নতুন মাতৃত্ব: সদ্য একটি সন্তানের জন্ম দিয়ে আমি বিষণ্ণ ও দিশাহারা হয়ে পড়েছি

নতুন মাতৃত্ব: সদ্য একটি সন্তানের জন্ম দিয়ে আমি বিষণ্ণ ও দিশাহারা হয়ে পড়েছি

সন্তানের জন্মের ঠিক আগে ও পরের সময়টাকে বলা হয় পেরিনাটাল পর্যায়। গর্ভধারণের বাইশ সপ্তাহ সম্পূর্ণ হলে এই পর্যায়ের শুরু হয় এবং বাচ্চার জন্মের সাতদিন পরে তা শেষ হয়।

পেরিনাটাল পর্যায়টা এমন একটা সময় যখন একজন মা ও তার পরিবারকে বহু পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে হয়। নতুন অভিভাবকরা এসময়ে অনেক অনন্য  অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়। এর ফলে তারা কোনও কোনও সময়ে দিশাহারা
বোধ করে।

'ব্লুজ' বা মন কেমন করা - এটি স্বাভাবিক ঘটনা                          

সন্তান জন্মানোর দুই থেকে পাঁচদিন পরে অনেক মা 'বেবি ব্লুজ'-এর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়। এই সময়কার মানসিক টানাপোড়েন বা দ্বন্দ্ব খুবই স্বাভাবিক ও সাময়িক একপ্রকার ঘটনা এবং এর গভীরতা একেকজন মায়ের ক্ষেত্রে এক-একরকম হয়ে থাকে। সাধারণত একজন নতুন মা এই পর্যায়টিকে বাচ্চার জন্মের ১০দিনের মধ্যেই অতিক্রম করে ফেলে।

স্বাভাবিক নয় এমন বিষয়

যখন ভাবপ্রবণতা, খিটখিটে ভাব বা অন্য ধরনের মানসিক সমস্যা দু'সপ্তাহের বেশি সময় ধরে চলতে থাকে তখন তা প্রসব-পরবর্তী অবসাদে পরিণত হয়।

যদি কারোর নিজের বা স্ত্রীর অথবা মেয়ের ক্ষেত্রে এইধরনের লক্ষণ লাগাতার লক্ষ করা যায় তাহলে অবিলম্বে একজন বিশেষজ্ঞের সাহায্য নেওয়া জরুরি।

এক্ষেত্রে আরেকটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ যে পেরিনাটাল অবসাদ বাচ্চার মা, বাবা ও সদ্যোজাতকে ক্ষতিগ্রস্ত করে তুলতে পারে। মা-শিশুর বন্ধনে বাধা পড়তে পারে এবং মায়ের সঙ্গে বাচ্চার নৈকট্যে বিঘ্ন ঘটতে পারে। সদ্যোজাত সন্তানের বাবারাও সন্তানের জন্মের পর অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়তে পারে। সমগ্র পরিবারের সুস্থতার ক্ষেত্রে এই ঘটনার প্রভাব লক্ষ করা যায়।

তবে মনে রাখা জরুরি যে সন্তান জন্মানোর পরবর্তী সময়ের অবসাদ চিকিৎসা যোগ্য। তাই যদি অসুস্থতার সঠিক চিকিৎসা না হয় তাহলে অর্ধেকের বেশি সংখ্যক নতুন মা বাচ্চার জন্মের ছ'মাস পরেও অসুখে ভুগতে থাকে।

প্রসব-পরবর্তী পর্যায়

এই পর্যায় শুরু হয় বাচ্চার জন্মের ঠিক পরেই এবং তা চলতে থাকে সন্তানের জন্মের পর ছ'সপ্তাহ পর্যন্ত। প্রসব-পরবর্তী পর্যায়ের প্রথম সপ্তাহে নানারকম মানসিক উপাদান ও হরমোনের প্রভাব নতুন মায়েদের মেজাজ-মর্জি ও আবেগের উপর পড়ে। এইসময়ে অধিকাংশ মা-ই খুব আবেগপ্রবণ, অবসাদগ্রস্ত, বিষণ্ণ, খিটখিটে ও উদ্বিগ্ন থাকে। তাদের মধ্যে এইসময় খিদে না পাওয়া, মাথাব্যথা এবং ভুলে যাওয়ার সমস্যা দেখা যায়। এগুলিকে প্রসব-পরবর্তী ব্লুজ-এর লক্ষণ বলে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। তবে এই পর্যায়টি সাময়িক ও দশদিনের মধ্যে মায়েরা সব বাধা অতিক্রম করতে সক্ষম হয়...

যখন এই লক্ষণগুলো লাগাতার ও গুরুতর হয়ে ওঠে তখন তা প্রসব-পরবর্তী অবসাদে পরিণত হয়। এই সমস্যাটা প্রায়ই চোখে পড়ে ও নিরাময়যোগ্য। বাচ্চার  জন্মের ছ'সপ্তাহের মধ্যে একজন মা গুরুতর অবসাদে আক্রান্ত হতে পারে। যদি এই সমস্যার চিকিৎসা না হয় তাহলে পরবর্তী ছ'মাস বা তার বেশি সময় ধরে এই অব্যবস্থা চলতে পারে, যার ফলে মায়ের সঙ্গে শিশু ও তার পরিবারের লোকজনও ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে।

প্রসব-পরবর্তী অবসাদের কয়েকটি লক্ষণ হল-

  • দিশাহারা বোধ করা, খিটখিটে হয়ে যাওয়া এবং অনবরত ক্লান্ত হয়ে পড়া

  • আত্মনির্ভরতা কমে যাওয়া এবং অভিভাবকত্বের দক্ষতা নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়া

  • বাচ্চার বিষয়ে একনাগাড়ে চিন্তাভাবনা করা অথবা বাচ্চার যত্নের ব্যাপারে কোনও আগ্রহ না থাকা

  • বাড়ির অনিয়মিত রুটিনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে অক্ষম হওয়া। বাচ্চার স্তনপানের, ঘুমানোর সময় এবং ধরনের অনির্দিষ্টতার জন্য মায়ের ঘুমের ক্ষেত্রে বিঘ্ন ঘটা

  • বাচ্চা ঘুমালেও মায়ের বিশ্রাম না নিতে পারার সমস্যা

  • সন্তানসম্ভবা বা বাচ্চার জন্মের আগে থাকা পছন্দের বিষয়গুলোর প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলা

  • কোনও কাজে মনঃসংযোগ না করা এবং সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগা

  • বাহ্যিক লক্ষণ হিসেবে উদ্বেগ, হৃদ্‌স্পন্দনের গতি বাড়া-কমা, অনবরত মাথাব্যথা, হাত ঘামা প্রভৃতি দেখা যায়

  • নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলা অথবা অতিসক্রিয় (হাইপারঅ্যাকটিভ) হয়ে ওঠা

  • পরিবারের সদস্য ও বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটাতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলা

  • নিজের এবং ভবিষ্যৎ সম্পর্কে লাগাতার নেতিবাচক ভাবনা ও আশাহত হওয়া

  • রাগ, দুঃখ, হারানোর বেদনা বোধ করা, সবসময়ে কাঁদো কাঁদো ভাব

  • খিদের ধরন বদলে যাওয়া

  • পরিবার বা বন্ধুদের মন্তব্যে অতিরিক্ত সংবেদনশীল হয়ে পড়া

  • মনে মনে নিজের বা বাচ্চার ক্ষতি করার চিন্তা জেগে ওঠা

  • অনবরত অপরাধ বোধ, লজ্জায় ভোগা। সেই সঙ্গে অমূলক চিন্তা বা অবাস্তব কল্পনা করতে থাকা

প্রসব-পরবর্তী অবসাদের চিকিৎসা

পেরিনাটাল অবসাদের ক্ষেত্রে মানসিক ও ওষুধগত- দু'ধরনের চিকিৎসাই কার্যকরী ফল দেয়।

পেরিনাটাল পর্যায়ের মানসিক উদ্বেগ ও মেজাজ-মর্জিগত সমস্যার চিকিৎসা  করানো একান্ত জরুরি। মানসিক চিকিৎসা হিসেবে থেরাপি যেমন- সিবিটি এবং ইন্টারপার্সোনাল থেরাপি খুবই মূল্যবান। তবে অসুখের যথাযথ চিকিৎসা না হলে তার দীর্ঘ প্রভাব সমগ্র পরিবারের উপর পড়তে পারে।

(বিশেষ দ্রষ্টব্য বা নোট - মহিলাদের মধ্যে গুরুতর অবসাদ অথবা বাইপোলার সমস্যা দেখা দিলে তা দূর করার জন্য ওষুধের প্রয়োগ একান্ত জরুরি।)

Related Stories

No stories found.
logo
হোয়াইট সোয়ান ফাউন্ডেশন
bengali.whiteswanfoundation.org