আনন্দে থাকুন, নিজের জীবনের লক্ষ্য স্থির করুন

আনন্দে থাকুন, নিজের জীবনের লক্ষ্য স্থির করুন

ব্যবসা-বাণিজ্যের জগতে নির্দিষ্ট লক্ষ্য স্থির করা অত্যন্ত জনপ্রিয় একটা ধারণা। ব্যবসায় আর্থিক সাফল্যের ক্ষেত্রেও এটি খুবই জরুরি বিষয়। এই ধারণাটি ব্যবসার ক্ষেত্রে খুবই ভালো ফল দেয়। কিন্তু ইতিবাচক মনস্তত্ত্বে দেখা গিয়েছে যে এই লক্ষ্যে পৌঁছতে গিয়ে আমাদের দৈনন্দিন ভালো থাকা, খুশি বা আনন্দগুলো একেবারে নষ্ট হয়ে যায়। এবং এটি আমাদের জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় হয়ে ওঠে। কিন্তু আপনি বা আপনারা যদি লক্ষ্য এবং আনন্দের মধ্যেকার যোগসূত্রটা বুঝতে পারেন তাহলে আপনাদের ভালো থাকা কখনোই কোনওভাবে নষ্ট হয়ে যেতে পারবে না। যখন আমরা আমাদের ভবিষ্যতের আশা বা স্বপ্নগুলো নিয়ে কথাবার্তা বলি তখন আসলে আমরা আমাদের জীবনের লক্ষ্য স্থির ও তা পূরণ করার কথাই চিন্তাভাবনা করি। এটা আমাদের জীবনের কোন ক্ষেত্রে আমরা সর্ব শক্তি ব্যয় করব তা স্থির করতে এবং জীবনের প্রতিশ্রুতিগুলো রক্ষা করতে সাহায্য করে। জীবনের সর্বোচ্চ অভিজ্ঞতার উপর করা আমার গবেষণায় দেখা গিয়েছে মানুষ তার ব্যক্তিগত জীবনের লক্ষ্যগুলো পূরণ করে তৃপ্তি বা আনন্দ পায়। এই ব্যক্তিগত ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে শিক্ষা, কাজকর্ম বা সামাজিক সম্পর্ক। যদি আপনি এমন একজন মানুষ হন যিনি নিজের লক্ষ্য পূরণের কথা চিন্তা করেন না বা লক্ষ্যগুলো সম্পর্কে আপনার কোনও স্পষ্ট ধারণা নেই তাহলে আপনি আপনার জীবনের একটা অপরিসীম আনন্দের ক্ষেত্র থেকে অবশ্যই বঞ্চিত হবেন।

মনস্তত্ত্ববিদরা এমন কয়েকটি লক্ষ্যের কথা বিশেষভাবে বলেছেন যেগুলো মানুষকে আনন্দ দেওয়ার ক্ষেত্রে অন্যান্য লক্ষ্যগুলোর থেকে অনেক বেশি কার্যকরী হয়। বিশেষ করে মানুষের কাছে এই লক্ষ্যগুলোর একটা বাস্তবসম্মত মূল্য রয়েছে এবং মানুষ স্বাধীনভাবে সেগুলোকে গ্রহণও করতে পারে। এর থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার যে অন্যদের দ্বারা চাপানো লক্ষ্য পূরণের থেকে মানুষের জীবনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে স্থির করা লক্ষ্যগুলো অনেক বেশি অর্থবহ হয় এবং চাপানো লক্ষ্যগুলোর প্রকৃত মূল্য মানুষের জীবনে থাকে না।

সিনসিন্নাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ডঃ রায়ান নিমিএক তাঁর একটি গবেষণায় দেখিয়েছিলেন যে ব্যক্তিগতভাবে মানুষের সহজাত লক্ষ্যগুলো অনেক অর্থবহ এবং মানুষের সুস্থতার ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা নেয়। কিন্তু বাহ্যিক বা বাইরে থেকে চাপিয়ে দেওয়া লক্ষ্যগুলো মানুষের জীবনে এর বিপরীত ফল দেয়। অন্য আরেকটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, যখন মানুষের মূল্যবোধ এবং লক্ষ্যের মধ্যে সুন্দর  ভারসাম্য বজায় থাকে, তখন মানুষের মধ্যে আরও বেশি করে লক্ষ্য পূরণের তাগিদ দেখা যায়, প্রতিশ্রুতিগুলো রক্ষার ক্ষেত্রেও তীব্র সদিচ্ছা থাকে এবং সর্বাঙ্গীণভাবে মানুষের সুস্থতা বজায় থাকে।

দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল লক্ষ্য পূরণ বনাম লক্ষ্য পরিহার বা এড়ানো। লক্ষ্য পূরণ করার জন্য আমরা কোনও না কোনও বিষয়ের দিকে একাগ্রভাবে এগিয়ে যাই (যেমন- ''কাউন্সেলিং-এ আমি একটা ডিগ্রি পেতে চাই'')। অন্যদিকে, লক্ষ্য এড়ানোর মানসিকতার জন্য আমাদের মধ্যে সমস্যা, বিপদ বা ভয়জনিত পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়ার ইচ্ছে চলে যায় (যেমন- ''আমি চেষ্টা করি জনগণের সামনে যেন আমায় কোনও বক্তব্য রাখতে না হয় কারণ এর ফলে আমি খুব নার্ভাস হয়ে পড়ি'')। এসব বিষয় নিয়ে নানারকম গবেষণায় দেখা গিয়েছে লক্ষ্য এড়িয়ে যাওয়ার থেকে লক্ষ্য পূরণের মাধ্যমেই মানুষ অনেক বেশি আনন্দ লাভ করে। আসলে মানুষ যখন তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যের দিকে সফলভাবে এগিয়ে যায় তখন সে মনে মনে খুবই তৃপ্তি পায়। কিন্তু লক্ষ্য এড়ানোর চেষ্টা মানুষকে কষ্ট বা যন্ত্রণা দেয়। এছাড়া মানুষ তার জীবনযাপনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন বিষয়ের দিকে ঝোঁকে এবং আমাদের জীবনে লক্ষ্য পূরণ বা তা এড়িয়ে যাওয়া- দুটোই পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে।

তৃতীয়ত, মূল্যবান বা অমূল্য লক্ষ্যগুলো পূরণ করা মানুষের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। সেগুলো প্রত্যাশার চেয়েও মানুষ বেশি করে গুরুত্ব দিয়ে বিচার করে  এবং তা পূরণ করার দিকে এগিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে মানুষ সীমাহীন আনন্দ অনুভব করে। লক্ষ্য পূরণে সাফল্য আসবে কিনা তার চেয়েও মানুষের কাছে এসব মূল্যবান লক্ষ্যগুলোর দিকে এগিয়ে যাওয়া বেশি গুরুত্ব পায় এবং এই অগ্রগতির হার মানুষ নিজে স্থির করে বা গড়ে তোলার আশা করে। এইধরনের স্ব-গ্রহণযোগ্য অগ্রগতির হার মানুষের মধ্যে অনেক বেশি করে ইতিবাচক অনুভূতির জন্ম দেয়।

চতুর্থত, লক্ষ্য পূরণের প্রভাবে আমাদের মধ্যে যে আনন্দ বা খুশির বোধ জেগে ওঠে তা নির্ভর করে লক্ষ্যগুলির নির্দিষ্টতার উপর। যেসব লক্ষ্যগুলো অতিমাত্রায় বিমূর্ত বা অকার্যকর বলে মনে হয় সেগুলো আমাদের আনন্দের পথে বাধা হয়ে উঠে। কারণ আমরা জানি না যে সেই লক্ষ্যগুলো আমরা কখন, কীভাবে পূরণ করে উঠতে পারব। যেমন- যদি আপনার লক্ষ্য হয় ''দয়ালু, যত্নবান মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলা'', তাহলে আপনার পক্ষে এটা জানা খুব কঠিন যে কখন আপনি কোন মানুষের সঙ্গে কতটা সমানুভূতিসম্পন্ন হতে পেরেছেন, এবং আপনার দয়ালু বা যত্নবান হওয়ার লক্ষ্য পূরণ করতে পেরেছেন কি না। কিন্তু যে লক্ষ্যগুলো অপেক্ষাকৃত বাস্তব বা মূর্ত সেগুলো সফলভাবে পূরণ করার ক্ষেত্রে আমরা অনেক বেশি নিশ্চিত থাকি। যেমন- ''প্রতিদিন আমি অন্তত একজন মানুষের সঙ্গে এমন আচরণ বা ব্যবহার করব যার মধ্য দিয়ে আমার দয়ালু বা সমানুভূতিসম্পন্ন হওয়ার যে উদ্দেশ্য রয়েছে তা বাস্তব হতে পারে।'' এই ধরণের লক্ষ্য স্থির করলে দিনের শেষে আমরা তা পূরণ করতে সক্ষম হই।

সবশেষে, আমাদের জীবনে বিভিন্ন লক্ষ্যগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে তাদের মধ্যে 'মানানসই' বনাম দ্বন্দ্ব- এই বিষয়টা প্রায়শই মুখ্য হয়ে ওঠে। বিভিন্ন লক্ষ্যগুলোর মধ্যে কতটা সঙ্গতি রয়েছে এবং লক্ষ্যগুলো একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে কতখানি সংঘর্ষের মুখোমুখি হচ্ছে তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে আমাদের মানসিক তৃপ্তি বা আনন্দের বোধ। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, মানুষের জীবনে যে আট বা দশটা বড় লক্ষ্যকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয় সেগুলোর মধ্যে অনেকসময়ে দ্বন্দ্ব দেখা দিতে পারে। এর কারণ হল মানুষ খুব অল্প সময়ের মধ্যেই এই লক্ষ্যগুলো পূরণ করার জন্য উদ্যোগী হয়ে ওঠে। আরও স্পষ্টভাবে বলতে গেলে বলা যায় মানুষের জীবনে যে বিষয়গুলো প্রাধান্য পায় যেমন- তার সফল কেরিয়ারের স্বপ্ন, অর্থ, পারিবারিক ক্ষেত্র, সমাজের সঙ্গে তার সম্পর্ক এবং অবসরযাপন প্রভৃতি মানুষের বিভিন্ন লক্ষ্যের মধ্যে অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্বের জন্ম দেয়। এর ফলে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের আনন্দ বা সুখ-শান্তিও কমে যেতে থাকে।

এসব বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণের উপর নির্ভর করে আপনি নিজেকে কয়েকটি প্রশ্ন করতে পারেন, যেমন- পরবর্তী ছ'মাসে আমার জীবনে কী কী লক্ষ্য মুখ্য হয়ে উঠতে পারে? এগুলো কি একবছর বা পরবর্তী তিন বছরেও সমান গুরুত্বপূর্ণ থাকবে? এক্ষেত্রে লক্ষ্যগুলোর একটা তালিকা লিখে রাখলে তা আপনাদের সাহায্য করতে পারে। এমন লক্ষ্য স্থির করতে হবে যেগুলোকে বাস্তবসম্মত, নিজের আয়ত্তাধীন এবং ধরা-ছোঁওয়া মধ্যে। এবং এখনই সেই চেষ্টা শুরু হোক!

ডা: এডওয়ার্ড হফম্যান, নিউ ইয়র্ক শহরে ইয়েশিভা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক। উনি একজন অনুমোদিত মনোবিদ যিনি সাইকোলজি নিয়ে ২৫ টিরও বেশি বই লিখেছেন। সম্প্রতি উনি ডা: উইলিয়াম কম্পটনের সাথে ‘পজিটিভ সাইকোলজি: দ্যা সায়েন্স অফ হ্যাপিনেস অ্যান্ড ফ্লারিশিং’ রচনা করেছেন। এছাড়াও তিনি ‘ইন্ডিয়ান জার্নাল অফ পজিটিভ সাইকোলজি’ এবং ‘জার্নাল অফ হিউম্যানিস্ট সাইকোলজি’র সম্পাদকমন্ডলীর সঙ্গে যুক্ত। আপনি তাঁর সাথে columns@whiteswanfoundation.org -এ যোগাযোগ করতে পারেন।

Related Stories

No stories found.
logo
হোয়াইট সোয়ান ফাউন্ডেশন
bengali.whiteswanfoundation.org