প্রশ্নোত্তরঃ স্কিৎজোফ্রেনিয়া রোগীর যত্ন
স্কিৎজোফ্রেনিয়ার চিকিৎসা কী আদৌ সম্ভব?
যে কোনও মানসিক রোগের মতনই স্কিৎজোফ্রেনিয়ারও চিকিৎসা সম্ভব, এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্বাভাবিক জীবন যাপনও সম্ভব। পরিবার পরিজনের সাহায্যে, সঠিক চিকিৎসায় এবং সুস্থ রুটিন মেনে চললে অন্যান্য অসুখের মত একেও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
রিচমন্ড ফেলোশিপ সোসাইটির ব্যাঙ্গালোর শাখার সিইও এবং এমডি ডাঃ এস কল্যাণসুন্দরম বলছেন, “হিসেব মত এক তৃতীয়াংশ স্কিৎজোফ্রেনিয়ার রোগী স্বাভাবিক জীবন যাত্রায় ফেরেন। এক তৃতীয়াংশ মোটামুটি সন্তোষজনক জীবন কাটান। বাকি এক তৃতীয়াংশ প্রায় অন্যের ওপর নির্ভরশীল জীবন কাটান। এটা পুরোটাই নির্ভর করছে কবে রোগ ধরা পড়ছে তার ওপর। যত তাড়াতাড়ি রোগ ধরা পড়বে তত বেশী সেরে ওঠার সম্ভাবনা থাকবে।”
যিনি যত্ন নেবেন তাঁর ভূমিকা ঠিক কী?
চিকিৎসার অভাবে স্কিৎজোফ্রেনিয়া ভয়াল রূপ ধারণ করতে পারে। যেহেতু তাঁদের পক্ষে নিজের অস্বাভাবিক চালচলন বোঝা সম্ভব নয়, তাঁর পরিবারের উচিত এই ক্ষেত্রে সাহায্য করা।
রোগের প্রাথমিক উপসর্গ হিসেবে অকারণে মেজাজ খিঁচড়ে থাকা, ক্ষুধামন্দ, অনিদ্রা, অকারণে হাসা, মনঃসংযোগের অভাব, অপরিচ্ছন্নতা ইত্যাদি দেখা যায়।
মনে রাখবেন আপনার প্রিয়জনের মধ্যে কোনও সমস্যা থাকা মানেই স্কিৎজোফ্রেনিয়া নয়। লম্বা সময় জুড়ে এর মধ্যে একাধিক সমস্যা দেখা গেলে তবেই মাথা ঘামানো প্রয়োজন। এমনও হতে পারে যে তাঁর অন্য কোনও মানসিক সমস্যা আছে।
ডাক্তারের সাথে কীভাবে সহযোগিতা করব? রোগ নির্নয়ের সুবিধার্থে আমার তাঁকে ঠিক কতটা বলা উচিত?
শারীরিক সমস্যার তুলনায় মানসিক রোগ নির্নয় করা খুবই কঠিন। এই ক্ষেত্রে চিকিৎসক এক্স-রে বা ব্লাড রিপোর্ট দেখে কিছু বলতে পারেন না। রোগীর আচার আচরণ পর্যবেক্ষন করে তাঁকে একটা সিদ্ধান্তে আসতে হয়।
স্কিৎজোফ্রেনিয়া রোগীদের বিচার শক্তি নষ্ট হয়ে যায়। কাজেই তাঁর চালচলন সম্বন্ধে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ চিকিৎসককে দেওয়া বাড়ির লোকের অবশ্য কর্তব্য।
সেইজন্য ডাক্তারের কাছে কিছু লোকাবেন না। এটা তাঁর পেশা এবং সমস্ত তথ্যাদি গোপন রাখতে তিনি বাধ্য। আপাতদৃষ্টিতে অবাঞ্ছিত মনে হলেও আপনার পরিবারের গোপন তথ্যাদি থেকে কিন্তু এই অসুখের মূল কারণ খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। মনে রাখবেন ডাক্তারের উদ্দেশ্য আপনাদের মঙ্গলকামনা, পরিবারের কুৎসা রটানো না।
রোগ পরীক্ষার সময় আমার কী কী জানা উচিত?
- কোন কোন উপসর্গের ভিত্তিতে উনি রোগ নির্ণয় করেছেন।
- রোগ ধরা পড়লে পরে আপনার প্রিয়জনের ভবিষ্যৎ কি?
- দ্রুত আরোগ্যলাভের জন্য তাঁর ঠিক কী কী সহায়তার প্রয়োজন?
- কাউন্সেলিং এবং ওষুধের প্রয়োজনীয়তা কতটা?
- রোগীর যত্ন নেবার জন্য তাঁর সাথে কী সর্বক্ষণ কাউকে রাখা দরকার?
- কতদিন পর্যন্ত চিকিৎসা চলতে পারে?
- কোনও বিপদ সংকেত আছে?
- কী কী ওষুধ দেওয়া হচ্ছে? সেগুলো কবে নাগাদ কাজ শুরু করবে?
- যদি উনি ওষুধ না খেতে চান?
- পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে কোন? সেই ক্ষেত্রে আপনি কী করবেন?
- উনি ওষুধ খাচ্ছেন কি না কী করে দেখবেন?
আমি আমার প্রিয়জনকে কীভাবে চিকিৎসার জন্যে রাজি করাব? আমি কী জোর করতে পারি?
স্কিৎজোফ্রেনিয়া রোগীর পক্ষে নিজের ভালমন্দ বোঝা সম্ভব নয়। উনি যদি নিজে থেকে রাজি হন তাহলে খুবই ভাল। তাঁকে বোঝান যে তাঁর চালচলনের পরিবর্তনের কারণে আপনি চিন্তিত। যদি আপনি তা না পারেন তবে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের সাহায্য নিন। স্কিৎজোফ্রেনিয়ার মারাত্মক পর্যায়ে রোগীর রাগ, ভয় এবং বিভ্রম দেখা দিতে পারে। পরিবারের কিছু লোকজনের কথা তাঁরা শুনতে আপত্তি করতে পারেন। চিকিৎসার সদিচ্ছাকে তাঁরা পাগল সাজানোর ষড়যন্ত্র মনে করতে পারেন। সেই ক্ষেত্রে রোগী বিশ্বাস করেন এইরকম কাউকে দিয়ে বোঝানোর ব্যবস্থা করা গেলে ভাল। তবে যদি দেখা যায় উনি নিজের বা অন্যের ক্ষতি করার চেষ্টা করছেন সেইক্ষেত্রে তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধেও ভর্তির ব্যবস্থা করা যায়।
আমি আমার প্রিয়জনের কাল্পনিক বিভ্রান্তি কী করে ভাঙ্গাব?
প্রথমত জোর করে তাঁকে কিছু বোঝানোর চেষ্টা করবেন না। কারণ তাঁর কাছে কিন্তু পুরোটাই সত্যি। উনি যে কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছেন সেই ব্যাপারে তাঁর প্রতিক্রিয়া কী? উদাহরণ স্বরূপ আপনি জিজ্ঞেস করুন, “যখন ওই কণ্ঠস্বরগুলো বলে....., তখন আপনি কী ভয় পান?”
জানতে চান তাঁরা অন্যত্র ভাল বোধ করেন কি না? তাঁদের সাথে একটু হাঁটতে গেলে বা অন্য কাজে সাহায্য করলে কী তাঁর ভাল লাগবে? কিছু করতে না চাইলে তাঁদের একটা শান্ত ঘরে নিয়ে যান। তাঁকে চাঙ্গা করতে গিয়ে বাড়াবাড়ি করে বসবেন না।
রোগীর থেকে জানতে চান যে কিসের থেকে এইসবের সূত্রপাত হয়? কোন পরিস্থিতিতে এগুলি কমে যায়? সেই গলার আওয়াজগুলো কী তাঁকে কিছু করার নির্দেশ দেয়? যদি তাই হয় তবে তাঁকে একলা ছাড়াটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।
অনেক সময় এইরকম পরিস্থিতিতে ব্যক্তি নিজেকে শেষ করে দেবার কথা ভাবেন। প্রচলিত একটি ভুল ধারনা হল যে এই ব্যাপারে বেশী জিজ্ঞেস করলে উনি এই কাজে উৎসাহিত হন। ওনার থেকে এই ব্যাপারে জানার চেষ্টা করুন। খেয়াল রাখুন উনি ঘরে বিষাক্ত কিছু খুঁজছেন কি না।
এইরকম পরিস্থিতিতে ডাক্তার ঘুম পাড়ানোর ওষুধ দিতে পারেন। শুধুমাত্র জরুরি অবস্থায় তা ব্যবহার করুন।
যদি উপসর্গে কোনও পরিবর্তন দেখেন তাহলে কী করবেন?
এই রকম পরিস্থিতিতে তৎক্ষণাৎ সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। মনে রাখবেন সময়ের সাথে সাথে কিন্ত এই রোগের উপসর্গ বৃদ্ধি পাবে। অনেক সময় ওষুধ না খাবার জন্যে এই সমস্ত সমস্যা দেখা দেয়। সেই ক্ষেত্রে উনি ঠিকমত ওষুধ খাচ্ছেন কি না তা খেয়াল রাখা অত্যন্ত জরুরী।
মনে রাখবেন কোনও ওষুধেই রাতারাতি পরিবর্তন সম্ভব নয়। ওষুধের ওপর নির্ভর করে কয়েক দিন এমনকি কয়েক সপ্তাহ অবধি লাগতে পারে। তবু আনুমানিক সময় জানার জন্য চিকিৎসকের সঙ্গে আলোচনা করুন।
উপসর্গ নিয়ন্ত্রণে এলেও কি ওষুধ খাওয়া চালিয়ে যেতে হবে?
উপসর্গ কমার সাথে সাথে ওষুধ খাওয়া বন্ধ করে দেওয়াটা এক বদভ্যাস। ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কখনও ওষুধ বন্ধ করা উচিত নয়। কারণ ওষুধের জন্যই উপসর্গগুলি নিয়ন্ত্রণে থাকে। কাজেই সেগুলো অকস্মাৎ বন্ধ করা হলে সমস্যার পুনরাবৃত্তি ঘটা অবস্বম্ভাবি। তেমন হলে পরে কিন্তু রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।
অনেকে মনে করেন এই সমস্ত ওষুধে নেশা হয়ে যায়। এবং প্রচুর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও দেখা যায়। সেই ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে যে আপনার ডাক্তার কিন্তু উভয় পরিস্থিতি বিচার করে আপনার মঙ্গলের জন্যেই সেই ওষুধটা দিয়েছেন।
পুনরাবৃত্তি হচ্ছে কিনা কী করে বুঝব?
লক্ষ রাখুন যে ওষুধ সেবনের আগের উপসর্গগুলি আবার দেখা দিচ্ছে কিনা?
রোগীর পুরানো জীবন ফিরিয়ে দেওয়া কতটা জরুরি?
একজন স্কিৎজোফ্রেনিয়া রোগীর পক্ষে তাঁর জীবনের পুরনো ছন্দে ফিরতে পারাটা খুবই জরুরি। কারণ বাহ্যিক ব্যবহার বাদ দিলে আপাতদৃষ্টিতে এই রোগ অদৃশ্য।
সঠিক ওষুধের প্রভাবে রোগীর আপত্তিজনক চালচলনগুলি হ্রাস পায়। কিন্তু তা সত্ত্বেও অসুখের অভিজ্ঞতা থেকে তাঁর মনে যে কুণ্ঠা বা ভয় তৈরি হয়, তা কাটিয়ে ওঠা সময়সাপেক্ষ। তাঁর জন্যে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ প্রয়োজন।
এই প্রশিক্ষা চলাকালীন ব্যক্তিকে তাঁর পরিবারের বাইরের লোকজন যেমন ডাক্তার বা হাসপাতালের অন্যান্য চিকিৎসাধীন ব্যক্তির সাথে বাক্যালাপ করার উৎসাহ যোগানো হয়।
স্কিৎজোফ্রেনিয়া রোগীরা কী বিবাহযোগ্য?
দুর্ভাগ্যবশত আমাদের দেশে অনেকেই এখনো বিয়েকে মানসিক ব্যধির চিকিৎসা মনে করেন। আপাতদৃষ্টিতে রোগীর উপসর্গ যদি নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং তাঁর জীবনসঙ্গী যদি রোগ সম্বন্ধে যথেষ্ট জানেন তবে এক সুস্থ দাম্পত্য জীবন কাটাতে কোনও অসুবিধা হবার কথা নয়। বরঞ্চ অসুখের কথা গোপন করে জবরদস্তি বিয়ে দেওয়া হলে, ভবিষ্যতে প্রচুর সমস্যা দেখা দিতে পারে। বিয়ের আগে রোগীকে
- শারীরিক এবং মানসিক ঘনিষ্টতা সম্পর্কে স্পষ্ট ভাবে বুঝিয়ে বলুন।
- আর্থিক এবং গৃহস্থালি কর্তব্য সম্বন্ধে তাঁকে বোঝান।
বিয়ের জন্য রোগীর স্বামীর/স্ত্রীর কী কী মাথায় রাখা উচিত?
- রোগী তাঁর জীবনসঙ্গীকে কতটা বিশ্বাস করেন।
- সম্পত্তি সামলাতে গিয়ে কী কোন আইনি ঝামেলায় জড়াতে পারেন?
- দাম্পত্য যৌনজীবনে কী রোগীর ওষুধগুলোর কোনও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে?
- ভবিষ্যতে সন্তানেরও কী এই রোগের আশঙ্কা আছে?
- জীবনসঙ্গী কি রোগীর যাবতীয় দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত?
স্কিৎজোফ্রেনিয়া রোগীদের একলা হতে দেবেন না। তাঁদের সাথে স্বাভাবিক ব্যবহার করুন।
চিকিৎসা চলাকালীন সময়টা রোগী এবং যিনি তাঁর যত্ন নিচ্ছেন, উভয়ের পক্ষেই এক কঠিন সময়। নিজের প্রিয়জন যখন আপনাকে সন্দেহ করবে, আপনার সাথে দুর্ব্যবহার করবে, ঠিকমত ওষুধ খাবে না – তখন আপনার মনে হতাশা আসা খুবই স্বাভাবিক।
মনে রাখবেন অসুখ ছাড়াও সেই মানুষটির ভেতর অনেক কিছু আছে। নিজের নামের সাথে এই রোগটা চিরকালের মতন জুড়ে যাওয়াটা খুবই কষ্টের যা তাঁকে নিজের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলতে বাধ্য করবে। সেইক্ষেত্রে তাঁকে যথার্থ সম্মান ও মর্যাদার সাথে নিজের আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে দেওয়াটা খুবই জরুরি। নিম্নলিখিত উপায়ে আপনি খুব সহজেই তা করতে পারেন।
- পরিবার সংক্রান্ত যেকোন সিদ্ধান্ত নেবার আগে তাঁর পরামর্শ নিন। হয়ত তিনি সঠিক পরামর্শ দিতে পারবেন না, কিন্তু এতে নিজের পরিবারের প্রতি আপনত্ব বজায় থাকে।
- আমাদের দেশে সাধারণত লোকলজ্জার ভয়ে মনোরোগীদের সমাজ থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়। এর ফলে তাঁদের মনে রাগ জমে। তারপর যখন তা সামনে আসে তখন আমরা পাগল বলে আরও দূরে সরিয়ে রেখে দেই। দায়িত্ব সহকারে বরং তাঁদের সমাজে মিশতে সাহায্য করুন।
- কোনও কিছু লোকাবেন না। আপনি হয়ত তাঁকে মানসিক আঘাত না দেবার জন্যে কোনও খারাপ খবর বললেন না, কিন্তু সেটা অন্য জায়গা থেকে জানতে পারলে উনি আরও কষ্ট পাবেন। আপনি কীভাবে বলবেন তা জানার জন্যে মনোবিদের পরামর্শ নিতে পারেন
অন্যান্য স্কিৎজোফ্রেনিয়া রোগীদের পরিবারের সাথে যোগাযোগ রাখুন
স্কিৎজোফ্রেনিয়ার মত কিছু মানসিক রোগের জন্য আজীবন চিকিৎসা ও যত্নের প্রয়োজন যা তাঁর পরিবারের লোকজনদের জন্যে ক্লান্তিকর। সেই জন্যে আপনার মত অন্যান্য পরিবারের পাশে দাঁড়ালেঃ
- আপনি এবং আপনার প্রিয়জন বুঝবেন যে আপনারা একা নন।
- রোগীর সাথে কীভাবে চলবেন তা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারনা পাবেন।
- অসুখ সম্বন্ধে একটা পরিষ্কার ধারনা তৈরি হবে।
আমার প্রিয়জনের অসুখের কথাটা সমাজে কীভাবে বলব?
সবার আগে আপনি নিজে বুঝুন যে এই অসুখের জন্যে আপনার প্রিয়জন নিজে দায়ী নন। তাহলে দেখবেন আপনার কথা বলতে সুবিধা হবে।
কেউ যদি আপনার প্রিয়জনের সমস্যা নিয়ে কোনও প্রশ্ন করে বা কোনও কটূক্তি করে তবে উত্তেজিত হবেন না। মনে করুন জ্বর-সর্দি-কাশির মত তাঁরা একটা অসুখ সম্পর্কে জানেন না। তাঁদের বলুন যে মস্তিষ্কে কিছু পদার্থের সামঞ্জস্যের অভাবে এটা যে কোনও লোকের হতে পারে। এইভাবে বললে আপনি নিজের, রোগীর এবং সমাজের সবাইকেই পরিস্থিতি বুঝতে সাহায্য করতে পারবেন।