সাহায্য চাওয়া দুর্বলতার লক্ষণ নয়

সাহায্য চাওয়া দুর্বলতার লক্ষণ নয়

যুবশক্তি তাদের জ্ঞান এবং দক্ষতা দ্বারা মানসিক স্বাস্থ্যের বাধাগুলিকে কাটিয়ে উঠতে পারে

'আনন্দে থাকুন', 'চাপমুক্ত থাকুন', 'ভাবাবেগ নিয়ন্ত্রণ করুন' এবং 'জীবনের চ্যালেঞ্জগুলিকে জয় করতে শিখুন'-- এরকমই কয়েকটি বিষয়ের প্রতিক্রিয়া জানার জন্য একটি বড় অংশের কলেজ পড়ুয়াদের উপর সমীক্ষা চালানো হয়েছিল। এর মধ্য দিয়ে আমরা কলেজ ছাত্রদের কাছ থেকে মানসিক সুস্থতা সম্পর্কে তাদের ধারণা ঠিক কী রকম, তা বোঝার চেষ্টা করেছি। ছাত্রদের সাক্ষাৎকার গ্রহণের মাধ্যমে মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি স্পষ্ট করার এই পদ্ধতি অত্যন্ত বিজ্ঞানসম্মত।

দেশের জনসংখ্যার একটি বড় অংশ জুড়ে রয়েছে যুবশক্তি। যুবশক্তির মানসিক স্বাস্থ্যের দিকটি বিশেষভাবে জোর দেওয়ার পিছনে রয়েছে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ কারণ। যৌবন জীবনের এমন একটি পর্যায়, যা শুধু সম্ভাবনাময়ই নয়, একইসঙ্গে অমূল্যও বটে। দেখা গেছে যে, ২৪ বছরের কাছাকাছি বয়সের যুবক-যুবতীরা মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সমস্যায় আক্রান্ত হয় বেশি। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, এদের মধ্যে খুব কম সংখ্যকই সমস্যার সমাধানের জন্য বিশেষজ্ঞের সহায়তা বা সান্নিধ্য অর্জন করার সুযোগ পায়। সাহায্য না পাওয়ার পিছনে অনেক কারণ রয়েছে। যেমন সচেতনতার অভাব, মানসিক দোদুল্যমানতা, ভয়ে একপ্রকার শুকিয়ে যাওয়া এবং বিশেষজ্ঞের কাছে পৌঁছনোর ক্ষেত্রে নানা প্রতিবন্ধকতা।

যুবক-যুবতীদের এহেন মানসিক সমস্যাগুলি বোঝার জন্য আমরা বেশ কয়েকটি গ্রুপ ডিসকাশনেরও ব্যবস্থা করেছিলাম। এই ধরনের আলোচনাগুলিতে মানসিক উদ্বিগ্নতা বা অবসাদের কারণগুলি উঠে এসেছে। এগুলির মধ্যে রয়েছে পড়াশোনা বা কেরিয়ার গঠনের জন্য তীব্র প্রতিযোগিতা, যা পড়ুয়াদের মনে সর্বক্ষণ এক ধরনের অনিশ্চয়তা বা চিন্তার জন্ম দেয়। এ ছাড়াও আছে প্রতিকূল সামাজিক পরিস্থিতি।

একটা কথা প্রায়ই শোনা যায় যে, 'সবসময় চাপমুক্ত থাকুন'। কথাটা বলা যত সহজ, কাজে কিন্তু ততটা সহজ নয়। কারণ, চাপমুক্ত থাকার আশা করাটাই প্রতিদিনের জীবনে হতাশাকে জন্ম দেয়। এমন অনেক তরুণ-তরুণী আছেন, যাঁদের সঙ্গে তাঁদের বাবা-মা বা শিক্ষকদের মানসিক বন্ধন ততটা শক্তিশালী নয়। যুবক-যুবতীদের আবেগের সঙ্গে, তাঁদের নিজস্ব জগতের সঙ্গে বহু সময়েই অভিভাবকদের যোগাযোগ ঠিকমতো গড়ে ওঠে না। এহেন 'না বোঝা' হতাশাগুলির বার বার প্রতিফলনের দরুন তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি আলোচনার স্তরে চলে আসে। অন্যদিকে রয়েছে সেইশ্রেণির পড়ুয়া যারা মূলত ছোট শহর, গ্রাম বা মফস্সল থেকে শহরে ভাল কলেজে পড়তে আসে। এদের ক্ষেত্রে মুশকিল হয় যে শহরের রীতি-নীতি, আদব-কায়দার সঙ্গে তারা প্রথম-প্রথম মানিয়ে নিতে পারে না। এর ফলে তাদের মধ্যে মানসিক অবসাদ, চিন্তা, উদ্বেগ, হতাশার মতো কতগুলি নেতিবাচক মনোভাবের জন্ম হয়। এতদসত্ত্বেও, যুবশক্তি তাদের অন্তরের ইচ্ছাশক্তি, উদ্দীপনা আর ইতিবাচক মনোভাবের সাহায্যে যৌথভাবে মানসিক বাধাগুলিকে অতিক্রম করে পরিস্থিতির বদল ঘটাতে পারে।

যুবকদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আলোচনা করা মানেই এই সিদ্ধান্তে পৌঁছানো নয় যে তাঁদের মানসিক স্বাস্থ্য খুবই দুর্বল বা তাঁরা মানসিক ভাবে সুস্থ নয়। বরং আমাদের অভিজ্ঞতা একটু অন্যরকম। এমন অনেক শহুরে যুবক-যুবতী রয়েছেন যারা তাঁদের জীবনের হতাশা, ব্যক্তিগত সম্পর্কগুলির ক্রমাগত অবনতি, নিজেদের কেরিয়ার গঠন নিয়ে মনের মধ্যে ঘোরাফেরা করা নানা প্রশ্ন বা সামাজিক পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্নতা - এই সব সমস্যার হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য বিশেষজ্ঞের পরামর্শ বা সাহায্য গ্রহণে ইচ্ছুক।

একজন যুবক বা যুবতী তাঁর মানসিক সমস্যাগুলির হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য যখন কারও সমর্থন বা বন্ধুর সাহচর্য লাভ করে, তখন তার অনেকগুলি সুফল লক্ষ করা যায়। প্রথমত, সেই যুবক বা যুবতী আরও বহু মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত তরুণ-তরুণীর পাশে সহমর্মিতা নিয়ে দাঁড়াতে পারে এবং সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে পারে। দ্বিতীয়ত, কোনও বন্ধু বা বিশেষজ্ঞের কাছ থেকে পাওয়া সমর্থন তাঁরা একইরকম ভাবে অন্যদের মধ্যেও ছড়িয়ে দিতে পারেন। একে অপরের পরিপূরক হিসেবে তাঁরা নিজেদের মতো অন্য একদল যুবক-যুবতীদের মানসিক বাধা কাটিয়ে তুলতে সক্ষম হতেই পারেন। সর্বোপরি, যুবশক্তিই পারে সমাজে মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত ভয়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে। যতক্ষণ না আমরা আমাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করে যুবক‑যুবতীদের মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যার সমাধানের জন্য সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করার জন্য উৎসাহিত করছি, ততক্ষণ সমাজে মানসিক স্বাস্থ্যের প্রশ্নে কোনও ইতিবাচক মনোভাব গড়ে ওঠা সম্ভব হবে না।

মানসিক স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত সমস্যার একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে যদি তা নির্মূল করার চেষ্টা করা হয়, তাহলে যুবশক্তি তাদের অন্তরের সম্ভাবনা, জ্ঞান এবং দক্ষতা দিয়ে সুস্থ, স্বাভাবিক জীবনে সহজেই ফিরে আসতে পারবে। এই ক্ষেত্রে ব্যাঙ্গালোরের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ মেন্টাল হেলথ অ্যান্ড নিউরো সায়েন্সেস (নিমহানস)-এর ক্লিনিকাল সাইকোলজি বিভাগ যে উদ্যোগ নিয়েছে তার ফলে উপকার পাবেন মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিকারে আক্রান্ত বহু যুবক-যুবতী।

লেখক পরিচিতি: ডা. সীমা মেহেরোত্রা বর্তমানে নিমহ্যান্সের ক্লিনিকাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপিকা। তিনি তাঁর বিভাগের পজিটিভ সাইকোলজি ইউনিটে মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত গবেষণা, প্রশিক্ষণ, পরিষেবা এবং বিশেষ করে মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত যুবশক্তির বিষয়টি নিয়ে নিরলস কাজ করে চলেছেন।

Related Stories

No stories found.
logo
হোয়াইট সোয়ান ফাউন্ডেশন
bengali.whiteswanfoundation.org