সহজ ভাষায় বর্ডারলাইন পারসোনালিটি ডিসঅর্ডার
বর্ডারলাইন পারসোনালিটি ডিসঅর্ডার একধরনের জটিল মানসিক সমস্যা যার কারণে মানুষ তার আবেগের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে অক্ষম হয়ে পড়ে এবং এই অসুখটি রোগীর সাথে সাথে তার আত্মীয়, বন্ধু ও নিকটজনের জীবনও ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়। এই অসুখটি সম্পর্কে সাধারণ মানুষ যে শুধু খুব কমই জানে তাই নয়, ইন্টারনেটে এই অসুখের বিষয়ে প্রচুর নেতিবাচক তথ্যও মজুত আছে।
বর্ডারলাইন পারসোনালিটি ডিসঅর্ডার বিষয়ে দু চার কথা
যার মধ্যে বংশগত দিক দিয়ে অথবা জৈবিক স্বভাবের কারণে রোগের ধাত আগে থেকেই উপস্থিত রয়েছে, সে শরীর ও মন গড়ে ওঠার বয়সে যদি পরপর অনেকগুলো সমস্যার সম্মুখীন হয় বা যন্ত্রণাদায়ক পরিস্থিতিতে পড়ে, তাহলে সেই ব্যক্তি সময়ের সাথে সাথে এই আসুখে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। এই অসুখের সাধারণত ৯ টি লক্ষণ থাকে যার মধ্যে অন্তত ৫ টি উপস্থিত থাকলে রোগটি সনাক্ত করা সম্ভব।
এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলি আমাদের সকলের মধ্যেই কম বেশি উপস্থিত রয়েছে কিন্তু এই অসুখে বৈশিষ্ট্যগুলি বিশেষ রূপে প্রকাশিত হয়। এদের মধ্যে ঘনঘন মেজাজের পরিবর্তন দেখা যায় এবং এদের দুঃখ, সুখ, আনন্দ, হতাশা সব রকম অনুভুতিই প্রগাঢ় হয়, যে কারণে এদের প্রতিক্রিয়া সবসময়েই অতিরিক্ত বা বাড়াবাড়ির পর্যায়ে চলে যায়।
আবেগের বশবর্তী হয়ে এরা হঠকারী সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে, সেটা যেমন আনন্দের ক্ষেত্রেও সত্য, ঠিক তেমনি ভাবেই, অবসাদ বা বিষাদ গ্রাস করলে তারা নিজের ক্ষতিসাধন করতেও পিছপা হয়না। জিনিসপত্র নষ্ট থেকে শুরু করে অনিয়ন্ত্রিত বেগে গাড়ি চালানো, অসতর্ক যৌন জীবনযাপন বা যথেচ্ছ পয়সা ওড়ানো এমনকি আত্মহত্যার প্রবণতা পর্যন্ত লক্ষ্য করা যায় এদের মধ্যে।
আত্মবিশ্বাসের অভাবের ফলে এদের ব্যক্তিত্বের সঠিক গঠন হয়না, যে কারণে এরা নিজেদের সঠিক মুল্য্যায়ন করতে পারেনা। সেই কারণে মানুষের সাথে এদের ব্যবহারের কোনও স্থিরতা থাকেনা। ফলে এদের সম্পর্ক প্রচুর টানাপড়েনের মধ্যে দিয়ে চলতে চলতে ভঙ্গুর হয়ে পড়ে। নিজেদের নিয়ে হীনমন্যতায় ভোগার কারণে অন্য মানুষটিকে অনবদ্য মনে হয় আর দ্রুত নতুন নতুন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে কিন্তু যখন দেখে সেই সম্পর্ক জোরালো হয়ে উঠছে তখন উন্মচিত হয়ে পড়ার ভয়ে তারা পিছিয়ে আসে। কিছু রোগী তাদের ছেড়ে সকলেই চলে যাবে এই ধরণের ভয়ে আক্রান্ত হয়ে থাকে সতত। তাই সম্পর্ক রক্ষার জন্য মরিয়া হয়ে এমন কোনও কাজ নেই যা তারা করতে পারেনা। এর ফলশ্রুতি আরও ভয়ঙ্কর হয়। তাদের কাছের মানুষটির দমবন্ধ লাগতে শুরু করে এবং সম্পর্কটি ভেঙে যায়।
মাঝেমাঝে তারা অনুযোগ করে যে তারা এক ধরণের শূন্যতা অনুভব করছে। এর ফলে তারা মাদক দ্রব্যের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়তে পারে এবং অবস্থার ক্রমশ অবনতি হতে থাকে। কোনও অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়ার থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য পৃথকীকরণ-এর সাহায্য নেয় – মানসিকভাবে সেই মুহূর্ত থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে নেয় যাতে এই সময়ের কোনও স্মৃতিই অবশিষ্ট না থাকে ।
রোগ নির্ণয়
সব রোগীদের এই অসুখে একই ধরণের লক্ষণ নাও থাকতে পারে। আবার যে সব লক্ষণ দেখা যায় তারা একে অপরের সাথে মিশে একটি জটিল আবেগজনিত সমস্যা চক্র সৃষ্টি করে। তাদের মধ্যে অন্যান্য মানসিক সমস্যার লক্ষণ যেমন উদ্বেগ বা অবসাদ ইত্যাদি ও দেখা যায় যেটা তাদের জীবন নষ্ট করে দেবার জন্য যথেষ্ট। ঘনঘন মেজাজ পরিবর্তন আর হীনমন্যতার কারণে এরা অবসাদে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। উদ্বেগ অবশ্য সব ধরণের মানসিক সমস্যাতেই দেখা যায়। শুধুমাত্র উদ্বেগ ও অবসাদের চিকিৎসা খুব সাময়িক উন্নতি আনে। বিপিডি সনাক্ত করা ঠিক কারণেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
প্রকৃতপক্ষে মনস্তত্তবিদরা রোগীর সাথে বেশ কয়েকদিন ধরে সময় কাটিয়ে সাক্ষাৎকার ও রোগ নির্দেশিকা (ডায়াগনস্টিক টুল) এর সাহায্য নিয়েই অসুখটি সম্পর্কে সঠিক সিদ্ধান্তে আসতে পারেন। রোগীর অনুমতি নিয়ে বাড়ির লোক, বন্ধু এবং অন্যান্য চিকিৎসক, যারা রোগীকে কাছ থেকে জানেন, তাদের সাথেও কথা বলা হয়। যদি রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়, সেক্ষেত্রে কিছুদিন ধরে পরিস্থিতি যাচাই করার পরেই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সম্ভব।
অনেক সময়েই চিকিৎসা বিভ্রান্তির স্বীকার হন এই রোগীরা কারণ বাইপোলার ডিসঅর্ডার, পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার এবং কমপ্লেক্স পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার এর সাথে এই রোগের বেশ কিছু লক্ষণ মিলে যায়। কিন্তু বাইপোলার ডিসঅর্ডারের ক্ষেত্রে মেজাজের পরিবর্তন এর পর্বের স্থায়িত্ব অপেক্ষাকৃত ভাবে অনেকটাই লম্বা হয় এবং দুটি পর্বের মধ্যে পার্থক্য লক্ষণীয়।
পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার এবং কমপ্লেক্স পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার অসুখ দুটির ক্ষেত্রেই মানসিক আঘাত কাজ করে কিন্তু বর্ডারলাইন পারসোনালিটি ডিসঅর্ডারের মতন নিজের ক্ষতি করার বা আত্মহননের প্রবণতা, যেটা এই রোগের অন্যতম লক্ষণ, খুব কম দেখা যায় এই দুই ক্ষেত্রে। রোগীর লক্ষণ ও স্বভাব সার্বিক ভাবে পর্যালোচনা করলে চিকিৎসা বিভ্রান্তির সম্ভাবনা কম।
একবার দেখেই মনস্তত্ববিদদের পক্ষে এই রোগ নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। এছাড়া বয়ঃসন্ধির আগে কখনোই এই রোগের বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব নয় কারণ ব্যক্তিত্বের গঠন সম্পূর্ণ হয়না। আবার জীবনের পরেরদিকে এই অসুখ দেখা দিতে পারেনা কারণ ততদিনে ব্যক্তিত্বের গঠন ততদিনে সম্পূর্ণ হয়ে যায়।
চিকিৎসা
সঠিক রোগ নির্ণয়ের পরে সেরে ওঠা সম্ভব। থেরাপি ও ওষুধের দ্বারা মূলত এই অসুখের চিকিৎসা করা হয়। রোগীর সমস্যা অনুযায়ী ওষুধ দেওয়া হয়। বিভিন্ন রকমের অ্যান্টিডিপ্রেস্যান্ট, অ্যান্টি অ্যাংজাইটি ড্রাগস, মুড স্টেবিলাইজারস এবং এমনকি অ্যান্টি সাইকোটিকস-ও প্রয়োজন বুঝে দেওয়া হয়। এইসব ওষুধের প্রভাবে রোগী কিছুটা সাময়িক স্বস্তি পায় এবং ওষুধ দেওয়ার মূল লক্ষ্য হল রোগীকে স্থিতাবস্থায় নিয়ে আসা যাতে সে থেরাপিতে অংশগ্রহণ করতে পারে।
এই চিকিৎসার সবচেয়ে বড়ো অঙ্গ হল থেরাপি। ডায়ালেকটিকাল বিহেভিয়ার থেরাপি, মেন্টালাইজেশান বেসড থেরাপি, স্কেমা ফোকাসড থেরাপি এবং ট্রান্সফারেন্স ফোকাসড থেরাপির সাহায্য নেওয়া হয় এই অসুখ সারানোর জন্য। টাইম বাউন্ড থেরাপির সাহায্যে আবেগ নিয়ন্ত্রণের সাথে সাথে উচ্চমানের কর্মক্ষমতা এনে দেওয়া হয় যার ফলে রোগীর জীবনযাত্রার মান অনেক উন্নত হয় ।
এই অসুখ ধরা পড়ার আগে অবধি রোগীকে অসুখের সাথে অনেকটা যুদ্ধ করতে হলেও অসুখ সঠিকভাবে নির্ধারণের পরে চিকিৎসা শুরু করে দেওয়া যায় । একভাবে চিকিৎসা চললে এক বছরের মধ্যেই ভালো ফল পাওয়া সম্ভব এবং সেক্ষেত্রে সারা জীবনের মতন সুস্থতা বহাল থাকবে। যারা একবার সুস্থ হয়ে যান তারা বাকি জীবনটা সুস্থভাবেই কাটান।
এই প্রবন্ধটি লেখার জন্য গ্রীন ওক ইনিশিয়েটিভ-এর সাইকিয়াট্রিস্ট ও সাইকোথেরাপিস্ট ডাঃ অশ্লেষা বাগারিয়ার সাহায্য নেওয়া হয়েছে।
বিপিডির বিষয়ে আরও জানতে আমাদের এই ভিডিওটি দেখুন।