শিক্ষক কি একজন সুপরামর্শদাতার ভূমিকা পালন করতে সক্ষম?

শিক্ষক কি একজন সুপরামর্শদাতার ভূমিকা পালন করতে সক্ষম?

স্কুল এবং কলেজে পড়ার সময়ে এমন কয়েকজন শিক্ষক থাকেন যাঁরা ছাত্র-ছাত্রীদের মন জয় করে তাদের প্রিয়জন হয়ে ওঠেন। কিন্তু তাঁদের মধ্যে কী এমন বিশেষত্ব থাকে, যা দেখে পড়ুয়ারা মুগ্ধ হয়ে যায়? এইসব শিক্ষকরা যেমন ছাত্রদের কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকেন তাঁদের শিক্ষাদানের জন্য, তেমন পড়ুয়াদের প্রতি এঁদের সহমর্মিতা ও সহানুভূতিশীল আচরণও তাঁকে ছাত্রদের কাছের মানুষ হতে সাহায্য করে। একজন উৎকৃষ্ট মানের শিক্ষকের মধ্যে এই দুই গুণের উপস্থিতি প্রায়শই চোখে পড়ে।

যেহেতু ছাত্রাবস্থায় একজন ছেলে বা মেয়ের জীবনের অধিকাংশ সময় কাটে স্কুল এবং কলেজের চৌহদ্দিতে, সেহেতু ছাত্রদের চরিত্র গঠনে একজন শিক্ষকের অবদান অনস্বীকার্য। যেখানে স্কুলের একজন কাউন্সেলর বা পরামর্শদাতার উপর ছাত্রদের নানাবিধ মানসিক সমস্যা যেমন, ভেঙে যাওয়া সম্পর্ক, বাবা-মায়ের সঙ্গে ছেলে-মেয়েদের সম্পর্কের পারস্পরিক টানাপোড়েন, আত্মবিশ্বাস ও শরীরগত সমস্যা, মাদকাসক্তি এবং আত্মহত্যার প্রবণতা বা কেরিয়ার গঠনে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার মতো সমস্যা সমাধানের ভার থাকে, সেখানে একজন শিক্ষক, যিনি প্রতিনিয়ত ছাত্রদের সংস্পর্শে থাকেন এবং ছাত্রদের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের জন্য তাদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন ও অনুপ্রেরণা দানের ক্ষেত্রে সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারেন। এইভাবে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একজন কাউন্সেলর যেমন ছাত্রদের সুবিধার্থে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেন, তেমন একজন প্রকৃত শিক্ষকও প্রাথমিকভাবে শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার্থীদের কল্যাণসাধনের জন্য নিজেকে নিয়োজিত রাখতেই পারেন।

ভারতে সেন্ট্রাল বোর্ড ফর সেকেন্ডারি এডুকেশন (সিবিএসই)-এর সুপারিশ অনুযায়ী, একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পূর্ণ সময়ের জন্য নিযুক্ত কর্মচারীরা একাধারে কাউন্সেলর বা ছাত্রদের পরামর্শদাতাও বটে। অবশ্য প্রায়শই এর ব্যতিক্রম চোখে পড়ে। কারণ অনেক সময়ে শিক্ষাঙ্গনের কর্তৃপক্ষের গাফিলতি বা  প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কাউন্সেলরের অভাবে উপরোক্ত সুপারিশের বাস্তব প্রয়োগ সম্ভব হয়ে ওঠে না। অপরদিকে আরও একটি সমস্যা রয়েছে। ছাত্ররা যখন দেখে যে তারা সংকটের মধ্যে পড়েছে, তখন একপ্রকার বাধ্য হয়ে বা গড়িমসি করে তারা কাউন্সেলরের সাহায্য নেয়। না হলে ছাত্রদের সঙ্গে এহেন পরামর্শদাতাদের যোগাযোগ বড় একটা ঘটে না। এই খামতি পূরণে একজন শিক্ষক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন। একজন শিক্ষক, যিনি ছাত্রদের বিশ্বাসভাজন ও তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল, প্রয়োজন মতো তিনি পড়ুয়াদের সমস্যা সমাধানের জন্য তাদের পাশে দাঁড়িয়ে, নতুন দিশা দেখিয়ে একজন সুপরামর্শদাতা বা কাউন্সেলরের দায়িত্ব পালনের জন্য এগিয়ে আসতেই পারেন। অবশ্য সব শিক্ষকের মধ্যেই যে এহেন গুণ থাকবে, তা আশা করা ঠিক নয়।

কোন শিক্ষকের পক্ষে এহেন দায়িত্ব পালন করা সম্ভব?

একজন শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীর মধ্যে পারস্পরিক আদান-প্রদান খুব সহজ বিষয় নয়। এই ক্ষেত্রে শিক্ষককে হতে হবে উদারমনস্ক এবং সহানুভূতিশীল। শিক্ষক যদি এই ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী হতে চান, তাহলে ছাত্রদের মনে তাঁর প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা জাগিয়ে তোলা একান্ত জরুরি।

কোন কোন গুণের জন্য একজন শিক্ষকের প্রতি ছাত্র-ছাত্রীদের আকর্ষণ জন্মায়—

  • স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি — একজন ছাত্রের প্রতি শিক্ষকের দৃষ্টিভঙ্গি হওয়া উচিত স্বচ্ছ এবং বাস্তবসম্মত। ব্যক্তিগত সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে খোলা মনে নিজের শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং দৃঢ় ব্যক্তিত্ব গঠনের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের মন জয় করাই একজন শিক্ষকের প্রকৃত দায়িত্ব।

  • মূল্যবান অভিজ্ঞতার অধিকারী — যিনি বহুদিন ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন এবং নিজের কর্মক্ষেত্র ও শিক্ষার্থীদের সম্পর্কে তাঁর ধারণা স্পষ্ট, এমন ব্যক্তিই যোগ্য পরামর্শদাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারেন। এছাড়া যে শিক্ষক তাঁর কাজের মাধ্যমে ছাত্রদের কাছে একান্ত গ্রহণযোগ্য এবং শ্রদ্ধার পাত্র, তিনিই হতে পারেন একজন দক্ষ পরামর্শদাতা।

  • ভালো শ্রোতা হওয়া প্রয়োজন — ছাত্রদের কথা, তাদের সমস্যা মন দিয়ে ধৈর্য সহকারে শোনা একজন শিক্ষকের অন্যতম কর্তব্য। আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অনুশীলন, ধৈর্য প্রদর্শন এবং ছাত্রদের প্রতি সহমর্মী হওয়ার অভ্যাস থাকা একজন শিক্ষকের পক্ষে একান্ত জরুরি। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের আবেদনে সাড়া দেওয়া সহজসাধ্য হয়।

  • এক থাকার মানসিকতা — ছাত্রদের সমস্যার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত হওয়ার ক্ষমতা থাকা শিক্ষকের অন্যতম গুণ। পড়ুয়াদের আস্থা অর্জনের জন্য দরকার কোনও গুজব বা রটনায় কান না দেওয়া। উদাহরণস্বরূপ, কোনও ছাত্র যদি তার পরিবারের অশান্তির কথা শিক্ষককে জানায়, তাহলে শিক্ষকের উচিত সেই কথা নিজের মধ্যেই রেখে দেওয়া, পাঁচ কান না করা।

  • দৃঢ়চেতা এবং অনুসন্ধিৎসু — ছাত্রদের সমস্যা বোঝা এবং তা সমাধানে সাহায্য করার জন্য শিক্ষককে হতে হবে প্রত্যয়ী, দৃঢ়চেতা। সেই সঙ্গে তাঁর অনুসন্ধিৎসু মনোভাবের দ্বারা ছাত্রদের সঠিক সমস্যা বুঝে তার সমাধান খোঁজা উচিত।

ছাত্ররা যখন তাদের সংকটমোচনের জন্য শিক্ষকের সাহায্য চাইবে, তখন তাঁর করণীয় হল—

  • সুসম্পর্ক স্থাপন — একজন শিক্ষকের সুপরামর্শদাতা হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে এটিই প্রথম ধাপ। শিক্ষকের উপস্থিতি যেন ছাত্রের কাছে স্বস্তিদায়ক হয় এবং সে মন খুলে যাতে তার কথা শিক্ষককে জানাতে পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখা জরুরি। মনে রাখতে হবে যে, শিক্ষক যতক্ষণ না ছাত্রের আস্থা অর্জন করছেন ততক্ষণ ছাত্র তার সমস্যা বিশ্বাস করে সেই শিক্ষককে বলতে পারবে না। তাই এই ক্ষেত্রে ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে পারস্পরিক সুসম্পর্ক গড়ে ওঠা একান্ত কাম্য। ছাত্রকে মনের ভাব প্রকাশের স্বাধীনতা দেওয়া জরুরি — শিক্ষার্থীরা যখন তাদের সংকটের কথা শিক্ষককে জানানো শুরু করবে, তখন তাদের সমস্যা মন দিয়ে শুনতে হবে শিক্ষককে। কোনওরকম বাধা না দিয়ে ছাত্রদের প্রাণ খুলে বলার স্বাধীনতা দিতে হবে। এই অবস্থায় ছাত্রের চিন্তাভাবনার সঙ্গে শিক্ষকের সহমত পোষণ করা একান্ত জরুরি। এইভাবে ছাত্র-শিক্ষকের চিন্তার মধ্যে স্বচ্ছতা আসবে। আর তার ফলে ছাত্রদের মূল সমস্যাটিকে চিহ্নিত করে ধীরে ধীরে তার সমাধানের পথ খোঁজা শুরু হবে। অপ্রয়োজনীয়, অহেতুক মতামত প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকা বাঞ্ছনীয় — ছাত্রদের অনুভূতির প্রতি সহানুভূতি এবং প্রত্যয়ী মনোভাব দেখানো শিক্ষকের অবশ্য কর্তব্য। যেমন কোনও ছাত্র যদি শিক্ষককে এসে বলে যে সে প্রতিদিন ৬০টি সিগারেট খায়, তাহলে তার উত্তরে শিক্ষকের সেই ছাত্রকে গালমন্দ করা কখনোই উচিত নয়।  এক্ষেত্রে নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করা একজন প্রকৃত শিক্ষকের প্রধান কাজ। নিজের অনুভূতিগুলিকে বজায় রাখা — নিজের ধ্যান-ধারণা এবং অনুভূতিগুলির সদ্ব্যবহার করা একজন শিক্ষকের অন্যতম দায়িত্ব। এর সঙ্গে তাঁদের নিজস্ব মেজাজ-মর্জি ও অনুভূতিগুলি ছাত্রদের উপর চাপিয়ে দেওয়া একেবারেই ঠিক নয়। তাঁর উচিত ছাত্রদের জায়গা থেকে বিচার করে তাদের সমস্যার সমাধান করা। গোপনীয়তা রক্ষার জন্য আন্তরিক চেষ্টা করা — পড়ুয়াদের কাছ থেকে তাদের সমস্যা জানার পর কখনোই তা তৃতীয় কোনও ব্যক্তির সঙ্গে আলোচনা করা সঠিক নয়। সেগুলি গোপন রাখাই বাঞ্ছনীয়। একমাত্র যদি এমন কোনও ঘটনা, যা স্কুলের অন্যান্য ছাত্রদের ক্ষতি করতে পারে, সেই বিষয়টি স্কুল কর্তৃপক্ষকে জানানো দরকার।

এছাড়া স্কুল কর্তৃপক্ষ কোনও বিশেষ শিক্ষককে ছাত্রদের কাউন্সেলিং করার জন্য দায়িত্ব দিতে পারে।

ব্যাঙ্গালোরের জৈন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান কাউন্সেলর ডা. উমা ওয়ারিয়রের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য এই লেখাটিকে সমৃদ্ধ করতে সাহায্য করেছে।

Related Stories

No stories found.
logo
হোয়াইট সোয়ান ফাউন্ডেশন
bengali.whiteswanfoundation.org