বাইপোলার ডিস্অর্ডার
বাইপোলার ডিস্অর্ডার কি?
রমণ এক তথ্যপ্রযুক্তি অফিসে কাজ করে। তাঁর এক সহকর্মী কখনও কখনও অদ্ভুত চালচলন দেখাত। হঠাৎ বে-লাগাম আবেগে ভেসে যেত, যে কোনও বিষয়ে অনর্গল কথা বলত বা কখনও অবাস্তব স্বপ্ন, যেমন বিশাল সম্পত্তির মালিক হবার কথা ভাবত। আবার কোনও কোনও দিন অস্বাভাবিক রকম চুপচাপ থাকত, কারোর সাথে কথা বলত না, নিঃশব্দে নিজের কাজ সময়মত শেষ করে ফেলত।
একদিন সেই ছেলেটি টিমের সাথে বাইরে লাঞ্চ করতে গেছিল। খাবার আনতে দেরী করার জন্য সে ওয়েটারের গায়ে প্লেট ছুঁড়ে মারে। রমণ-এর অফিসের বাকি কর্মীরা তাঁর এই ব্যবহারে স্তম্ভিত হয়ে যায়।
ধীরে ধীরে তাঁর এই অস্বাভাবিক ব্যবহারের কারণে অফিসে সবার সাথে সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে। এক সময় তাঁকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়।
রমণ এই ঘটনাটা নিয়ে কৌতূহলী হয়ে পড়ে। নিজের পারিবারিক ডাক্তারকে বিষয়টা জানানোর পর তিনি বলেন যে সম্ভবত ছেলেটি বাইপোলার ডিস্অর্ডারের শিকার।
এই রোগের সম্পর্কে বোঝানোর জন্যে বাস্তব পরিস্থিতি অবলম্বনে উপরোক্ত কাল্পনিক কাহিনীটি তৈরি করা হয়েছে।
বাইপোলার ডিস্অর্ডার বা ম্যানিক ডিপ্রেশন এমন একটি মারাত্মক মানসিক ব্যাধি যার ফলে ব্যক্তির মন-মেজাজে অস্বাভাবিক এবং অত্যধিক পরিবর্তন দেখা যায়। সেক্ষেত্রে টানা কয়েক দিন বা সপ্তাহ ব্যক্তির মানসিকতায় চড়াই (ম্যানিয়া) বা উতরাই (ডিপ্রেশন) দেখা যেতে পারে। এই পরিবর্তনগুলি খুব সুস্পষ্ট হয় এবং ঘন ঘন দেখা যেতে পারে।
রোগের চরম পর্যায় ব্যক্তির শ্রুতি ভ্রম বা দৃষ্টিভ্রম হতে পারে যার ফলে অনেকেই আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। এই অসুখের ফলে দৈনন্দিন জীবনযাত্রা চূড়ান্ত ব্যাহত হয়। এর ফলে ব্যক্তিগত সম্পর্কে অশান্তি, এমনকি কর্মক্ষেত্রেও দুর্নাম রটতে পারে।
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ হৃদরোগ বা ডায়াবিটিসের মত এটাও এক দীর্ঘস্থায়ী রোগ যা নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য আজীবন চিকিৎসা প্রয়োজন।
কোনটি বাইপোলার নয়?
মন মেজাজে পরিবর্তন বা ঘন ঘন খুশী আমরা সবাই হই। কিন্তু তাতে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে কোনও প্রভাব পড়ে না। তাছাড়া ডিপ্রেশনের কিছু কিছু উপসর্গ এই রোগের সাথে মেলে। কিন্তু বাইপোলারের সাথে ডিপ্রেশন কে গুলিয়ে ফেলা উচিৎ না। কারণ বাইপোলারে চরমপন্থি মানসিকতার জন্য ডিপ্রেশন ও ম্যানিয়া দুটোই দেখা যায়।
বাইপোলারের উপসর্গ কি?
বাইপোলারে ব্যক্তি হয় অতি মাত্রায় খুশী বা অতি মাত্রায় দুঃখী হন।
অতিরিক্ত খুশীর ক্ষেত্রে অস্থির আচার আচরণ করেন, ভবিষ্যতের কথা চিন্তা না করেই ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে বসেন যার ফলে নিজেই বিপদ ডেকে আনেন।
- অস্বাভাবিক আনন্দ যা কোনও কিছুতেই (দুঃসংবাদ বা দুর্ঘটনাতেও না) কমে না।
- হঠাৎ তিরিক্ষি মেজাজ হয়ে যাওয়া বা রেগে যাওয়া।
- নিজের সম্পর্কে অবাস্তব ও ভিত্তিহীন কল্পনা, যেমন নিজেকে ভগবান, তারকা বা ঐতিহাসিক চরিত্র মনে করা।
- অন্যের কর্মক্ষমতা সম্বন্ধে উচ্চাশা। যেমন যে কোনও পরিস্থিতিতে ওপর ব্যক্তি চূড়ান্ত কঠিন কাজ করে ফেলবে ভেবে তাঁকে আরও বেশী কাজ দেওয়া।
- বেহিসাবি চালচলন যেমন ভুলভাল খরচা, উদ্ভট ব্যবসায় লগ্নি, বিপজ্জনক ভাবে গাড়ি চালানো অথবা অতিরিক্ত যৌন আকাঙ্ক্ষা।
- মস্তিষ্কের মধ্যে সর্বদা অনিয়ন্ত্রিত চিন্তা চলতে থাকা।
- ঘুমের সমস্যা।
- মনঃসংযোগে অসুবিধা।
- অনর্গল অসংলগ্ন কথাবার্তা।
- বাস্তব এবং কল্পনার মধ্যে ফারাক না করতে পারা।
- অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস।
- ওসিডির চালচলন।
অতিরিক্ত দুঃখে ব্যক্তির নিম্নলিখিত সমস্যাগুলি দেখা দিতে পারে।
- মানসিক ভাবে চূড়ান্ত বিপর্যস্ত হয়ে পড়া।
- হতাশায় ডুবে যাওয়া।
- একবার কোনও কাজ করে ফেললে তাতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলা।
- সব সময় ক্লান্তিতে ডুবে থাকা।
- ঘুমাতে না পারা।
- ক্ষুধামন্দা।
- নিজেকে শেষ করে দেবার চিন্তা ভাবনা।
আপনার প্রিয়জনের মধ্যে যদি এই উপসর্গগুলি দেখতে পান তাহলে তাঁকে শীঘ্রই মনোবিদের সাথে যোগাযোগ করতে উৎসাহ দিন।
বাইপোলার ডিস্অর্ডার কেন হয়?
এই রোগের সঠিক কারণ এখনো জানা যায়নি। দেখা গেছে যে সাধারণত কৈশোরেই এই রোগ নিঃশব্দে থাবা বসায়। অসুখ সম্পর্কে না জানার জন্য ব্যক্তি অনেক দেরি করে চিকিৎসা করাতে আসেন।
অনুমান করা হয় যে হরমোনের ঘাটতি, জিনগত সমস্যা, চূড়ান্ত মানসিক আঘাত, মাদকাসক্তি ইত্যাদির কারণে ওই রোগ হতে পারে। বাইপোলারের সঙ্গে পাশাপাশি ডিপ্রেশন, সাইকোসিস বা স্কিৎজোফ্রেনিয়ার মত অসুখও হবার সম্ভাবনা থাকে।
বাইপোলার ডিস্অর্ডার কত রকমের হয়?
বাইপোলার ডিস্অর্ডার সাধারণত চার রকমের দেখা যায়।
বাইপোলার ১ ডিস্অর্ডারঃ অন্ততপক্ষে ৭ দিন ধরে চলা ম্যানিয়া বা ২ সপ্তাহব্যাপী ডিপ্রেশনের জন্য রোগীকে তৎক্ষণাৎ হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়।
বাইপোলার ২ ডিস্অর্ডারঃ এক্ষেত্রে ডিপ্রেসিভ ও হাইপোম্যানিক এপিসোডের মিশেল লক্ষ করা যায়।
অনির্দিষ্ট বাইপোলার ডিস্অর্ডার বা বিপি-এনওএসঃ এক্ষেত্রে বাইপোলারের উপসর্গগুলিকে ওপরের নির্দিষ্ট দুটি ভাগে ভাগ করা যায় না।
সাইক্লোথাইমিক ডিস্অর্ডার বা সাইক্লোথাইমিয়াঃ এক্ষেত্রে অন্তত দুই বছর রোগীর মধ্যে সামান্য ম্যানিয়া ও ডিপ্রেশন দেখতে পাওয়া যায়।
আনুসাঙ্গিক সমস্যা
ক্ষেত্র-বিশেষে বাইপোলারের সাথে থাইরয়েড, ডায়াবিটিস, ডিপ্রেশন বা স্কিৎজোফ্রেনিয়াও থাকার সম্ভাবনা দেখা যায়।
রোগ নির্ণয়ের পদ্ধতি
বাইপোলারকে অনেকেই বহুক্ষেত্রে স্কিৎজোফ্রেনিয়া বা ডিপ্রেশনের সাথে গুলিয়ে ফেলেন। উপসর্গ এক রকম হলেও মনে রাখা উচিৎ যে মন মেজাজের অস্বাভাবিক তারতম্য বাইপোলারের লক্ষণ। সঠিক রোগ নির্ণয়ে করার জন্যে বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা করে থাকেন। সেই উদ্দেশ্যে চিকিৎসক ব্যক্তিকে তাঁর রোজকার চালচলনের একটি তালিকা বানাতে বলতে পারেন, যেমন মেজাজ গরম হয়ে যাওয়া বা রাত্রে ঘুমোতে সমস্যা। ব্যক্তির মানসিকতা ও চিন্তাভাবনা ভাল করে তিনি পর্যবেক্ষণ করেন। আরও জানার উদ্দেশ্যে তিনি বাড়ির লোকের সাথেও কথা বলতে পারেন। রোগের গুরুত্ব বুঝতে রোগী নিজে নিজেও কিছু পরীক্ষা করতে পারেন।
বাইপোলার ডিস্অর্ডারের চিকিৎসা
ঠিক হৃদরোগ বা ডায়াবিটিসের মতই এই রোগেরও দীর্ঘস্থায়ী চিকিৎসা প্রয়োজন। সঠিক চিকিৎসার সাহায্যে রোগীর পক্ষে এক স্বাভাবিক জীবন কাটানো সম্ভব। কগ্নিটিভ বিহেভিওরাল থেরাপি, কাউন্সেলিং ও ওষুধের সাহায্যে রোগের উপসর্গ ব্যাপক হারে হ্রাস পায়। রোগীর সহ্যক্ষমতা, রোগের পর্যায়, পারিবারিক চিকিৎসা এমনকি বয়সের ওপর নির্ভর করে তিনি চিকিৎসায় কতটা সাড়া দেবেন।
চিকিৎসা না করানো বা মাঝপথে চিকিৎসা বন্ধ করে দিলে অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটতে পারে। অকস্মাৎ, সেইরকম কিছু হলে পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যেতে পারে।
চিকিৎসার মূল উদ্দেশ্য হলঃ
- রোগের উপসর্গ আয়ত্তে আনা।
- তাঁকে দৈনন্দিন কাজকর্ম স্বাভাবিক ভাবে করতে দেওয়া।
- নিজের কোনও ক্ষতি বা আত্মহত্যা আটকানো।
বিশেষ দ্রস্তব্যঃ বাইপোলারের উপসর্গগুলিকে সহজেই স্কিৎজোফ্রেনিয়া বা ডিপ্রেশনের সাথে গুলিয়ে ফেলা যায়। তাই বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে চিকিৎসা শুরু করা উচিৎ।
জানা জরুরিঃ বাইপোলারে আক্রান্ত রোগীর আত্মহত্যা করার প্রবল প্রবণতা থাকে। তাড়াতাড়ি চিকিৎসা শুরু করা বাঞ্ছ্যনিয়।
রোগের সাথে লড়াই
বাইপোলার ডিস্অর্ডার আপনার দৈনন্দিন জীবনের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। রোগের বিষয় বিষদে জানা জরুরি।
আপনি কি করতে পারেন -
- ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী চলুন।
- নিয়মিত পরীক্ষা করান।
- স্বাস্থ্যকর রুটিনে চলার চেষ্টা করুন।
- কোন পরিস্থিতিতে আপনার উপসর্গ বৃদ্ধি পাচ্ছে লক্ষ করুন।
- আপনার বন্ধু-বান্ধব ও পরিবারের সাহায্য উপলব্ধি করুন।
- অন্যান্য রোগী বা পরিবারের সাথে কথা বলুন।
রোগীর যত্ন নিন
আপনার পরিচিত কারুর এই সমস্যা থাকলে, তাঁকে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে সাহায্য করুন। এমনও হতে পারে যে আপনাকে হয়ত চিকিৎসকের সঙ্গে আগাম কথা বলতে হবে।
- রোগীর সাথে কথা বলার সময় মাথা ঠাণ্ডা রাখুন। এতে তাঁরও মন ভাল থাকবে।
- তাঁকে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চলতে উৎসাহ দিন।
- যে পরিস্থিতি গুলোতে তিনি উত্তেজিত হন সেগুলো এড়িয়ে চলুন।
- মাথা ঠাণ্ডা হলে পরে রোগীর নিজের চালচলনের জন্য গ্লানি বা অপরাধ বোধ আস্তে পারে। তাঁকে বোঝান যে এতে তাঁর কোনও দোষ নেই।
- চিকিৎসায় যে উনি অনেকটাই সুস্থ হয়ে উঠবেন সেই বিষয়ে তাঁকে আশ্বস্ত করুন।
- এমন কিছু বলবেন বা করবেন না যাতে উনি বিপজ্জনক কোনও পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেন।
যিনি রোগীর যত্ন নিচ্ছেন তাঁরও যত্নের প্রয়োজন
আপনি যদি রোগীর যত্ন নিতে গিয়ে নিম্নলিখিত পরিস্থিতিগুলির শিকার হন তবে আপনারও যত্নের প্রয়োজন।
- দিনভর ক্লান্ত বোধ করা। বিশ্রাম নিলে পরেও ক্লান্তভাব না কাটা।
- ক্রমাগত জ্বর, সর্দি-কাশিতে আক্রান্ত হওয়া।
- ব্যস্ততার কারণে নিজের যত্ন নেবার সময় না পাওয়া।
- গোটা জীবনে রোগের সেবা করেই কাটবে ভেবে একই সাথে কষ্ট ও শান্তি পাওয়া।
- কথায় কথায় অধৈর্য ও খিটখিটে হয়ে যাওয়া।
- হতাশায় ডুবে যাওয়া।
এই হেন অবস্থায় আপনি নিম্নলিখিত পরামর্শগুলি মেনে দেখতে পারেন।
- পর্যাপ্ত বিশ্রাম ও পুষ্টি অবহেলা করবেন না।
- নিয়মিত ব্যায়াম করুন।
- স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট শিখুন।
- নিজের জন্য সময় দেওয়া কোনও অন্যায় নয়।
- নিজস্ব শখ আহ্লাদ বিসর্জন দেবেন না।
- বন্ধুদের সাহায্য নিন।
- কাছের কোনও ভরসা যোগ্য ব্যক্তির সাথে মন খুলে সব কথা বলুন।