দুরারোগ্য ব্যাধির যত্ন নেওয়া
তিন বছর ধরে নিজের ক্যান্সার আক্রান্ত বাবার সেবা করার পর মহেশ খুব ভেঙে পড়েছিল, যখন ডাক্তার তাঁকে বলেন যে তাঁর বাবার ক্যান্সার একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে। এত দিন ধরে যত্ন নেওয়ার পরেও মহেশ এই খবরটি শুনে খুব কষ্ট পান। তিনি জানতেন না কীভাবে এই পরিস্থিতি তিনি সামাল দেবেন।
উপরের এই কাল্পনিক অংশটি তৈরি করা হয়েছে বাস্তব পরিস্থিতি ভাল করে বুঝতে পারার জন্য।
পরিচর্যা করা বেশ কঠিন ও ক্লান্তিকর একটি দায়িত্ব, এই দায়িত্ব আরও কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায় যখন একটি মানুষ একজন দুরারোগ্য ব্যাধি আক্রান্ত রুগীর পরিচর্যা করেন (ক্যান্সার, এইডস, অ্যালঝাইমার্স, বার্ধক্যজনিত অসুখ, ইত্যাদি)। এমনিতেই দুরারোগ্য ব্যধি নির্ণয় করা যথেষ্ট কঠিন কাজ। উপরন্তু যখন ডাক্তার রোগীর অবস্থার কথা জানান, পরিবারের প্রত্যেকেই হতভম্ব হয়ে পড়েন। তাঁরা প্রথমে হয়তো ব্যাপারটিকে মেনে নিতে চান না। তারপর তাঁরা চেষ্টা করেন এই রোগের একটি ভাল চিকিৎসা খুঁজে বার করার। কিন্তু যখন তাঁরা বুঝতে পারেন যে তা অসম্ভব, তখন বাধ্য হয়ে ভবিতব্যকে মেনে নেন।
যিনি যত্নপ্রদানকারী, তিনি সবসময় তাঁর মৃত্যুপথযাত্রী প্রিয়জনের সেবা করেন এবং ভাবেন যে কি ভাবে তাঁকে জানানো যায় তাঁর এই ব্যধির কথা। যখন শরীর আরও বিগড়োতে শুরু করে, তখন তাঁরা যত্নপ্রদানকারীর উপর আরও বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। এটি আরও চাপ সৃষ্টি করে, কারণ যত্নপ্রদানকারী নিজের দৈনন্দিন কাজ কর্মের সঙ্গে পরিস্থিতি সামলে উঠতে পারেন না। এই সময় যত্নপ্রদানকারীর নিজেরও পরিবার ও বন্ধুদের সাহায্যের প্রয়োজন।
যত্নপ্রদানকারী হিসাবে সাহায্য প্রদান করা
দুরারোগ্য ব্যাধি আক্রান্তের যত্ন নেওয়া খুবই কঠিন, যদিও একজন যত্নপ্রদানকারীকে তা সবসময় করে যেতে হবে।
তাঁকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে: প্রত্যেক মানুষই তাঁদের ব্যাধির কথা জানতে পেরে আলাদা আলাদা আচরণ করেন, এবং স্বাভাবিক ভাবেই তাঁরা কষ্ট পান। যত্নপ্রদানকারী হিসাবে সবসময় তাঁদের নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করতে হবে এবং তাঁদের মানসিক বল হয়ে উঠতে হবে। পরিবারের লোকজনকেও চেষ্টা করতে হবে তাঁর সঙ্গে আরও বেশি করে সময় কাটানোর।
আগে থেকেই পরিকল্পনা করা দরকার: বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে পরিবারের সদস্যরা যদি আগে থেকে পরিকল্পনা করে রাখেন, তাহলে খানিকটা হলেও সুবিধা হয়। পরিকল্পনা ছাড়া এগোলে, যত্নপ্রদানকারীর পক্ষে শেষ বেলায় সব কিছু সামলানো সম্ভব হয়ে ওঠে না।
বেশি করে কথা বলা প্রয়োজন: মানুষটির জীবন এবং তাঁর পরিবার সংক্রান্ত কথা যত বেশি করে আলোচনা করা যায় ততই ভাল। মানুষটিকে পরিবারের কথাবার্তা ও আলোচনায় অংশগ্রহণ করতে উৎসাহিত করুন। তাঁদের ইচ্ছে, আকাঙ্খা, চিন্তাভাবনার কথা মন দিয়ে শুনুন। যদিও, একজন স্মৃতিশক্তি লোপ পাওয়া ব্যাক্তির সাথে আপনি এরকম আলোচনা করতে পারবেন না।
বাড়িতে স্বাভাবিক ভাবে আচার আচরণ করুন: রোগীর জন্যে দৈনন্দিন কাজের একটা রুটিন তৈরি করে দিন। এর ফলে তিনি সবসময় কোনও না কোনও কাজে নিমজ্জিত থাকবেন। তাঁদেরকে সকলের সাথে দেখা করাতে নিয়ে যান, আর বাড়িতে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক আচরণ করুন। এতে মানুষটির আত্মমর্যাদা মজবুত থাকবে।
আইনি বা অর্থনৈতিক দিকগুলি সামলানো: যখন মানুষটি স্বাভাবিক অবস্থায় রয়েছেন, তাঁকে উৎসাহ দিন বাড়ির আইনি ও অর্থনৈতিক দিকগুলি দেখাশোনা করার (উইল, জমিজমা, পুঁজি ও ইত্যাদি)। এর ফলে মানুষটি এই ভেবে শান্তি পাবেন, যে তিনি যেমন চেয়েছিলেন ঠিক সেরকমই হচ্ছে। আর এর ফলে আপনিও কিছুটা সমস্যা কাটিয়ে উঠে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবেন।
সাহায্য নিন: রোগীর শরীর যখন আস্তে আস্তে আরও ভাঙতে থাকে, তখন আরও বেশি করে তিনি আপনার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন (স্নান করানো, জামাকাপড় পরানো, খাওয়ানো, বাথরুম ব্যাবহার করা)। আপনাকে এই পরিবর্তনের জন্য আগে থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে। আপনি যদি নিজে তা একাহাতে সামলাতে না পারেন, তাহলে আপনার পরিবারের সদস্যদের জানান অথবা একজন আয়া বা নার্স রাখার ব্যাবস্থা করুন।
আধ্যাত্মিক বিশ্বাস সমর্থন করুন: প্রত্যেক মানুষেরই নিজস্ব একটি বিশ্বাস রয়েছে। কারোর কাছে ধর্ম পালন করা খুব গুরুত্বপূর্ণ; ধর্মের মাধ্যমেই তাঁরা নিজের জীবন ও মৃত্যুর অর্থ খুঁজে পান। তাঁরা হয়তো পুরোহিত ডেকে নিজের জন্য পুজো করাতে বা ভজন শুনতে চান। কেউ আবার ধর্মীয় গ্রন্থ পড়তে পছন্দ করেন। নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী তাঁদেরকে সাহায্য করুন।
প্যালিয়েটিভ কেয়ার বেছে নিন: এই বিশেষ চিকিৎসা পদ্ধতিটি সাধারনত একটি অভিজ্ঞ দল দিতে পারেন। এই পদ্ধতি দিয়ে চেষ্টা করা হয় রোগী এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের একই সঙ্গে যন্ত্রণা ও চাপ মুক্ত করার। এই ভাবে দু’পক্ষেরই জীবনধারা কে একটু উন্নত করার চেষ্টা করা হয়।
দুরারোগ্য ব্যাধির চিকিৎসাতে কিছু সমস্যা
দুরারোগ্য স্নায়ুতাত্তিক সমস্যার ফলে ব্যাক্তি কোনও কিছু করার বা বোঝার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন। এখান থেকে সেরে ওঠার সম্ভাবনা খুবই কম (ডেমেনসিয়া, অ্যালঝাইমার্স)।
বার্ধক্যজনিত অসুস্থতা, যার জন্যে কোন একটি অঙ্গ কাজ করা বন্ধ করে দিতে পারে।
নিঃশব্দে ছড়াতে থাকা ক্যান্সার যার চিকিৎসা করা অসম্ভব হয়ে উঠতে পারে।
সার্জারির পর হওয়া সমস্যাগুলির সাধারণত কোনও চিকিৎসা হয় না।
ফুসফুস সংক্রান্ত, হৃদপিণ্ড জড়িত, মুত্রনালী জড়িত, বা যকৃতের সমস্যা সার্জারির পরেও শেষ পর্যায়ে পৌঁছে যেতে পারে।
গুরুতর ব্যধি যেমন প্যারালাইসিস, স্ট্রোক, ইত্যাদির ফলে কোনও অঙ্গ কাজ করা বন্ধ করে দিতে পারে।
মস্তিস্কে আঘাত বা ভিতরের রক্তপাতের কারণে কোমা বা মস্তিস্কের মৃত্যু হতে পারে।
অন্য কোন সমস্যাও হতে পারে যাতে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা খুব কম।