পরিচর্যার কাজে কেন মহিলাদের একার দায়িত্ব কমানো প্রয়োজন

পরিচর্যার কাজে কেন মহিলাদের একার দায়িত্ব কমানো প্রয়োজন

Published on

সমাজে একটা বদ্ধমূল ধারণা প্রচলিত রয়েছে যে পুরুষরা অর্থ উপার্জন করে সংসার প্রতিপালন করবে আর মহিলারা ঘর-গৃহস্থালি ও পরিচর্যার কাজ করবে। ওইসিডি (OECD) অনুযায়ী, এই চিরাচরিত নিয়মটি আজও বাস্তবে চালু রয়েছে যেখানে পৃথিবীর সর্বত্র মহিলারা পুরুষদের চাইতে দশ গুণ বেশি সময় ব্যয় করে অবৈতনিক কাজে অর্থাৎ পরিবার-পরিজনের পরিচর্যার দায়িত্ব পালনে। যদি পরিবারের কোনও সদস্য অসুস্থ হয় বা অক্ষম হয় তাহলে তার পরিচর্যার দায়িত্ব মূলত পরিবারের মহিলাদের উপরেই এসে পড়ে। এটাই সমাজের স্বাভাবিক দৃষ্টিভঙ্গি হয়ে উঠেছে। আমাদের গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে ভারত ও নেপালের মতো দেশে পারিবারিক পরিচর্যাকারীদের ৮৪ শতাংশ হল মহিলা। আমাদের ধারণা এই গবেষণার কাজ যত এগোবে তত সংখ্যাটা ৮৪ থেকে ৯০ শতাংশে গিয়ে দাঁড়াবে।  

আপাতভাবে পরিচর্যার কাজটি মূলত মহিলাদের দ্বারাই করা হয়ে থাকে। লিঙ্গ- বৈষম্যের কারণে সমাজ তথা পরিবারে মহিলারা পুরুষদের তুলনায় অনেক কম মাত্রায় মানবাধিকার ভোগ করতে সক্ষম হয়। এক্ষেত্রে দরিদ্র পরিবারের মেয়েরা তথাকথিত বিত্তবান পরিবারের মেয়েদের চেয়ে অনেক বেশি সময়ে ধরে বিনা পারিশ্রমিকে পরিচর্যার কাজে নিযুক্ত থাকে এবং ক্ষতিগ্রস্তও হয় বেশি পরিমাণে। মহিলাদের জীবনে পরিচর্যার কাজের প্রভাব নিম্নলিখিত ক্ষেত্রগুলোতে পড়তে
দেখা যায়-

শিক্ষা

গৃহস্থালির কাজ তথা পরিচর্যার দায়িত্ব সামলাতে গিয়ে পরিবারের মেয়েরা তাদের লেখাপড়া, নিজস্ব কাজকর্ম এবং অল্পবয়সে প্রিয়জনের সঙ্গে মেলামেশার ক্ষেত্রে অনেক কম সময় পায়। কিন্তু একই পরিস্থিতিতে পরিবারের ছেলেরা নিজেদের লেখাপড়ার প্রতি অনেক বেশি মনোযোগ দিতে পারে। প্রায়শই পারিবারিক দায়দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে শিক্ষাগত যোগ্যতার দিক থেকে বাড়ির মেয়েরা  ছেলেদের তুলনায় অনেক পিছিয়ে পড়ে। এই ঘটনার চরম পরিণতি হিসেবে পরিবারের অল্পবয়সি মেয়েরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা পরিচর্যার কাজে নিযুক্ত থাকার জন্য লেখাপড়া একেবারে ছেড়ে দিতেই বাধ্য হয়।

কর্মসংস্থান এবং অর্থনৈতিক নিরাপত্তা

পরিবারের সদস্যদের পরিচর্যা একপ্রকার অবৈতনিক কাজ। পরিবারের মহিলারা প্রায়শই পরিবারের কোনও সদস্যের পরিচর্যার দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে চাকরি বা অন্য কাজ করে অর্থ উপার্জন করতে সক্ষম হয় না। ফলে তাদের অর্থনৈতিক সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। এক্ষেত্রে গৃহস্থালির নানারকম কাজকর্ম সামলানোর জন্য তাদের পরিবারের পুরুষদের রোজগারের উপরেই নির্ভর করতে হয়। এই পরিস্থিতিতে পরিবারে মতামত দান বা অন্যান্য ক্ষেত্রে মহিলারা 'দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক' হিসেবেই বিবেচিত হয়ে থাকে। এছাড়া লিঙ্গ-বৈষম্যের কারণে মহিলারা জীবনে বেঁচে থাকার ক্ষেত্রে স্বাধীনতাও পায় না। যখন সমাজে কোনও মহিলা পরিচর্যাকে জীবিকা হিসেবে বেছে নিয়ে অর্থ উপার্জন করতে সক্ষম হয় তখন ইউনাইটেড নেশন জেনারেল অ্যাসেম্বলি-র মতে তা হয় ''খুব সামান্য মজুরির, অনিশ্চিত, নিরাপত্তাহীন একপ্রকার কাজ। সেই সঙ্গে এরকম ঝঞ্ঝাটের কাজ করতে  গিয়ে মানুষের স্বাস্থ্যজনিত ঝুঁকি দেখা দেয় ও তার শারীরিক সুস্থতার প্রশ্নটিও বড় হয়ে ওঠে।''

সামাজিক পরিসরে অংশগ্রহণ

অত্যধিক ঘরের দায়িত্ব এবং পরিচর্যার কাজ সামলাতে গিয়ে পুরুষদের চাইতে মহিলারা সামাজিকতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে অনেক কম সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারে। সামাজিক নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে মহিলাদের অংশগ্রহণ কম থাকার জন্য সমাজের ভালো-মন্দ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রেও মহিলাদের মতামত তেমনভাবে গুরুত্ব পায় না। ইউনাইটেড নেশন জেনারেল অ্যাসেম্বলির বক্তব্য অনুযায়ী, যে  গোষ্ঠী অবৈতনিক পরিচর্যার দায়িত্ব পালন করে তারা অত্যন্ত নিম্নমানের জন-পরিষেবা পেয়ে থাকে। অন্যভাবে বলতে গেলে বলতে হয় মহিলারা এহেন কাজের সঙ্গে বেশি যুক্ত থাকার ফলে সামাজিক পরিসরে তারা সক্রিয় থাকে না। এমনকী মহিলাদের সামাজিক মেলামেশার ক্ষেত্রে অতিরিক্ত সময় ব্যয় করার তাগিদও সমাজ অনুভব করে না। এর ফলে মহিলারা তাদের জীবনের আশা, আকাঙ্ক্ষা, চাহিদা বিসর্জন দিয়ে পরিচর্যার মতো দায়িত্ব পালনে নিজেদের দায়বদ্ধতা বজায় রাখতে সচেষ্ট হয়ে ওঠে।

পরিচর্যা এবং গৃহস্থালির দায়িত্ব পালনে লিঙ্গ-বৈষম্য দূর করার জন্য রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় শর্ত হল স্বাস্থ্যকর সমাজ গঠনের ক্ষেত্রে পরিচর্যার কাজটিকে অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি জানানো। পরিচর্যাকারীরা যাতে অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন হয়ে উঠতে পারে এবং সামাজিক পরিসরে যাতে তাদের অংশগ্রহণ বাড়ে সেজন্য রাষ্ট্রের উচিত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এছাড়া পরিচর্যার দায়িত্ব থেকে একা মেয়েদের অব্যাহতি দিয়ে সেই দায়িত্ব পুরুষ-মহিলা দু'জনের মধ্যেই ভাগ করে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। এভাবে দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে সমাজে লিঙ্গ-বৈষম্যের ধারণাটি কিছুটা হলেও দূর করা সম্ভব হবে।

প্রবন্ধটি লিখেছেন কেয়ারার্স ওয়ার্ল্ডওয়াইডের প্রতিষ্ঠাতা এবং কার্যনির্বাহী ডিরেক্টর ডাক্তার অনিল পাটিল এবং সংস্থার স্বেচ্ছাসেবক কর্মী রুথ পাটিল। এই সংস্থাটি পারিবারিক স্তরে অবৈতনিক পরিচর্যাকারীদের সমস্যা নিয়ে কাজ করে। ২০১২ সালে প্রতিষ্ঠিত সংস্থাটি নথিবদ্ধ হয় ব্রিটেনে। উন্নয়নশীল দেশের পরিচর্যাকারীদের স্বার্থ দেখাই এই সংস্থার প্রধান কাজ। আরও তথ্য জানার জন্য আপনি Carers Worldwide লগ অন করতে পারেন। তাছাড়া এই ঠিকানায় যোগাযোগ করা যাবে- columns@whiteswanfoundation.org .          

logo
হোয়াইট সোয়ান ফাউন্ডেশন
bengali.whiteswanfoundation.org