পরিচর্যাকারীদের কি রোজনামচায় যোগাসন রাখা উচিত?
মানস ভট্টাচার্যের দিন শুরু হয় ভোর ৫.৩০ টায়। তাড়াতাড়ি প্রোটিন শেক খেয়ে তিনি কলকাতায় তাঁর বাড়ির কাছে একটা জিমে যান। তাঁর এক ঘণ্টার অনুষ্ঠান কিছু হাল্কা ওয়েট লিফটিং, লাঠি নিয়ে কিছু ব্যায়াম ও বেশ কিছু যোগাসন নিয়ে গঠিত। “এটা খুব ভালো ব্যায়ামের সংমিশ্রণ, যা আমার শরীরকে সুস্থ রাখে” বললেন আশি-উর্দ্ধ বৃদ্ধ, যিনি ভারতীয় রেল থেকে অবসর নিয়ে বর্তমানে অ্যামওয়ের ডিস্ট্রিবিউটর হিসাবে কাজ করছেন।
ভট্টাচার্য্যবাবুই তাঁর ৪৫ বছরের ছেলে পিনাকীর একমাত্র দেখাশনাকারী। ১৯৯৩ সালে পিনাকীর স্কিৎজোফ্রেনিয়া ধরা পরে। “সে একদিন বাড়ী ফিরে নিজেকে ঘরে আবদ্ধ করে রাখল এবং সারা দিনে আর ঘর থেকে বার হল না। সে কস্টিং-এর পরীক্ষাতে ফেল করল”, জানালেন শ্রী ভট্টাচার্য্য, যিনি স্মৃতিচারণ করেছিলেন সেই বিষয়ে যখন তিনি ও তাঁর পরিবার, ছেলের ব্যবহারে প্রথম বিপদের গন্ধ পান। “ও বলল যে ও কারুর গলার আওয়াজ শুনতে পারছে”, উনি বললেন। সেই থেকে তিনি ও তাঁর স্ত্রী তাঁদের জীবন ছেলেকে দেখাশোনার কাজেই উৎসর্গ করেন। “গত বছর আমার স্ত্রীর মৃত্যুর পর একমাত্র আমিই আছি”, আমাদেরকে জানান ভট্টাচার্য্যবাবু, যিনি সাইকিয়াট্রিস্টদের সাথে পরামর্শ করার জন্য ব্যাঙ্গালুরুর নিমহ্যান্সে এসেছিলেন।
তিনি সফলভাবে তাঁর নিজের ছেলের পরিচর্যা করার ক্ষমতার জন্য নিজের সুস্থ থাকার চাবিকাঠি, অর্থাৎ নিয়মিত ব্যায়াম করাকেই কৃতিত্ব দেন। “আমি বিশ্বাস করি যে, একজন মানুষকে সঠিক পরিমাণ খাবার, ঘুম, ব্যায়াম ও বাস্তববাদী মনোভাব অবশ্যই রাখতে হবে”, তিনি আরও বললেন। “যোগাসন অবশ্যই আমার মানসিক দিক থেকে ভালো থাকতে সাহায্য করেছে আর এর ফলেই আমি আমার এই বাস্তববাদী মনোভাব অর্জন করেছি”।
নিমহ্যান্স দ্বারা আয়োজিত মানসিক রোগীদের পরিচর্যাকারীদের ওপর যোগাসনের বাস্তবিক প্রভাব নিয়ে যে পর্যবেক্ষণ চলে তাকে ভট্টাচার্য্যবাবুর জীবনের মন্ত্র দৃঢ়তা প্রদান করে।
এই পর্যবেক্ষণের প্রাথমিক পর্যায়ে পরিচর্যাকারীদের প্রয়োজনের ওপর প্রশ্নোত্তর পর্ব চলে। রোগীর বিভিন্ন লক্ষণকে (ডিলিউসন, প্যারানইয়া ও প্যানিক অ্যাটাক) সামলানোর জন্য প্রধানতঃ কি কি প্রয়োজন, এর পরে পরেই আসে রোগীর সামাজিক ও চাকরির দিকটা (যা হল তাঁদের কাজকে কিভাবে রক্ষা করা যায়, কিভাবে রোজকার কাজ ঠিক মত করা যায়) সামলানো, এরপর শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য, যার সাথে সাথে আসে রোগীর বৈবাহিক ও সেক্সুয়াল (যৌন বিষয়ক) অসুবিধাগুলো সামলানো।
“স্বাস্থ্য হল তাদের তৃতীয় প্রয়োজন এবং আমরা সবাই জানি যে, যদি আমরা সুস্থ থাকি ও ভালো স্বাস্থ্যের অধিকারী হই, তাহলে আমরা অন্য ব্যক্তির প্রয়োজনের খেয়াল রাখতে পারব। অনেক পরিচর্যাকারী হয়তো বা স্ট্রেস্ বা চাপের জন্য জীবনযাত্রার অসামঞ্জস্যতা (লাইফ স্টাইল ডিস্অর্ডার) জনিত রোগ যেমন ডায়াবিটিস্, হাইপার টেনশন এগুলোতে ভোগেন। এই সবই ধ্যান ও যোগাসনের দ্বারা সামলানো যায় কিন্তু আমরা সেদিকে লক্ষ্যই করি না। আমাদের লক্ষ্য থাকে বোঝা সামলানোর দিকে এবং কিভাবে মানসিক অসুস্থ ব্যক্তির দেখাশোনা করার স্ট্রেস্ বা চাপের সাথে মানিয়ে নেওয়া যায়,” বলেন ডাঃ আরতি জগন্নাথন্, নিমহ্যান্সের সাইকিয়াট্রিক সোশ্যাল ওয়ার্ক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক, যিনি এই অধিবেশন, যা নিমহ্যান্স ও স্বামী বিবেকানন্দ যোগা অনুসন্ধান সংস্থান যুগ্মভাবে আয়োজন করেছিল, তার নেতৃত্বে ছিলেন।
যোগাসন, প্রাণায়াম ও ধ্যান এই তিনের সংমিশ্রণে মানসিক রোগীদের পরিচর্যাকারীদের প্রয়োজনের কথা মাথায় তৈরী করা হয় একটা বিশেষ মডিউল। পরিচর্যাকারীদের বোঝা বলতে এক গুচ্ছ স্ট্রেস্ বা চাপ কে বঝান হয় যা তাঁরা শারীরিক বা মানসিক ভাবে অসুস্থ ব্যক্তিদের দেখাশোনা করতে গিয়ে অনুভব করেন।
যোগের একটা আন্তর্জাতিক জার্নালে ডাঃ জগ্ননাথান্ লিখেছেন যে, “যোগের অনুষ্ঠানের সর্বত্তম লক্ষ্য হল রোগীদের পরিচর্যাকারীদের বোঝা কমানো, তা সে তাঁদের প্রয়োজনের বিষয়ে আলোচনা করেই হোক আর কোন যোগাসনের কার্যক্রম, যা তাঁদের নিজেদের সামর্থ্য ও দক্ষতার দ্বারা চাপ বা স্ট্রেস্কে কমাতে সাহায্য করে, আবার তাঁদের প্রয়োজনও মেটাবে, তার সৃষ্টির মাধ্যমে। যেহেতু সকল প্রয়োজনের উত্তর এক এক করে যোগ শিক্ষার দ্বারা দেওয়া সম্ভব নয়, আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত চাপ বা বোঝা বা স্ট্রেস্ কমানো, আলোচিত প্রয়োজন মেটানো নয়”।
যে মডিউলটা তৈরী করা হয় তা নিমহ্যান্সের থাকা নয় জন রোগীর পরিচর্যাকারীদের ওপর পরীক্ষা করা হয়। এক মাস যোগাভ্যাস করার পর, বেশীরভাগ প্রতিযোগীই মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ও চাপ বা বোঝার সাথে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা বাড়ার কথা জানান। যদিও এই পরীক্ষার মান নির্ণয়ের জন্য শুধুমাত্র স্কিৎজোফ্রেনিয়ার রোগীদের পরিচর্যাকারীদের ওপরই করা হয়, গবেষকরা বিশ্বাস করেন যে, অন্যান্য মানসিক রোগীদের যাঁরা দেখাশোনা করেন তাঁদের ক্ষেত্রেও এই পরীক্ষার ফলের খুব একটা তারতম্য ঘটবে না।
এই পরীক্ষার ফলস্বরূপ এটাও দেখা গেছে যে রোগীর আবেগপ্রবণতার সাথে পরিচর্যাকারীদের চাপ বা বোঝার একটা সরাসরি সম্পর্ক আছে। “আমরা যাকে পজিটিভ অ্যান্ড নেগেটিভ সিম্পটম স্কেল (পি এ এন এস্ এস্) বলি তাতে এই বিষয়ে পরীক্ষা করা হয়েছে। যদি এর পয়েণ্ট বেশী হয় তাহলে এর অর্থ হল রোগী খুবই আবেগপ্রবণ। আমরা এটা দেখেছি যে, পি এ এন্ এস্ এস্ এর মান যদি বেশী থাকে তাহলে, চাপ বা বোঝাটাও বেশী হয়,” জানালেন ডাঃ জগন্নাথন্।
পরিচর্যাকারীদের ওপর যোগের একটা বিশাল প্রভাব আছে সেটা প্রমান করার পরেও গবেষকরা এটাও লক্ষ্য করেছেন যে, সব সময় যোগাসনের শিক্ষা লাভ করা সব পরিচর্যাকারীদের পক্ষে সম্ভব নয়। তাঁরা পছন্দ করেন শারীরিক সমস্যার তাড়াতাড়ি সমাধান এবং তাঁরা প্রায়ই মানসিক সুস্থতার দিকটা নিয়ে ভাবেন না।
এই সব অসুবিধাগুলি নিয়ে কাজ করতে গিয়ে ডাঃ জগন্নাথন্ এটাই সুপারিশ করেন যে যাঁরা ব্যাঙ্গালুরুতে গিয়ে নিমহ্যান্সের যোগ শিক্ষা কেন্দ্রে যেতে পারছেন না তাঁরা যেন অবশ্যই কাছাকাছি কোন যোগ শিক্ষা কেন্দ্রে যোগ দেন অথবা কোন যোগ্য যোগাভ্যাসকারীর ভিডিও অনুসরণ করেন। “এটা সবারই জানা যে যদি কিছু না করার থাকে, যোগাভ্যাস মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপযোগী”, তিনি বলেন।