বুলিমিয়া নার্ভোসা

বুলিমিয়া নার্ভোসা

Published on
Q

বুলিমিয়া নার্ভোসা কী?

A

বুলিমিয়া নার্ভোসা এক ধরনের খাদ্যভ্যাসের বিকার যখন ব্যক্তি অতিরিক্ত মাত্রায় খাবার খেয়ে ফেলেন, আর পরে সেই খাবারকে শরীর থেকে বের করে দেওয়ার জন্য বমি করেন, অতিরিক্ত ব্যায়াম করেন, বা জোলাপের মতো অন্যান্য উপায় করেন। যখন তাদের মন খারাপ লাগে তখন তারা প্রচুর পরিমানে খাবার খেয়ে ফেলেন, প্রায়ই লুকিয়ে। তার কিছুক্ষণ পরেই, তাদের অপরাধবোধ হয় আর এত খেয়ে ফেলার জন্য তারা লজ্জিত বোধ করেন; তাই প্রায়শ্চিত্ত করার মনোভাব নিয়ে সেই খাবারকে শরীর থেকে বমি করে বা ব্যায়াম করে বার করে দেওয়ার চেষ্টা করেন। এই ধরনের অপরাধবোধ নিজেদের শারীরিক গঠন নিয়ে অসন্তোষ আর রোগা হওয়ার চাহিদার থেকে জন্মায়। নিজের শারীরিক গঠন নিয়ে যে ভ্রান্ত ধারণা থাকে তার কারনে আত্মবিশ্বাস কমে যায়। বমি করে বা অন্য ভাবে শরীর থেকে খাবারকে বার করে তারা মনে করেন যে নিজের জীবনের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারছেন। ওরা মনে করেন যে যদিও জীবনের অন্য বিষয়গুলী তারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না, নিজেদের শরীর আর চেহারাকে তারা এইসব করে নিয়ন্ত্রিত করতে পারছেন।

বুলিমিয়ার শারীরিক ফল সাংঘাতিক হতে পারে, কিন্তু সময় মতো চিকিৎসা করালে ব্যক্তি নিজের ব্যাপারে ভালো বোধ করেন এবং সুষম খাদ্য অভ্যেসও গড়ে উঠে। তখন ওরা নিজেদের উদ্বেগ আর মানসিক চাপের সাথেও সঠিক ভাবে মোকাবিলা করতে পারেন।

নোটঃ কিছু ব্যক্তি মানসিক বিপর্যয়ের সাথে মোকাবিলা করার জন্য বেশী পরিমাণে খেতে শুরু করেন। এতে তারা আশ্বস্ত বোধ করেন, কিন্তু বুলিমিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের মতো এরা খাওয়ার পরে বাড়তি ওজনকে কমানোর জন্য বমি করার চেষ্টা করেন না বা ব্যায়াম করেন না। এই ধরনের ব্যক্তিরা, যারা মন খারাপের সময় অতিরিক্ত পরিমানে খাওয়াদাওয়া করেন, তারা অন্য ধরনের খাদ্যভ্যাস বিকারে আক্রান্ত। এই বিকারকে বিঞ্জ ইটিং ডিসঅর্ডার বলা হয়।

Q

বুলিমিয়া নার্ভোসার লক্ষণ

A

বুলিমিয়ার প্রধান আচরণগত লক্ষণগুলি হলঃ

  • বুলিমিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা নিজেদের শারীরিক গঠন আর চেহারা নিয়ে সারাক্ষণ ভাবতে থাকেন আর ওজন বেড়ে যাওয়া নিয়ে আতঙ্কে থাকেন।

  • মন খারাপ লাগলে প্রচুর পরিমানে খেয়ে ফেলেন।

  • ওরা লুকিয়ে খাওয়াদাওয়া করেন যাতে পরিবারের সদস্য এবং বন্ধুরা জানতে না পারে।

  • যদি খাবার খাওয়ার পরেই তারা ঘন-ঘন বাথরুমে যান, তাহলে ধরে নিতে হবে যে খাবার বার করতে যাচ্ছেন। হয়তো তারা গলায় আঙ্গুল দিয়ে বমি করার চেষ্টা করছেন বা জোলাপ বা বেশী প্রস্রাব হওয়ার ওষুধ অপব্যবহার করছেন। কিছু ব্যক্তিরা ভেষজ সাপ্লিমেন্টসের অপব্যবহার করেন ওজন কমানোর জন্য।

  • অতিরিক্ত পরিমানে ব্যায়াম করেন, বা সারাক্ষণ ব্যায়াম নিয়ে ভাবনাচিন্তা করতে থাকেন, যেমন বাইরে বৃষ্টি পড়ছে দেখেও দৌড়োতে যেতে চান।

কিছু শারীরিক লক্ষণ হলঃ

  • আঙ্গুল আর আঙ্গুলের গাঁটে ক্ষতচিহ্ন; নিয়মিতভাবে জোর করে বমি করার অভ্যেসের জন্য এটা হতে পারে।

  • ঘনঘন বমি করলে পেটের অ্যাসিডে দাঁতের রং পালটে যায়।

  • ঘনঘন বমি করলে চোয়াল আর গাল ফুলে যেতে পারে।

  • বারবার বমি করা আর বেশী খাওয়ার ফলে শারীরিক ওজন কমতে বাড়তে থাকে।

Q

বুলিমিয়া হওয়ার কারণ কী?

A

বুলিমিয়া হওয়ার কোন সঠিক কারণ নেই। সাধারণভাবে এর জন্য ব্যক্তির জীবনের বিবিধ কারন দায়ী। অন্যান্য খাদ্য বিকারের মতো বুলিমিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা এই অভ্যেসকে ঢালের মতো ব্যবহার করেন অন্য গভীর মানসিক সমস্যার সাথে লড়াই করার জন্য। কিছু কারন যার জন্য একজন ব্যক্তির বুলিমিয়া হতে পারে –

  • জীবনে উদ্বেগপূর্ণ ঘটনা। প্রিয়জনের মৃত্যু, চাকরি হারানো বা বিবাহ বিচ্ছেদের মতো ঘটনার কারনে বুলিমিয়া হতে পারে। এই ধরনের ঘটনার জন্য ব্যক্তি বেশী বেশী খেতে শুরু করেন এবং পরে সেই অতিরিক্ত খাবারকে শরীর থেকে বার করার চেষ্টা করতে পারেন।

  • দেখা গিয়েছে যে বুলিমিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের মানসিক বা শারীরিক আঘাত, বা যৌন বা শারীরিক নির্যাতনের পূর্ব ইতিহাস থাকতে পারে।

  • মিডিয়া বা সমবয়েসিদের প্রভাবে শারীরিক গঠন সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা জন্মাতে পারে, যা এই সমস্যার কারন হতে পারে।

  • অভিনয় জগতের সাথে জড়িত ব্যক্তি, মডেল, জিমন্যাস্টিক্স করেন এমন ব্যক্তিদের পেশাগত কারনে বুলিমিয়া হতে পারে, কারন এরা ওজন বেড়ে যাওয়া নিয়ে সব সময় সতর্ক থাকেন।

  • কখনো কখনো ডিপ্রেশন, উদ্বেগ বা অন্য আবেগ সংক্রান্ত সমস্যা থাকলে বুলিমিয়া হতে পারে। মানসিক বিপর্যয়ের কারণে মনে হতে পারে যে পুরো পরিস্থিতি ওঁর নিয়ন্ত্রণের বাইরে। এই অবস্থায় বেশী খেয়ে সেই খাবারকে শরীর থেকে বের করতে পারলে নিজের শরীরের ওপর নিয়ন্ত্রণ রয়েছে বলে মনে করেন। 

Q

বুলিমিয়ার চিকিৎসা

A

  • বুলিমিয়া একটি গুরুতর সমস্যা কিন্তু এর চিকিৎসা সম্ভব আর সময় মতো আপনি যদি সাহায্য নেওয়ার জন্য এগিয়ে যান তাহলে আপনি সম্পূর্ণ ভাবে সেরে উঠতে পারেন। চিকিৎসা পদ্ধতির মূলে রয়েছে কাউন্সেলিং আর থেরাপি যা আপনাকে শেখাবে কিভাবে মানসিক চাপ আর উদ্বেগের সাথে মোকাবিলা করবেন। হয়তো আপনাকে অ্যান্টি ডিপ্রেসেন্ট ধরনের ওষুধ খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হতে পারে।

  • যদি অন্য ধরনের শারীরিক জটিলতা থাকে তাহলে কিছুদিনের জন্য আপনাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হতে পারে যাতে আপনার অবস্থার উন্নতি হয়। যদি আপনার শারীরিক ওজন খুব কম হয় তাহলে বিশেষজ্ঞের দল আপনাকে সাহায্য করবেন সঠিক ওজনে পৌঁছতে আর স্বাস্থ্যকর খাওয়ার নিয়ম মেনে চলতে। চিকিৎসার পরিকল্পনা অনুযায়ী চলা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আপনার ডাক্তার বা পরিচর্যাকারীর সঙ্গে সাথে সাথে যোগাযোগ করুন যদি আপনার মনে আবার বেশী খাওয়ার ইচ্ছে জাগে।

Q

বুলিমিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তির পরিচর্যা

A

  • বুলিমিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে এই সমস্যাকে নিয়ে প্রবল লজ্জাবোধ থাকে, তাই ওঁরা হয়ত এই বিষয়ে কথা বলতে চাইবেন না। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে বুলিমিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তির গুরুতর শারীরিক আর মানসিক ক্ষতি হয়।

  • পরিচর্যাকারী হিসেবে আপনাকে ওঁর দিকে সহযোগিতার হাত বাড়াতে হবে। ওনার সমস্যা নিয়ে কথা বলার জন্য আর চিকিৎসা করানোর জন্য ওনাকে উৎসাহিত করুন। প্রথমে উনি রাজি না থাকতে পারেন কিন্তু আপনি ধৈর্য হারাবেন না; জোরজবরদস্তী করবেন না বা সমস্যার ক্ষতিকারক ফলের কথা বলে ভয় দেখাবেন না। চিকিৎসা চলাকালীন আশেপাশের সবাই যেন সুষম খাবার খায় এবং শারীরিক গঠন বা ওজন নিয়ে কোন আলোচনা যেন না করা হয় সেই দিকে খেয়াল রাখবেন। আপনার প্রিয়জনকে উৎসাহিত করুন যেন উনি চিকিৎসা চালিয়ে যান এবং ওনার দুর্বল মুহূর্তে ওঁর পাশে দাঁড়ান।

Q

বুলিমিয়ার সাথে মোকাবিলা

A

বুলিমিয়া খুবই ক্লান্তিকর অভিজ্ঞতা এবং এতে প্রচুর মানসিক চাপের সৃষ্টি হয়। এই মানসিক চাপ আর শারীরিক শাস্তি আপনার পুরো জীবনকে প্রভাবিত করতে পারে। কিন্তু, এই সমস্যার চিকিৎসা সম্ভব এবং সমস্যার হাত থেকে রেহাই পাওয়ার প্রথম পদক্ষেপ হল মেনে নেওয়া যে আপনার এই সমস্যাটি রয়েছে। বুলিমিয়ার চিকিৎসায় সময় লাগে তাই ধৈর্য ধরে চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ। এরই সঙ্গে খাবার খাওয়ার নিয়ম মেনে চলতে হবে। যদি কোন সময় আপনার মনে হয় যে আপনি সব কিছু সামাল দিতে পারছেন না বা যদি আবার বেশী বেশী খাওয়ার ইচ্ছে হয়, তাহলে কোন বিশ্বস্ত ব্যক্তির সাথে কথা বলুন। এই ধরনের পরিস্থিতির মোকাবিলার জন্য আপনি কি কি করবেন সেটা আগে থেকে ভেবে রাখুন – বাইরে দৌড়াতে যাওয়া, বন্ধুদের সাথে বা পরিবারের লোকজনের সাথে কথা বলা ইত্যাদি।     

logo
হোয়াইট সোয়ান ফাউন্ডেশন
bengali.whiteswanfoundation.org