বৃদ্ধ বয়সে অসুস্থ সন্তানদের যত্ন নেওয়া একপ্রকার কষ্টসাধ্য বিষয়
অভিভাবকদের পক্ষে তাদের সন্তানদের বিকাশজনিত সমস্যা যেমন- অটিজম বা তাদের বয়ঃসন্ধিকালে হওয়া কোনও মানসিক অসুস্থতা, যেমন- স্কিৎজোফ্রেনিয়ার মতো সমস্যার মোকাবিলা করা অথবা তাদের যত্ন নেওয়া খুবই জটিল ও কষ্টসাধ্য কাজ। এই দুই সমস্যার ক্ষেত্রেই অভিভাবকদের সারা জীবন ধরে সন্তানদের পরিচর্যা করতে হয়।
মানসিক অসুখ এবং বিকাশজনিত অক্ষমতার মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে। যেমন- স্কিৎজোফ্রেনিয়া বা বাইপোলার সমস্যার মতো মানসিক অসুস্থতার ক্ষেত্রে মানুষ যদি সঠিক চিকিৎসা করায় তাহলে সাধারণভাবে তাদের জীবন সচল হতে পারে। কিন্তু মাঝারি বা গুরুতর বিকাশজনিত অক্ষমতা, যেমন- অটিজম অথবা জড়বুদ্ধিজনিত সমস্যার ক্ষেত্রে মানুষের মস্তিষ্কের বিকাশে ব্যাঘাত ঘটে এবং এর ফলে তাদের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ ও আদানপ্রদানের অভাব লক্ষ করা যায়। সেই সঙ্গে এই অসুখগুলো নিরাময়যোগ্যও হয় না।
বিকাশজনিত অক্ষমতার শিকার হওয়া বাচ্চাদের অভিভাবকত্বের দায়িত্বপালন বয়ঃসন্ধিকালীন মানসিক অসুখে (বয়ঃসন্ধির শুরুতেই অধিকাংশ এইধরনের মানসিক অসুস্থতা দেখা দেয়) আক্রান্ত বাচ্চাদের অভিভাবকত্বের থেকে আলাদা হয়। বিকাশজনিত অক্ষমতার শিকার হওয়া বাচ্চাদের ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য রক্ষা ও লালনপালনের জন্য তাদের জীবনযাপনের অঙ্গ হিসেবে কতগুলো প্রাথমিক দক্ষতা অর্জনের শিক্ষা দেওয়া জরুরি, যেমন- দাঁত মাজা, স্নান করা, ঠিকঠাক জামাকাপড় পরা প্রভৃতি। স্কিৎজোফ্রেনিয়া বা বাইপোলার সমস্যার মতো গুরুতর মানসিক অসুস্থতার ক্ষেত্রে বাচ্চাদের শারীরিক ও মানসিকভাবে যত্ন নেওয়ার জন্য অভিভাবকদের সহায়তা একান্ত প্রয়োজনীয়। এর ফলে সন্তানরা অসুস্থ থাকাকালীন সময়ে বিভিন্ন সমস্যার মোকাবিলা করে জীবনযাপন পদ্ধতিতে বদল ঘটাতে সক্ষম হয়। গুরুতর মানসিক অসুখে আক্রান্ত মানুষের সক্রিয় জীবনযাপনের জন্য তার পরিবার ও বন্ধুদের সাহায্য অত্যন্ত দরকারি বিষয়।
উপরের এই দু'ধরনের সমস্যার ক্ষেত্রেই একজন বয়স্ক অভিভাবককে তার সন্তানের দেখভালের জন্য কিছু জটিলতার সম্মুখীন হতে হয়-
১. যখন আমি (বাবা-মা) থাকব না তখন কে আমার সন্তানের দেখভাল করবে- দীর্ঘ সময় ধরে মানসিকভাবে অসুস্থ সন্তানের দেখভাল করার পর বয়স্ক বাবা-মায়ের প্রথম যে চিন্তা মাথায় আসে তা হল- বাবা-মায়ের পর এমন কোন পূর্ণবয়স্ক একজন মানুষ থাকবে যে ওই অসুস্থ সন্তানের যত্ন নিতে পারবে? এক্ষেত্রে অভিভাবকরা চায় যে তাদের অবর্তমানে এমন কেউ যেন থাকে যে তাদের সন্তানের জীবনধারনের জন্য প্রাথমিক চাহিদাগুলো মেটাতে পারবে, সময়মতো ওষুধ খাওয়াতে পারবে, পর্যায়ক্রমিক স্বাস্থ্য-পরীক্ষার ব্যবস্থা করবে এবং অসুস্থ সন্তানটিকে ভালোবাসবে। এই প্রবন্ধে সেই বিষয়গুলো নিয়েই আলোচনা করা হয়েছে।
২. বৃদ্ধ অভিভাবকদের নিজেদের লাগাতার অসুস্থতার মোকাবিলা করা- মানুষের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা লাগাতার নানারকম অসুখে ভোগে, যেমন- ডায়াবেটিস বা মধুমেহ রোগ, হার্ট এবং উচ্চরক্তচাপের বা হাইপারটেনশনের সমস্যা প্রভৃতি। তাই নিজেদের শারীরিক সমস্যার সঙ্গে যখন সাবালক সন্তানের অসুস্থতার মোকাবিলা করতে হয় তখন তা তাদের কাছে সত্যিই কঠিন এবং চাপের
হয়ে দাঁড়ায়।
৩. পরিচর্যার কাজে গুণগত মানের অভাব- অভিভাবকরা যখন তাদের অসুস্থ সন্তানের দেখভালের জন্য পেশাদার পরিচর্যাকারী নিয়োগ করার কথা চিন্তা করে তখন তাদের মধ্যে অনেক দোটানা মনোভাব দেখা দেয়। তারা ভাবে যে পরিচর্যাকারী আদৌ তত দক্ষ হবে কিনা বা বাড়িতে সন্তানরা যেরকম যত্নের সুযোগ পায় সেরকম যত্ন একজন পরিচর্যাকারী করতে পারবে কিনা। যেহেতু আমাদের দেশে পুনর্বাসনের সুবিধা খুবই কম এবং সেই বিষয়টা সম্পর্কে মানুষের ধারণা খুবই অল্প, তাই পরিচর্যাগত পরিষবায় এত ঘাটতি লক্ষ করা যায়।
৪. মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ হয়- গুরুতর মানসিক অসুখে আক্রান্ত ছেলে-মেয়ের অভিভাবকদের মানসিক অসুস্থতাজনিত সামাজিক কলঙ্কের ভয়ে প্রায়শই সামাজিক বিচ্ছিন্নতার মতো সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। একাকিত্ব ও অনবরত অসুস্থ সন্তানের পরিচর্যা করতে করতে অভিভাবকরা সন্তানদের কাছে থেকে মানসিকভাবে দূরে চলে যায় এবং পরিচর্যার কাজ অত্যন্ত যান্ত্রিক হয়ে পড়ে। দীর্ঘ সময় ধরে এই ঘটনা ঘটার ফলে পরিচর্যাকারীর কাছে সন্তানদের দেখভাল করা বোঝা হয়ে দাঁড়ায়।
৫. জীবনের বাস্তবতা ব্যাখ্যা করা জরুরি- যে সব অভিভাবকের সন্তান বাচ্চা থাকাকালীন স্কিৎজোফ্রেনিয়ার মতো অসুখের শিকার হয় সেইসব বাচ্চা যত বড় হতে থাকে তত তারা দেখতে পায় যে তাদের কাছের মানুষের বিয়ে হচ্ছে, বাচ্চা হচ্ছে অথবা কেরিয়ার নিয়ে তারা খুব ব্যস্ত। কিছু ব্যতিক্রমী ঘটনা থাকে যেখানে মানসিকভাবে অসুস্থ মানুষ জীবনধারনের ক্ষেত্রে সচল হতে পারে না। তখন বয়স্ক বাবা-মায়ের কাছে সন্তানদের সামনে সেই কঠিন বাস্তবের ব্যাখ্যা করা অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়ায়। সন্তানদের সামনে তাদের রোগের জটিলতা এবং সামাজিক কলঙ্কের বিষয়টা তুলে ধরা বৃদ্ধ বাবা-মায়ের কাছে একটা মস্ত সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। যদি কোনও অভিভাবক এইধরনের সমস্যায় পড়ে তাহলে তা সমাধানের জন্য একজন মানসিক স্বাস্থ্যের বিশেষজ্ঞের সাহায্য নেওয়া একান্ত জরুরি। তাঁর সঙ্গে এই বিষয়ে বিশদে আলোচনা করাও গুরুত্বপূর্ণ।
৬. একা সমস্যার মোকাবিলা করা- সন্তানের সঠিক রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে অনেকদিন ধরে তাদের দেখভাল করার জন্য অভিভাবকদের নিজস্ব সম্পর্কের মধ্যে তিক্ততার সৃষ্টি হতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে অভিভাবকদের মধ্যে পাকাপাকিভাবে বিচ্ছেদ হয়ে যায়। তখন বাবা বা মা যে কোনও একজন অভিভাবককে একা দীর্ঘ সময় ধরে সন্তানের পরিচর্যা করতে হয়। এই পরিস্থিতিতে একা একজন অভিভাবকের পক্ষে অর্থনৈতিক দিক সামাল দেওয়া, সন্তানের ভবিষ্যৎ সুনিশ্চিত করা এবং নিজেদের স্বাস্থ্যজনিত সমস্যার কথা চিন্তা করা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়ায়।
কীভাবে নিজেকে নিজে সাহায্য করা যায়-
প্রথমে একটা বিষয় মাথায় রাখতে হবে যে পরিচর্যার কাজ কোনও একজন মানুষের দায়িত্ব নয়। এই কাজে অনেক মানুষের সহায়তা প্রয়োজন এবং এভাবেই পরিচর্যাকারীদের চাপ ও শক্তিক্ষয় প্রতিরোধ করা জরুরি।
১. পরিচর্যাকারীদের যতটা সম্ভব ঠিকঠাক খাওয়াদাওয়া ও পর্যাপ্ত ঘুমের প্রয়োজন। যদি কারোর লাগাতার কোনও অসুখ থাকে তাহলে তা অবহেলা না করে সঠিক পদক্ষেপ করা দরকার। একনাগাড়ে চলতে থাকা পরিচর্যার কাজ থেকে কিছুটা বিশ্রাম নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে মেলামেশা এবং সামাজিকতা বজায় রাখতে হবে।
২. পরিচর্যার দায়িত্ব অন্যের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার জন্য চেষ্টা করতে হবে। সাময়িক বিশ্রাম নেওয়ার জন্য বিরতি-যত্ন পরিষেবা, বিশেষ করে দিবা-পরিচর্যার পরিষেবা কেন্দ্রের সন্ধান করা জরুরি। এর ফলে পরিচর্যাকারীদের ব্যক্তিগত এবং পেশাদারি দায়িত্বপালন করা সম্ভবপর হয়।
৩. পরিচর্যার কাজ করতে গিয়ে পরিচর্যাকারীরা যাতে নিজেদের একা বা বিচ্ছিন্ন ভাবতে না পারে সেজন্য পরিবারের অন্যান্য সদস্য ও বন্ধুদের সাহায্য নেওয়া একান্ত প্রয়োজনীয়।
৪. পরিচর্যাকারীরা যদি কোনওরকম মানসিক সমস্যার যেমন- লাগাতার ক্লান্তি, অনিদ্রা, অনবরত বিষণ্ণতা, খিটখিটে ভাব, হতাশা প্রভৃতির শিকার হয় তাহলে একজন মানসিক স্বাস্থ্যের বিশেষজ্ঞের সহায়তা অবশ্যই জরুরি হয়ে ওঠে।
সূত্র-
১. Family burden among long term psychiatric patients, J. Roychaudhuri, D. Mondal, A. Boral, D. Bhattacharya
২. Challenges faced by aging parents in caring for their children with mental disability, John Athaide, Prerana Chidanand, Tina Chung, 2013.