বর্ডারলাইন পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার

বর্ডারলাইন পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার

Published on
Q

বর্ডারলাইন পার্সোনালিটি ডিস‌অর্ডার বা সীমান্তবর্তী ব্যক্তিত্ব বিকার কী?

A

আমরা নিজেরা কী? আমাদের ব্যক্তিত্ব কীরকম? তাই নিয়ে আমাদের মোটামুটি একটা পরিস্কার ধারনা আছে। “আমি” বোধটা আমাদের জীবনের গোড়ার দিকে পারিপার্শ্বিক সমাজ থেকে পাওয়া শিক্ষার ভিত্তিতে গড়ে ওঠে। আমাদের পছন্দ-অপছন্দ, চাওয়া পাওয়ার উপর ভিত্তি করে এই ব্যক্তিত্ব জন্ম নেয়। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা এই কথাগুলো বোঝার বা এই প্রশ্নগুলির উত্তর পাবার চেষ্টাই করে যান রোজ।

বর্ডারলাইন পার্সোনালিটি ডিস‌অর্ডার (বি পি ডি) ব্যক্তির আবেগ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা নষ্ট করে দেয়। সম্পর্ক না টেকাতে পারা বা অস্থির মানসিকতাও এই ক্ষেত্রে লক্ষণীয়।  

এই রোগে নির্দিষ্ট আমি বোধটাই গড়ে ওঠে না। এর ফলে ব্যক্তি বিভিন্ন জায়গায় নিজেকে খাপ খাইয়ে নেবার জন্য একেক রকম ব্যবহার করে থাকেন। অনেক সময়ই এঁদের অনিয়ন্ত্রিত আবেগ দেখে লোকে তাকে ভুল বোঝে।

Q

বর্ডারলাইন মানে কী?

A

দৈনন্দিন কাজের চাপে এঁরা বিভিন্ন জায়গায় অনিয়ন্ত্রিত আবেগ প্রদর্শন করে ফেলেন। এই চাপ তাঁদের মানসিক অসুস্থতার কিনারায় পৌঁছে দেয়। এই জন্যই এই ব্যক্তিত্ব বিকারে বর্ডারলাইন (সীমান্তবর্তী) শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে।

Q

বর্ডারলাইন পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার কেন হয়?

A

এই রোগের সঠিক কারণ এখনো জানা যায়নি। যদিও বিশেষ কিছু জৈবিক, মানসিক এবং সামাজিক কারণে এই রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায় দেখা গেছে। মস্তিষ্কে সেরোটোনিনের মাত্রা কমে গেলেও এই রোগ হবার সম্ভাবনা থাকে।

মুড ডিসঅর্ডার বা জিনগত কোনও কারণেও এই রোগ হবার আশঙ্কা থাকে। ছোটবেলায় পাওয়া মানসিক আঘাত থেকেও অনেক সময় এই রোগের সূত্রপাত ঘটে। এবং পুরুষদের তুলনায়  মহিলাদের এই রোগে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা বেশি।

Q

বর্ডারলাইন পার্সোনালিটি ডিস‌অর্ডার হয়েছে কি না কী করে বুঝব?

A

বি পি ডি তে আক্রান্ত হলে ব্যক্তি নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না। কখনও অতি আনন্দ কখনও অতি দুঃখে সামান্য পরিস্থিতিতেই এঁরা উত্তেজিত হয়ে পড়েন। মেজাজে অস্বাভাবিক তারতম্য এবং মানসিক অস্থিরতায় ভোগেন। অল্প সময়েই মানুষকে বিচার করে প্রশংসা বা নিন্দামুখর হবার প্রবণতাও এঁদের মধ্যে লক্ষ করা যায়।  

এই উপসর্গগুলি জীবনভর স্থায়ী হয়। যেহেতু এই রোগ নির্ণয় করা খুবই কঠিন তাই সেই উদ্দেশ্যে সব সময় একজন অভিজ্ঞ মনোবিদেরই পরামর্শ নেওয়া বাঞ্ছনীয়।

Q

বর্ডারলাইন পার্সোনালিটি ডিস‌অর্ডারের উপসর্গগুলি কী?

A

এই রোগে রোগীর চালচলনের কোন নির্দিষ্ট গতিপথ থাকে না, ফলে তা আগে থেকে আন্দাজ করা খুবই মুশকিলের কাজ। এঁদের মানসিকতা এতটাই দ্রুত পরিবর্তনশীল যে তা কখন কোনদিকে ঘুরে যাবে, রোগী কীসে হঠাৎ রেগে যাবেন বা শান্ত হবেন তা বলা সম্ভব না।

আরও কিছু উপসর্গ

  • নিজের ব্যক্তিত্ব নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ যা ব্যক্তির নিজস্ব আদর্শ, স্বভাব, পেশা বা বন্ধু-বান্ধব বা যৌনসঙ্গী নির্বাচন দেখে বোঝা যায়। এগুলো নিয়ে তাঁদের কোন স্পষ্ট ধারণা থাকে না।

  • দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থ সম্পর্ক।

  • নিজেকে একলা মনে করা বা একলা হয়ে যাবার ভয় পাওয়া।

  • ঝুঁকিপূর্ণ চালচলন যেমন বেহিসেবী খরচা, বিপজ্জনক কাজে যোগদান, দোকান পাট থেকে জিনিস চুরি করা, অসুরক্ষিত যৌনসঙ্গমে অংশগ্রহণ করে এঁরা তৃপ্তি লাভ করেন।

  • এঁরা মনে করেন যে জীবনে একা বাঁচার ব্যক্তি এঁরা নন, ফলে তাঁর চারপাশে লোক থাকাটা খুবই জরুরি।

  • নিজেকে বা আশে পাশের লোকজনদের এঁরা হয় ভালো নয় খারাপ হিসেবে দেখেন। এর মাঝামাঝি কিছু হয় না।

  • এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ১৫-২০% নিজেকে শেষ করে দেবার উদ্দেশ্যে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন।

  • আপত্তিকর বা অস্বস্তিকর ঘটনা ভুলে যাওয়া।

বিঃ দ্রঃ –মনে রাখবেন বর্ডারলাইন পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডারের রোগী হলে এই উপসর্গগুলি প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় পুরোদমে উপস্থিত থাকবে।

কোনো একটি নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে এই রোগ নির্ণয় করা সম্ভব না। একজন মনোচিকিৎসক কিছু পরীক্ষার মাধ্যমে আগে নিশ্চিত করে নেন যে উপসর্গগুলি অন্য কোনও ধরণের ব্যক্তিত্ব বিকার বা স্কিৎজোফ্রেনিয়া বা ডিপ্রেশন ইত্যাদির জন্য হচ্ছে কি না। যদিও ক্ষেত্র বিশেষে এই সমস্যাগুলি বর্ডারলাইন পার্সোনালিটি ডিস্‌অর্ডারের সাথেও থাকতে পারে। মূলত রোগীর সাথে কথা বলে ভালো করে তাকে পর্যবেক্ষণ করার পরেই এই বিষয়ে তিনি অন্তিম মত প্রকাশ করেন। সে ক্ষেত্রে রোগীর মধ্যে উক্ত তালিকা থেকে অন্তত পক্ষে পাঁচ রকমের সমস্যা থাকতে হবে।

 

Q

বর্ডারলাইন পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার রোগীর ব্যক্তিগত জীবনে কিরকম প্রভাব ফেলে?

A

এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি ব্যক্তিগত সম্পর্ক এবং চাকরিজীবনে বিশাল বাধার সম্মুখীন হন। এর ফলে সৃষ্টি হওয়া মানসিক অবসাদে এঁরা কখনো নিজের হাতের শিরা কাটা বা অতিরিক্ত মদ ও মাদক দ্রব্য সেবন করার মত কাজও করে থাকেন। এঁদের বাইপোলার বা বুলিমিয়ার মত সমস্যাও থাকতে পারে। 

Q

বর্ডারলাইন পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডারের চিকিৎসা

A

এই রোগটি সাধারণত কিছু ওষুধ, নির্দিষ্ট থেরাপি ও মানসিক সহায়তার মিশ্রণেই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। হ্যালুসিনেশন বা মুড সুইং এর মত সমস্যা নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য চিকিৎসক কিছু মুড রেগুলেটর এবং অ্যান্টি সাইকোটিক ওষুধ দিতে পারেন। এছাড়াও আবেগ নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে নিয়মিত থেরাপি চালিয়ে যেতে হয়।

যেহেতু এই রোগের ফলে অন্যান্য বহু মানসিক জটিলতার উন্মেষ ঘটার প্রবল সম্ভাবনা থাকে ফলে তাঁর সবরকম চিকিৎসার জন্যে প্রস্তুত থাকা উচিত।

এই জন্য এই রোগের চিকিৎসায় প্রধানত দুই রকমের থেরাপির সাহায্য নেওয়া হয়।

কগনিটিভ বিহেভিওরাল থেরাপি: মনোচিকিৎসক এই ক্ষেত্রে রোগীর নিজের সম্পর্কে বদ্ধমূল ভ্রান্ত ধারনাগুলি ভাঙ্গার চেষ্টা করতে থাকেন। এতে রোগীর মনোবল বাড়াতে সুবিধা হয়।

ডায়ালেক্টিকাল বিহেভিয়র থেরাপি: প্রথমে চিকিৎসক রোগীর সাথে কথা বলে তাঁর মানসিকতা বুঝতে চেষ্টা করেন। তারপর রোগীর যে আচার আচরণের কারণে এইসমস্ত সমস্যা হচ্ছে, সেইগুলো পাল্টাতে উৎসাহ দেন। 

 

Q

বর্ডারলাইন পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার নিয়ে বাঁচা

A

যদি আপনার বর্ডারলাইন পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার ধরা পড়ে, তবে ভেঙ্গে পড়বেন না। সঠিক চিকিৎসার সাহায্যে এবং পারিবারিক সহায়তায় এই রোগ নিয়েও আপনার পক্ষে সুস্থ জীবনযাপন সম্ভব।

  • আপনার পরিবারের সদস্যদের সব খুলে বলুন। দরকার হলে তাঁদের সঙ্গে নিয়ে ডাক্তারখানায় যান।

  • আপত্তিকর পরিস্থিতিতে আপনার প্রতিক্রিয়া নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভুগবেন না। কখনও কখনও আপনার নিজের জীবনসঙ্গিনীকে আপনার অতি ভাল বা অতি জঘন্য ব্যক্তি মনে হতে পারে। মরিয়া হয়ে হঠাৎ কোন ভুল পদক্ষেপ নিয়ে বসবেন না। আপনার পরিবারের লোকজনদের এবং চিকিৎসককে আপনার সমস্যার কথা খুলে জানান।

  • একটা নির্দিষ্ট রুটিন তৈরি করুন। মনের মতন কাজের মধ্যে নিজেকে ব্যস্ত রাখুন।

  • নিয়ম করে ওষুধ খেতে এবং ডাক্তার দেখাতে ভুলবেন না।

  • মনে রাখবেন অসুস্থতাজনিত চালচলন ইচ্ছাকৃত না। এতে আপনার কোনও দোষ নেই। তাই অযথা নিজেকে খারাপ লোক মনে করবেন না।

Q

রোগীর যত্ন নেওয়া

A

অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রোগী চিকিৎসা করাতে চান না, কারণ তিনি যে অসুস্থ এটাই তিনি বুঝতে পারেন না। ফলে তাঁর প্রিয়জন, যিনি রোগীর যত্ন নেবেন, তাঁর পক্ষে পরিস্থিতি খুবই ক্লান্তিকর ও জটিল হতে পারে।

অনেক সময় তাঁর পরিবারের লোকরা নিজেরা আত্মগ্লানিতে ভুগতে থাকেন। তাঁরা মনে করেন যে সামনে থেকেও কিচ্ছু করতে পারছেন না। মরিয়া হয়ে তাঁরা সাহায্যের জন্য অপেক্ষা করেন।

অসুখের ব্যাপারে আগে জানুন: এই অসুখটি নিয়ে লোকের মনে অনেক রকম ভ্রান্ত ধারনা রয়েছে। কিন্তু আপনি যদি সমস্যাটা ভাল করে আগে বুঝতে পারেন, তবে আপনার প্রিয়জনকেও আপনার বুঝতে সুবিধা হবে।

প্রথমেই আপনাকে বুঝতে হবে যে তাঁর এই অবস্থার জন্যে আপনি দায়ী নন। বরং ঠাণ্ডা মাথায় আপনি তাঁর যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা করুন। রোগী যদি আপনার সাথে কোনও খারাপ ব্যবহার করেন তবে তা মনে নেবেন না। জানবেন উনি অসুস্থ বলেই এই রকম করছেন।

এই অবস্থায় রোগীর সাথে কথা বলাও সমস্যার হতে পারে। স্পষ্ট ভাবে সরাসরি ছোট ছোট কথা বলুন, যাতে ভুল বোঝাবুঝির আশংকা না থেকে। যদি মনে করেন আপনার কথা তিনি পরিষ্কার বুঝতে পারেননি, তবে আবার বোঝানোর চেষ্টা করুন। রোগীর অযথা প্রশংসা করবেন না। সত্যি কথা বলুন। এতে তাঁর নিজের সম্বন্ধে একটা স্পষ্ট ধারনা তৈরি হবে।

রোগীর জীবনযাত্রায় হঠাৎ কোনও পরিবর্তন আনার চেষ্টা করবেন না। এই অবস্থায় তাঁদের মানিয়ে নিতে আরও কষ্ট হয়।

গণ্ডি তৈরি করা: অধিক ভালোবাসা দেখাতে গিয়ে রোগীর সব আবদার রাখার চেষ্টা করবেন না। তাঁর এই জেদি মনোভাব আপনি পরবর্তীকালে মেনে নিতে পারবেন তো?

হিংস্র ব্যবহারের ক্ষেত্রে কীভাবে আপনি পরিস্থিতি সামাল দেবেন তা চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করে জেনে নিন।

নিজেরও যত্ন নিন। অবসর সময় বন্ধু-বান্ধবদের সাথে কাটান। আপনার মত অন্যান্য পরিবারের পাশে দাঁড়ান। সর্বোপরি মন খারাপ হলে আপনিও চিকিৎসকের থেকে পরামর্শ নিন। 

logo
হোয়াইট সোয়ান ফাউন্ডেশন
bengali.whiteswanfoundation.org