাদের কোলেস্টেরলের মাত্রা ও বডি মাস, যারা এই অনুষ্ঠানে অংশ নেয়নি তাদের তুলনায় অনেক কম ছিল।

মানুষের মাঝবয়সে এবং তার পরবর্তী সময়ে কী হয়? ভ্যান্ডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই গবেষক ডঃ পেগি থয়েটস্‌ এবং ডঃ লিন্ডি হিউইট তাঁদের এক গবেষণায় দেখিয়েছেন যে মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে সুস্থ বা ভালো থাকার বিষয়গুলো যেমন- খুশি বা আনন্দ, মনের সন্তুষ্টি, আত্ম-নির্ভরতা এবং দৈহিক স্বাস্থ্যের সবলতা একজন পূর্ণবয়স্ক স্বেচ্ছাসেবী মানুষের মধ্যে অ-স্বেচ্ছাসেবী মানুষের চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণে থাকে। গবেষকরা মানুষের ব্যক্তিত্ব এবং স্বেচ্ছা সেবার মধ্যে যে একটি বৃত্তাকার সম্পর্ক রয়েছে তার প্রমাণও দিয়েছেন। এক্ষেত্রে যেসব মানুষ খুব হাসিখুশি এবং অতিরিক্ত আত্মনির্ভর হয় তাদের মধ্যে স্বেচ্ছাসেবার ভাব বেশি হয়। এবং এটাই তাদের আরও সুস্থ ও ভালো থাকতে সাহায্য করে। সম্প্রতি, ডঃ মার্টিন বিন্ডার এবং ডঃ অ্যান্ড্রিয়াস ফ্রেটাগ একটা বড় মাপের গবেষণা চালিয়েছেন, যেখানে ব্রিটিশ পরিবারের মানুষজনরা যুক্ত ছিল। এই গবেষণা থেকে জানা গিয়েছে যে স্বেচ্ছায় করা কোনও সেবামূলক কাজ অনেকক্ষণ ধরে করলে মানুষের মধ্যে একটানা আনন্দের বোধ হয় এবং সহসা তার মেজাজ-মর্জিও খারাপ হয় না। বরং সে বেশ চনমনে থাকে। এই প্রসঙ্গে গবেষকরা তর্ক দিয়েছেন যে জনসাধারণের জন্য যাঁরা নীতি নির্ধারণ করে তাদের উচিত পূর্ণবয়স্ক মানুষকে স্বেচ্ছাসেবার কাজে বেশি করে যোগদান করার জন্য উৎসাহ জোগানো - এমন কাজের ব্যক্তিগত আনন্দের উপর প্রভাবের কথা প্রচার করে।   

কর্মজীবন থেকে অবসর গ্রহণ করার পর স্বেচ্ছা কর্ম বিজ্ঞানসম্মতভাবে অত্যন্ত উপকারি। এরকমই একটি প্রতিনিধিত্বমূলক গবেষণা চালিয়েছেন ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ডঃ ন্যান্সি মোরো-হওয়েল এবং তাঁর সহকর্মীরা। এই গবেষণার মতে যেসব বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেন এবং যারা অনেক সময় ধরে স্বেচ্ছা কর্মে নিযুক্ত থাকেন তাদের সুস্থতা তাদেরই মতো একইরকম মানসিক ও দৈহিক স্বাস্থ্যের অধিকারী অ-স্বেচ্ছাসেবী মানুষের তুলনায় অনেক বেশি মাত্রায় বজায় থাকে। এই প্রসঙ্গে তাঁরা কয়েকটি অকাট্য ও সুনিশ্চিত বিষয় তুলে ধরেছিলেন। যেমন- যদি আপনি চান যে আপনার খুশি বা আনন্দ আরও জোরদার এবং সামাজিক সম্পর্কগুলো আরও শক্তিশালী হোক তাহলে আপনি আপনার সময় ও দক্ষতাগুলো অন্যের সাহায্যের জন্য আরও বেশি করে ব্যয় করুন।

ভারতে এইধরনের বিজ্ঞানসম্মত পর্যবেক্ষণের প্রভাব পড়তে দেখা যাচ্ছে। নাগরিক কাজকর্ম এবং স্বেচ্ছাসেবকের ভূমিকায় ভারতের যুবসমাজের বিপুল পরিমাণে অংশগ্রহণের প্রসঙ্গে বরোদার মহারাজা সয়াজিরাও বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ডঃ রচনা ভানগাওকার এবং ডঃ দুলারি মেহতা একটি যুবকের সম্পূর্ণ কেস স্টাডি তুলে ধরেছেন, যে তার জীবনের মূল মন্ত্র পশুদের সেবার কাজের সাথে যুক্ত হয়ে খুঁজে পেয়েছে। এক্ষেত্রে গবেষকদের মূল বক্তব্য হল উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে ভারতের অবশ্যই উচিত একটা উদ্দেশ্যের ঢেউ-এর দিকে যুবসমাজকে ভাসিয়ে দিয়ে তাদের মধ্যে জাতি-গঠন ও সামাজিক উন্নতির ভাবধারা জাগিয়ে তোলা।

২০১৭ সালের ১১-ই অগস্ট দিল্লিতে যুবকল্যাণ ও ক্রীড়া মন্ত্রকের উদ্যোগে  আন্তর্জাতিক যুব দিবস পালন করা হয়। ওই দিনে শান্তি গড়ার বিষয়ে যুবসমাজের ভূমিকার উপর একটি জাতীয় আলোচনাসভার আয়োজন করা হয়েছিল। যুবকল্যাণ ও ক্রীড়া মন্ত্রকের মূল উদ্দেশ্য হল শান্তি স্থাপনের কাজে যুবসমাজের নেতৃত্বে গড়ে উঠা সংস্থাগুলির প্রচার করা। ওই অনুষ্ঠানে মন্ত্রকের পক্ষ থেকে স্বেচ্ছাসেবক যুবকদের প্রসঙ্গে একটি অভূতপূর্ব প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। সেই সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতের একটি অনলাইন স্বেচ্ছাসেবক মঞ্চের উদ্বোধনও করা হয়। এই অনলাইন মঞ্চের মাধ্যমে বিভিন্ন যুব নেটওয়ার্ক, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, নাগরিক সমাজ-সংক্রান্ত সংস্থা, গণ প্রতিষ্ঠান এবং রাজ্য সরকারগুলো বিনামূল্যে অনলাইন স্বেচ্ছাসেবকদের নানারকম সহায়তা যাতে পায় তার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

উদ্যোগমূলক কাজকর্ম

স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করার জন্য অসংখ্য সুযোগ রয়েছে। এগুলোর মধ্যে থেকে আপনার জন্য কোনটি যথাযথ? তা জানতে গেলে আপনাকে পড়তে হবে নীচের ছ'টি সুপারিশ-

১) আপনার আগ্রহের কারণ বা ক্ষেত্রটি সম্পর্কে জানুন- যেমন আপনি কি পার্কের উন্নতি করবেন, নাকি শিল্পকলা বিভাগে যোগদান করবেন অথবা স্কুলের বাচ্চাদের পড়াবেন- তা আগে আপনাকে ভালোভাবে জানতে হবে। এক্ষেত্রে যদি আপনি আপনার কাজের বিষয়ে উৎসাহী হন তাহলে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে আপনার ভূমিকা অনেক বেশি কার্যকরী হবে। কিন্তু 'ভালো কাজ' যদি আপনি কারোর চাপে পড়ে জোর করে করেন তাহলে আপনার স্বেচ্ছা কর্মের উদ্দেশ্য সফল হবে না।

২) নিজের দক্ষতার ক্ষেত্রটিকে বিশেষভাবে চিহ্নিত করতে হবে। যেমন- আপনি কমপিউটারের বিশেষজ্ঞ হবেন না গানবাজনার চর্চা করবেন তা আপনাকে আগে স্থির করতে হবে।

৩) যদি আপনি নতুন কিছু শিখবেন বলে সিদ্ধান্ত নেন তাহলে এমন অনেক সংস্থা রয়েছে যারা স্বেচ্ছাসেবকের প্রশিক্ষণ দেন, তাদের সহায়তা নিতে হবে।

৪) স্বেচ্ছাসেবকের কাজে নিজেকে অতিরিক্ত পরিমাণে যুক্ত করবেন না। এক্ষেত্রে সময়ের ভারসাম্যের ব্যাপারে আপনাকে সতর্ক থাকতে হবে। যাতে না আপনার উপর অতিরিক্ত চাপ জন্মায় এবং তা আপনার ক্ষতি ডেকে আনছে কিনা সে বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে।

৫) যদি আপনার হাতে সময় কম থাকে, যানবাহনের অসুবিধা থাকে বা শারীরিক অক্ষমতা থাকে তাহলে আপনি অনলাইনের সাহায্যে স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করতে পারেন। এক্ষেত্রে ইন্টারনেট বা ফোনের মাধ্যমে অন্যকে সাহায্য করা যায়।

৬) পরিবারের সদস্য ও বন্ধুদের সাথে একজোট হয়ে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করুন। গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে একসাথে সেবার কাজ করলে সম্পর্ক সুমধুর হয়।  

ডা: এডওয়ার্ড হফ‌ম্যান, নিউ ইয়র্ক শহরে ইয়েশিভা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক। উনি একজন অনুমতিপ্রাপ্ত মনোবিদ যিনি সাইকোলজি নিয়ে ২৫ টিরও বেশি বই লিখেছেন। সম্প্রতি উনি ডা: উইলিয়াম কম্পটনের সাথে ‘পজিটিভ সাইকোলজি: দ্যা সায়েন্স অফ হ্যাপিনেস অ্যান্ড ফ্লারিশিং’ রচনা করেছেন। এছাড়াও তিনি ‘ইন্ডিয়ান জার্নাল অফ পজিটিভ সাইকোলজি’ এবং ‘জার্নাল অফ হিউম্যানিস্ট সাইকোলজি’র সম্পাদক মন্ডলীর সঙ্গে যুক্ত। আপনি তাঁর সাথে columns@whiteswanfoundation.org -এ যোগাযোগ করতে পারেন।

Related Stories

No stories found.
logo
হোয়াইট সোয়ান ফাউন্ডেশন
bengali.whiteswanfoundation.org