২০১৫ সালের জুন মাস পর্যন্ত আমি আমার জীবন কাটিয়েছি মুম্বই শহরে। তারপর আমাদের প্রতিবেশী দেশ মায়ানমারের ইয়াঙ্গন, যা রেঙ্গুন নামেও পরিচিত, সেখানে চলে যেতে হয় আমাকে।
ইয়ঙ্গনে গিয়ে প্রথম তিনমাস আমার অবস্থা হয়েছিল নিম্নরূপ-
কোনও সামাজিক জীবন ছিল না আমার। কারণ সেখানকার কোনও মানুষকেই আমি চিনতাম না। একমাত্র যার সঙ্গে কথা হত তিনি হলেন আমার স্বামী। কিন্তু তিনি সারাদিন কাজের ব্যস্ত থাকতেন।
বার্মিজ ভাষা না জানার কারণে বাজার থেকে কীভাবে সবজি কিনব তা যেমন বুঝতে পারতাম না তেমন ট্যাক্সিতে উঠে চালককেও নির্দেশ দিতে পারতাম না সঠিক রাস্তা দিয়ে আমায় নিয়ে যাওয়ার জন্য।
সেইসময়ে কোনও চাকরিও আমি খুঁজে পাইনি।
টাটকা দই বা পাঁউরুটিও সেখানে আমি দেখতে পাইনি।
আমি একটা বিষয় ভেবেই হতাশ হয়ে পড়েছিলাম যে যেসব সহজ খাবারগুলো আমি ইয়াঙ্গনে খেতে পারছিলাম না সেগুলো কীভাবে আমি আবার আমার নিজের দেশে গিয়ে বাড়ি থেকে নিয়ে আসব। আমার মুম্বইতে থাকাই উচিত ছিল ভেবে আমি মাঝে মাঝে খুব বিচলিত হয়ে পড়তাম; এমনকি, প্লেনে করে ভারতে ফিরে যাওয়ার চিন্তাও আমার মাথায় আসত।
তবে ইইয়াঙ্গনে থাকাকালীন যে বিষয়টা নিয়ে আমি সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েছিলাম তা হল ঘুমের সমস্যা। ওখানে গোটা রাত আমি দু'চোখের পাতা এক করতে পারতাম না। অবশেষে ভোর পাঁচটা থেকে সাড়ে পাঁচটার মধ্যে আমার ঘুম আসত। ঘুম থেকে উঠতে উঠতে দুপুর গড়িয়ে যেত। তখন খুব খিদেও পেয়ে যেত। আমি চেষ্টা করতাম অনেক বইপত্র পড়ে, টিভি দেখে, স্বাধীনভাবে কিছু লেখালিখি করে এবং নিজের ব্লগ আপডেট করে খুশি থাকার। কিন্তু এসব করেও কোনও লাভ হত না। আমি ওইসব কাজে না অনুপ্রাণিত বোধ করতাম আর না কোনও কিছুতে আমার আগ্রহ জাগত।
দীর্ঘ, খাঁ খাঁ করা দুপুরগুলোতে আমায় বাড়িতেই থাকতে হত। মুম্বইয়ে থাকাকালীন বন্ধুদের সঙ্গে যাওয়া নৈশভোজের সেই দিনগুলোর কথা ভেবে আমার ভীষণ কষ্ট হত। ভাইপোকে সঙ্গে নিয়ে আইস্ক্রিম কেনার কথা চিন্তা করেও আমার মন ভারাক্রান্ত হয়ে উঠত। সপ্তাহের শেষে ছুটির দিনগুলোয় পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দুপুরের খাবার খাওয়ার আনন্দও আমাকে বারবার দেশের কথা মনে করিয়ে দিত। এমনকী মুম্বইয়ের বর্ষাকেও আমি ইয়ঙ্গনে বসে অনুভব করার চেষ্টা করতাম। কিন্তু মনে হত এসব কিছুই যেন আমার জীবন থেকে চিরতরে হারিয়ে গেছে।
এভাবে কিছু সময় কাটার পর আমি বার্মিজ ভাষা শিখব বলে সিদ্ধান্ত নিই এবং এমন কাজের সন্ধান করি যার ফলে বেশ কিছু সময় আমি নিজেকে ব্যস্ত রাখতে পারি। আমি অনলাইনে প্রাথমিক পর্বের বার্মিজ ভাষার অডিও-র খোঁজ পাই এবং দোকান-বাজারে গিয়ে আমি নতুন ভাষার নতুন কিছু শব্দ ব্যবহার করতে শুরু করি। এছাড়া অনলাইনের নানা প্রযুক্তি ঘাঁটতে ঘাঁটতে আমি দেখতে পেয়েছিলাম একজন রাশিয়ান মহিলা তাঁর ছেলের জন্য স্প্যানিশ ভাষা শেখানোর শিক্ষকের খোঁজ করছেন। আমি স্প্যানিশ ভাষা বলতে পারতাম। তাই ই-মেল করে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম। ওই মহিলার সাত বছরের ছেলেটি খুবই সপ্রতিভ ও হাসিখুশি স্বভাবের ছিল। আর ওই বাচ্চাটিই ছিল মায়ান্মারে থাকাকালীন আমার প্রথম বন্ধু।
ঠিক এই সময়েই আমার মা আমাদের সঙ্গে দেখা করতে মায়ানমারে এসেছিলেন। তিনি আমাদের জন্য নানারকম পদ রান্না করতেন আর আমি মাকে রান্নার কাজে সাহায্য করতাম। মা থাকাকালীন আমি আমার জীবনযাপনের জন্য যে রুটিন তৈরি করেছিলাম, সেই রুটিন মা চলে যাওয়ার পরেও আমি চেষ্টা করেছিলাম বজায় রাখতে। ওইসময় থেকেই আমি সকাল-সকাল ঘুম থেকে উঠে যোগব্যায়াম করতাম। আমার ঘুমও সেই সময় থেকে ভালো হতে শুরু করেছিল।
তখন থেকে আমি নিজের জন্য বাইরে বেরনোর ক্ষেত্রে বেশ কিছু আত্মবিশ্বাস অর্জন করেছিলাম। আমি খোঁজ করে এমন একখানা মানুষের দলের সন্ধান পাই যে দলে আমিও একজন সদস্য ছিলাম। একটা স্প্যানিশ ভাষার ক্লাবের সঙ্গে আমার নিয়মিত যোগাযোগ গড়ে ওঠে। আমি একটা মহিলাদের দলে নিজের নাম লিখিয়েছিলাম এবং তাদের সঙ্গে শিক্ষামূলক ভ্রমণে গিয়েছিলাম ও তাদের বইয়ের ক্লাবও ঘুরে দেখেছিলাম। এছাড়াও আমি ইয়ঙ্গনের লেখক গোষ্ঠীতে নিজের নাম লিখিয়েছিলাম। আর এর ফলে আমার সপ্তাহের শেষে ছুটির দিনগুলো খুব সুন্দরভাবে কাটতে শুরু করেছিল।
এভাবে ইয়ঙ্গনে ছ'মাস কাটানোর পর ওই দেশটাকে আমার নিজের বলে মনে হতে শুরু করল। আমি ধীর-স্থির শান্ত জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত হয়ে উঠতে লাগলাম, স্থানীয় রেস্তোরাঁগুলোতে গিয়ে খুব উপভোগ করতে শুরু করলাম এবং মায়ান্মারের সংস্কৃতিও আমার বেশ পছন্দের বিষয় হয়ে উঠেছিল। ওখানকার মানুষের সততা, সরলতা আমায় মুগ্ধ করেছিল। কারণ একবার ট্যাক্সিতে উঠে আমি আমার মোবাইল ফোন ফেলে চলে আসি। পরে ট্যাক্সির চালক ওই ফোনটি আমায় ফিরিয়ে দিয়ে যায়। মায়ান্মারের রাজ পরিবারের ইতিহাস, ঔপনিবেশিক শাসন এবং মায়ান্মারের জনগণের কাছে বৌদ্ধধর্মের গুরুত্ব প্রভৃতি বিষয়গুলোর প্রতি আমি ক্রমে আকৃষ্ট হতে শুরু করেছিলাম।
বিভিন্ন দলে যোগ দেওয়ার জন্য আমার সঙ্গে সব অদ্ভুত মানুষজনের পরিচয় হতে শুরু করে এবং সেই সূত্রে আমার অনেক নতুন বন্ধুবান্ধবও গড়ে ওঠে। অথচ যাদের সঙ্গে আমার হয়তো কখনও দেখা হওয়ার সুযোগই ছিল না। সেই সব বন্ধুদের জীবনের নানা অভিজ্ঞতার কথা শুনে আমি কত নতুন ধারণা ও আঙ্গিকের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ লাভ করি। আর লেখালিখির ক্ষেত্রে সেইসব নতুন ধারণাই আমার কাছে মুখ্য হয়ে দেখা দিয়েছিল।
সবচাইতে যেটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল তা হল নিজের বিষয়ে অনেক নতুন কিছু শিখেছিলাম। আমি উপলব্ধি করেছিলাম যে নতুন পরিস্থতি ও জায়গার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা আমার রয়েছে। সেই সঙ্গে এটাও বুঝতে পেরেছিলাম যে অন্য দেশের মানুষের ভাষা যদি আমি কিছুটা হলেও শিখতে পারি, জানতে পারি তাহলে তা মানুষের সঙ্গে পারস্পরিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে প্রভূত সাহায্য করে থাকে। এছাড়াও শিখেছিলাম সমমনস্ক মানুষ খুঁজে বের করতে পারলে জীবনে অনেক নতুন বন্ধু পাওয়াও সম্ভব হয়।
দেড় বছর মায়ানমারে কাটিয়ে আমি সেখান থেকে চলে আসি। আসার সময় আমার বন্ধুরা আমাকে অনেক উপহার দিয়ে বিদায় জানিয়েছিল।
ইয়াঙ্গন থেকে মুম্বই ফিরে আসার পর প্রায় ছ'মাসের বেশি সময় কেটে গিয়েছে। কিন্তু ইয়ঙ্গনের কথা ভাবলেই আমার মন খারাপ হয়ে যায়। সেখানকার সহজ-সরল জীবনযাত্রা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সুস্বাদু ফল, ব্যস্ত বাজার-হাট এবং রাস্তার ধারে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের আনাগোনা- সবই আমায় মুগ্ধ করেছিল। সেখানকার মানুষজনের কথাও আমার খুব মনে পড়ে। যতই হোক ওই দেশটাকেই আমি স্বদেশ বা নিজের বাসস্থান বলে মনে করেছিলাম।
প্রবন্ধটি লিখেছেন মুম্বইয়ের ফ্রিল্যান্স লেখক এবং ব্লগার রোহিণী। ইনি দ্বিতীয়বারের জন্য আবার মায়ান্মার যাওয়ার স্বপ্ন দেখেন।
এই প্রবন্ধটি দেশান্তর বা স্থানান্তর সংক্রান্ত এবং তার প্রভাব কীভাবে আমাদের মানসিক স্বাস্থ্য ও অনুভূতির উপরে পড়ে সেই বিষয়ের অর্ন্তগত। এই বিষয়ে আরও জানতে পড়ুন-