অটিজম
অটিজম কী?
অটিজম একটি নিউরোলজিকাল বা স্নায়বিক সমস্যা যাতে আমাদের মস্তিষ্কের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। এর ফলে রোগী কথা বলতে বা বুঝতে, নতুন জিনিস শিখতে এবং সমাজে চলতে অসীম সমস্যার সম্মুখীন হন।
অটিজমকে আমরা সাধারণত একটি স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার বলে থাকি কারণ এর উপসর্গ নানারকম হতে পারে এবং ক্ষেত্রবিশেষে একসাথে হতে পারে। একইসঙ্গে এই রোগের প্রভাব ব্যক্তি-বিশেষে আলাদা আলাদা হয়ে থাকে। কোন শিশু হয়ত সামান্য সাহায্য পেলেই স্বাধীনভাবে সব কিছু করতে পারে, আবার কেউ হয়তো সম্পূর্ণ রূপে অন্যের ওপর নির্ভরশীল হয়।
আগে এক একটি রোগের (অটিস্টিক ডিস্অর্ডার, পার্ভেসিভ ডেভেলাপমেন্টাল ডিসঅর্ডার, এনওএস, অ্যাসপার্গার্স সিন্ড্রোম) আলাদা আলাদা ভাবে চিকিৎসা হত। কিন্তু এখন এই সব কিছুকেই অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার হিসেবে ধরা হয়।
জানেন কি?
বাড়ন্ত বয়সের সাধারণ অসুখগুলোর মধ্যে অটিজমের স্থান তৃতীয়।
প্রতি ২৫০ শিশুর মধ্যে একজনের অটিজম হবার সম্ভাবনা থাকে।
অটিজম সারে না।
অটিজমের উপসর্গ কী?
এই রোগের উপসর্গ বাচ্চার ৩ বছর বয়সের মধ্যেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ক্ষেত্র বিশেষে সেই উপসর্গ কম কিংবা বেশী হতে পারে। এবং এক একজন শিশুর এক এক রকমের উপসর্গ হতে পারে। অনেক সময় এর থেকে আপনার বাচ্চার এপিলেপসিও হতে পারে। অটিজম হয়ে থাকলে নিম্নলিখিত উপসর্গগুলি দেখা যেতে পারে।
কোন কোন শিশুর ক্ষেত্রে অটিজমের পাশাপাশি বুদ্ধিগত প্রতিবন্ধকতা, মোটর নার্ভে সমস্যা, অন্ধত্ব বা বধিরতা এবং অতিরিক্ত চঞ্চলতাও দেখা যেতে পারে।
অটিজম থাকলে কথাবার্তা বলতে গিয়ে শিশুদের সমস্যা দেখা দিতে পারে।
যথেষ্ট শব্দভাণ্ডার থাকা সত্ত্বেও অর্থবহ বাক্য রচনা না করতে পারা।
বার বার একই শব্দ বা বাক্য বলা।
একই কাজ বার বার করতে থাকা।
কথা বলার সময় ইশারা ইঙ্গিতের সাহায্য নেওয়া।
ভাষা শিখতে না পারা।
নিজেদের চাহিদা বা আবেগের বহিঃপ্রকাশ করতে না পারা।
শরীরী ভাষা, গলার স্বর বা কথার মানে বুঝতে সমস্যা।
কারো চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে না পারা।
অটিজম থাকলে আপনার বাচ্চা বাকিদের সাথে স্বাভাবিক ভাবে মিশতে না-ও পারে।
স্বাদ, গন্ধ, শব্দ বা স্পর্শে অন্যরকম প্রতিক্রিয়া দেওয়া।
শৈশবে হঠাৎ করে কেউ কোলে নিতে গেলে বিরক্তি প্রকাশ বা না হাসা।
সামাজিক রীতিনীতি শিখতে না পারা।
বন্ধুদের সাথে না খেলে একলা খেলাধুলো করা।
চোখ মেলাতে না পারা।
আশেপাশের মানুষের প্রতি কোন প্রতিক্রিয়া না দেখানো।
নতুন রুটিনে মানিয়ে নিতে না পারা।
অটিজম থাকলে আপনার বাচ্চার কিছু সংজ্ঞাবহ অক্ষমতা থাকতে পারে।
বধিরতা।
স্পর্শ, শব্দ, আলো, রঙ, স্বাদ এবং গন্ধে অদ্ভুত প্রতিক্রিয়া।
কিছু কিছু খাবারে অদ্ভুত প্রতিক্রিয়া।
মানুষের স্পর্শে অস্বস্তি বোধ করা।
অটিজম থাকলে আপনার বাচ্চার কিছু আচার-আচরণের সমস্যা থাকতে পারে।
নিয়ম মেনে চলতে না পারা।
খেলনা বা কোন জিনিসের প্রতি অস্বাভাবিক আকর্ষণ।
বিপদ বুঝতে না পারা, অথচ সাধারণ জিনিসকে ভয় পাওয়া।
একই খেলা বার বার খেলা।
বিনা কারণে মেজাজ পালটে যাওয়া – অত্যাধিক হাসি বা কান্না। মাংসপেশীর অস্বাভাবিক চঞ্চলতা এই রোগের অন্তর্ভুক্ত।
যে কোন পরিবর্তন জেদ বা প্রচণ্ড রাগের কারণ হতে পারে।
কোন কাজে মন বসাতে না পারা।
খাওয়া-দাওয়া নিয়ে সমস্যা।
ডিফারেন্সিয়াল ডায়াগনোসিস কী?
নিম্নলিখিত অসুস্থতা আছে কিনা জানার জন্য এই পরীক্ষাটি করা হয়ে থাকে।
স্কিৎজোফ্রেনিয়া
বধিরত্ব
বুদ্ধিগত প্রতিবন্ধকতা
অন্য কোন মানসিক অশান্তির কারণেও শিশুর চালচলন আপাত দৃষ্টিতে অস্বাভাবিক লাগতে পারে।
অটিজমের রোগীদের নিজস্ব গুণ ও প্রতিভা থাকে। কাজেই বাবা-মা ও তার শিক্ষকদের সেই দিকে উৎসাহ দেওয়া উচিৎ।
বিশেষ গুণাবলী ও ক্ষমতা
উন্নত স্মৃতি ও প্রখর দৃষ্টিশক্তি
নিয়মমাফিক এবং গুছিয়ে কাজকর্ম করার অভ্যাস।
খুব সহজেই কঠিন জিনিস বুঝতে পারা।
পছন্দের বিষয়ে সেরা হয়ে ওঠা।
ভাষা শেখার আগ্রহ (যেসব শিশু ঠিকমত কথা বলতে পারে)
অটিজম কেন হয়?
সঠিক কারণ না জানা গেলেও, দেখা গেছে যে বিভিন্ন জিনগত এবং পরিবেশগত কারণে এই রোগ হয়ে থাকে। এমনকি জন্মের সময় সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেমে চোট লাগলেও এই রোগ হতে পারে।
অটিজমের চিকিৎসা
অটিজম একটি দীর্ঘস্থায়ী অসুখ এবং এটি কখনো সারে না। কিন্তু সঠিক থেরাপির সাহায্যে শিশু সুন্দর জীবন কাটাতে সক্ষম হয়ে উঠতে পারে। যেহেতু ১৮ মাস বা তার কম বয়সেও এই রোগ ধরা পড়তে পারে, তাই তাড়াতাড়ি এর চিকিৎসা শুরু করা গেলে আশাতীত ফল পাওয়া সম্ভব।
বাবা-মায়ের প্রতি বিশেষ নির্দেশ: সাবধানতাস্বরূপ বাবা মায়ের সংশ্লিষ্ট শিশু চিকিৎসককে এই ব্যাপারে নিয়মিত পরীক্ষা করতে অনুরোধ করা উচিৎ।
কীভাবে এই রোগ ধরা পড়ে?
অটিজম নির্ণয়ের উদ্দেশ্যে নিম্নলিখিত উপায়গুলি অনুসরণ করা যেতে পারে।
নিউরোলজিকাল টেস্ট
অটিজম ডায়াগনস্টিক ইন্টার্ভিউ – রিভাইজ্ড (ADI-R)
অটিজম ডায়াগনস্টিক অব্জারভেশন শিডিউল (ADOS)
চাইল্ডহুড অটিজম রেটিং স্কেল (CARS)
গিলিয়াম অটিজম রেটিং স্কেল
পার্ভেসিভ ডেভেলাপমেন্টাল ডিস্অর্ডার স্ক্রিনিং টেস্ট
ক্রোমোজোম-গত সমস্যা আছে কিনা জানার জন্যে জিনের পরীক্ষা
বাচ্চার শেখার ক্ষমতা, ভাষাজ্ঞান, কথা বলার ক্ষমতা ইত্যাদি পরীক্ষা করা
বিভিন্ন চিকিৎসা পদ্ধতি
এই রোগের চিকিৎসার উদ্দেশ্যই হল আপনার শিশুকে এক স্কুলে যেতে, সামাজিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে, স্বাধীন ভাবে চলতে, ঠিকমত কথা বলতে সাহায্য করা। সঠিক এবং নিয়মিত চিকিৎসায় তা সম্ভব।
অ্যাপ্লায়েড বিহেভিওর অ্যানালিসিস (ABA): শিশুকে আলাদা করে বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। তাঁকে ছক বেঁধে নিয়মমাফিক কাজ করা শেখানো হয় । একটা বড় কাজকে ছোট ছোট কাজে ভেঙ্গে নিয়ে সময়মত সেই কাজ করা শেখানো হয়। ঠিকমত কাজ করলে পুরস্কারের লোভ দেখিয়ে বাচ্চাকে কাজ করতে উৎসাহ দেওয়া হয় এবং তাঁর উন্নতির হিসেব রাখা হয়। এবিএ বিভিন্ন রকম হতে পারে।
ডিসক্রিট ট্রায়াল ট্রেনিং (DTT): এক্ষেত্রে একটা বড় কাজকে ছোট ছোট কাজে ভেঙ্গে নিয়ে সময়মত সেই কাজ করতে উৎসাহ দেওয়া হয় এবং ঠিকভাবে তা শেষ করলে পুরস্কৃত করা হয়।
আর্লি ইন্টেনসিভ বিহেভিওরাল ইন্টারভেনশন (EIBI): ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্যে ব্যবহৃত পদ্ধতি।
পিভোটাল রেসপন্স ট্রেনিং (PRT): শিশুকে নতুন জিনিষ শিখতে উৎসাহ দেওয়া। এই পদ্ধতিতে উন্নতি পেতে গেলে শিশকে নিজে থেকেই তাঁর চালচলন কে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়।
ভার্বাল বিহেভিয়ার ইন্টারভেনশন (VBI): ভাষা শেখানোর জন্যে ব্যবহৃত হয়।
ট্রিটমেন্ট অ্যান্ড এডুকেশন অফ অটিস্টিক অ্যান্ড রিলেটেড কমিউনিকেশন হ্যান্ডিক্যাপড চিলড্রেন মেথড (TEACCH): শিশুর মধ্যে উপস্থিত প্রতিভা ও গুণাবলী নিয়ে উৎসাহ দেওয়া এবং সেটাকে কাজে লাগিয়ে স্বাবলম্বী হতে শেখানো। পাশাপাশি এই পদ্ধতিতে আপনার শিশুকে দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় চলাও শেখানো হয় থাকে।
বিভিন্ন থেরাপি পদ্ধতি
বিশেষ দ্রষ্টব্য: এই পদ্ধতিগুলি শুধুমাত্র উপসর্গ নিয়ন্ত্রণের জন্যে যা শিশুর ওপর নির্ভর করে আলাদা আলাদা হতে পারে। ফলে চিকিৎসক এবং অভিভাবক একসাথে স্থির করে নেন যে কোন পদ্ধতি অনুসরণ করে ভাল ফল পাওয়া যাবে।
ডেভেলাপমেন্টাল, ইন্ডিভিজুয়াল ডিফেরেন্সেস, রিলেশনশিপ-বেস্ট অ্যাপ্রোচ (DIR বা ফ্লোর টাইম): আবেগ ও যুক্তির উন্নতি ঘটানো এবং দৃষ্টিশক্তি, শ্রবণ ক্ষমতা এবং গন্ধ বোঝার ক্ষমতার উন্নতির উদ্দেশ্যে এই পদ্ধতির সাহায্য নেওয়া হয়।
অকুপেশনাল থেরাপি: পোশাক পড়া, খাবার খাওয়া, স্নান করা ইত্যাদি শেখানো হয়ে থাকে।
সেন্সরি মাইগ্রেশন থেরাপি: যেসব শিশুরা বিশেষ স্পর্শে বা শব্দে ভয় পায় তাঁরা এই চিকিৎসা পদ্ধতিতে ভয় কাটিয়ে উঠতে পারে।
স্পিচ থেরাপি: শিশুকে কথা বলা শিখতে সাহায্য করা হয়।
মিউজিক থেরাপি: গান গাওয়া, সঙ্গীত রচনা এবং বাদ্যযন্ত্র শেখানোর মাধ্যমে শারীরিক উন্নতি।
পিকচার এক্সচেঞ্জ কমিউনিকেশন সিস্টেম (PECS): ছবি দেখিয়ে কথা বলা শেখানোর পদ্ধতি।
প্যারেন্টাল প্রোগ্রামের সাহায্যে বাচ্চার বাবা মাকে এই রোগের ব্যাপারে সঠিক তথ্য প্রদান এবং বাচ্চার যত্ন নেওয়া শেখানো হয়।
শিশুর যত্ন নিন
বাবা মা বা অভিভাবিকাদের পক্ষে একজন অটিজম আক্রান্ত শিশুর যত্ন নেওয়া খুব সহজ কাজ নয়। শিশুর উন্নতিকল্পে তাঁকে অনেকটা সময় দিতে হয়। অনেক ক্ষেত্রেই মায়েরা চাকরি ছেড়ে দেন। বাড়িতেও অনেক কিছু বদলে যায়। ভাই বোনেরা নিজেদের মধ্যে মানিয়ে নেবার চেষ্টা করতে থাকে। কিন্তু আপনি যদি রোগ সম্পর্কে অবহিত হন তাহলে দেখবেন অনেক কিছুই সহজ হয়ে যাবে। আপনি নিম্নলিখিত পরামর্শগুলি পালন করে দেখতে পারেন।
অটিজম সম্পর্কে যত বেশী করে সম্ভব জানার চেষ্টা করুন।
একটা রুটিন মেনে চলার চেষ্টা করুন।
কাউন্সেলিং করান।
অন্যান্য অটিজম রোগীর পরিবারের সাথে যোগাযোগ রাখুন।
বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।
বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে যোগদান করুন।
নিজের শরীর এবং স্বাস্থ্যেরও যত্ন নিন।
একজন মায়ের কথা: “অটিজম থাকা সত্ত্বেও আমার ছেলে একটি স্বাভাবিক শিশু। কাজেই স্বাভাবিক কাকে বলে আলাদা করে আমার জানা নেই। ও অনেক বড় হোক, জীবনে সমস্ত সাফল্য পাক এবং আনন্দে ও খুশীতে ওঁর জীবন ভরে উঠুক।”
শিক্ষাব্যবস্থা
সমস্ত স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত শিশুকে সমান অধিকার এবং সুযোগ দেওয়া উচিৎ। নির্দিষ্ট আইন এবং সরকারি নীতি থাকা সত্ত্বেও বহু প্রতিষ্ঠানই অটিজম রোগীদেরকে নিতে চায় না।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার
অটিস্টিক সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া (http://www.autismsocietyofindia.org)
সেন্টার ফর ডিজিস কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (http://www.cdc.gov)
উই ফর অটিজম (http://www.we4autism.org)