ধূমপান ছাড়বেন কীভাবে?

ধূমপান ছাড়বেন কীভাবে?

সঠিক পেশাদারি, সহায়তা ও সমর্থন পেলে তামাকের আসক্তি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।

তামাকের আসক্তি কী?

ভারতে সাধারণ নেশার বস্তু হিসেবে তামাকের নানা প্রকার ব্যবহার চালু রয়েছে। সারা পৃথিবীতে নিকোটিনযুক্ত তামাকজাত বস্তু হিসেবে সিগারেট সর্বাধিক প্রচলিত। ভারতে সিগারেট ছাড়াও বিড়ি, নস্যি, হুঁকো এবং খৈনির মতো চিবিয়ে খাওয়া যায় এমন নানা পদ্ধতিতে তামাক ব্যবহার হয়।

তামাক একটি চড়া ধরনের নেশার বস্তু। প্রায়শই ব্যবহারকারীরা চাইলেও এর আসক্তি কাটাতে পারে না। এটির টক্সিসিটির মাত্রা অত্যন্ত বেশি। হিসেব মতো পৃথিবীতে প্রতি বছর প্রায় পাঁচ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যুর কারণ তামাক আসক্তি। ভারতে তামাকের ব্যবহারের জন্য বছরে এক মিলিয়নের বেশি মানুষের মৃত্যু ঘটে।

ভারতে প্রতিদিন কমবেশি আড়াই হাজার (২,৫০০) মানুষ তামাক সংক্রান্ত অসুখে মারা যায়। বিশ্বজুড়ে তামাকের জন্য মৃত্যুর হার কোকেন, ওয়াইন ও অ্যালকোহল জাতীয় নেশার বস্তু ব্যবহারকারী বা এইডসের মতো অসুখ এবং আগুন ও অন্যান্য দুর্ঘটনা বা খুন, আত্মহত্যার মিলিত সংখ্যার তুলনায় অনেক বেশি।

তামাক কী?

নিকোটিনা টেবোকাম বা তামাক গাছের নির্যাস ব্যবহার করে তৈরি একটি বস্তু। তামাক গাছের পাতা শুকিয়ে তার সঙ্গে অন্যান্য বস্তুর মিশ্রণে তৈরি হয় বিড়ি, সিগারেট, নস্যি, হুকো, কাদ্দিপুড়ি, জরদা এবং অন্যান্য নেশার সামগ্রী। তামাক বিভিন্ন ভাবে নেওয়া হয়। চিবোনোর জন্য সুপুরি, নাক দিয়ে নেওয়ার নস্যি ও ধূমপানের জন্য সিগারেট বা বিড়ি।

তামাক গাছের পাতায় নিকোটিন নামে উত্তেজক রাসায়নিক পদার্থ পাওয়া যায়। ধূমপান বা চিবিয়ে খাওয়ার সময় তামাক থেকে নিকোটিন ছাড়াও চার হাজার অন্যান্য রাসায়নিক এবং কার্বন মনোক্সাইড ও টার উৎপন্ন হয় এবং শরীরে মিশে যায়।

তামাকের আসক্তি কীভাবে হয়?

তামাক গ্রহণের ফলে মস্তিষ্কে ডোপামিন ক্ষরণ হয়। ডোপামিন এক ধরনের নিউরোট্রান্সমিটার, যেটি আমেজ বা আরামদায়ক অনুভূতি আনে। মস্তিষ্ক ওই আরামদায়ক অনুভূতি উপভোগ করে। যার ফলে কোনও ব্যক্তি আবার তামাকের স্বাদ নিতে চায়। ক্রমশ ট্রান্সমিটারগুলির সংবেদনশীলতা কমতে থাকে। মস্তিষ্কের সেই আমেজ পূরণ করার জন্য আরও বেশি করে তামাকের দরকার পড়ে।

যখন কোনও ব্যক্তি নিকোটিন গ্রহণ করে, তখন এই রাসায়নিক ব্রেনের মাধ্যমে তার ত্বক, মুখ, নাকের মিউক্যাল আস্তরণ এবং লাংস অবধি পৌঁছে যায়। ধুমপানের দ্বারা নিকোটিন শরীরে প্রবেশ করে তাৎক্ষণিক শক্তিতে দোলা দিয়ে মাদকতা এনে দেয়। কয়েক মিনিটের মধ্যে এই কম্পন কমতে থাকে এবং শরীরে অবসন্নতা বোধ হয় বা ক্লান্তি আসে। ক্রিয়াটি ধুমপান সংক্রান্ত উইথড্র্য়াল সিম্পটমের একটি লক্ষণ, যে কারণে শরীর পরবর্তী ডোজটি নিতে চায়।

গবেষণা থেকে জানা যাচ্ছে, শিশু ও কিশোররা তামাকের আসক্তি বিষয়ে বেশ অসুরক্ষিত। কোনও ব্যক্তি কম বয়সে তামাক নিতে শুরু করলে তার পক্ষে এতে আসক্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

তামাক আসক্তি থেকে মস্তিষ্কে যে ধরনের পরিবর্তন ঘটে, সেগুলির সঙ্গে কোকেন বা হেরোইন নেওয়ার কারণে ঘটা পরিবর্তনের সামঞ্জস্য রয়েছে। দীর্ঘদিন তামাক ব্যবহারের ফলে আসক্ত ব্যক্তির মধ্যে কিছু নিদির্ষ্ট অবস্থা বা লক্ষণ প্রকাশ পায়, যে জন্য সে ধূমপান বা অন্যান্য ধরনের তামাকজাত নেশা করতে চায়। দিনের কিছু বিশেষ সময়ে, যেমন ঘুম ভাঙার পর, কাজের ফাঁকে, কফি বা লাঞ্চ ব্রেকের পর আসক্ত ব্যক্তির তামাক ব্যবহারের ইচ্ছা জাগে। গাড়ি চালানো, মদ্যপান বা অন্যান্য চাপযুক্ত কাজ করার উৎসাহে অনেকেই ধূমপানের টান অনুভব করে।  

তামাক আসক্তির প্রভাব কী?

তামাক বা নিকোটিন গ্রহণ করলে তা শরীরের প্রতিটি অংশে প্রভাব ফেলে। এটি ব্যবহারের ফলে অ্যাড্রিনালিন ক্ষরণ বেড়ে গিয়ে শরীরের উত্তাপ, হৃৎপিণ্ডের গতি ও রক্তচাপ বাড়িয়ে দেয়। ধূমপায়ীদের শরীরে বিশেষত মুখ, স্তন, ফুসফুস, গর্ভাশয়, পাকস্থলী, কিডনি বা প্যানক্রিয়াসে ক্যানসারের প্রবল সম্ভাবনা থাকে। যারা অন্যভাবে তামাক ব্যবহার করে তাঁদের ক্ষেত্রে মুখ, পাকস্থলী, ইসোফেগাস, ল্যারিংস ও প্যানক্রিয়াসে ক্যানসার হতে পারে।

দীর্ঘমেয়াদি তামাকের ব্যবহারে আরও অনেক শারীরিক সমস্যা সৃষ্টি হয়। ত্বক ও দাঁতে বার্ধক্যের চিহ্ন দেখা দেয়, চোখে ছানি পড়ে, রক্তচাপের তারতম্য ঘটে, কোলেস্টেরল, শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা, হার্টের গোলোযোগ, স্ট্রোকের সম্ভাবনা এবং গর্ভবতী মহিলাদের গর্ভপাত বা গর্ভধারণের সমস্যা দেখা দেয়। এগুলি ছাড়াও ডায়াবেটিস, রিউম্যাটয়েড আর্থারাইটিস ও অস্টিওপোরোসিসের ঝুঁকি বেড়ে যায়। হিসেবমতো একজন ধূমপায়ী ব্যক্তির জীবনসীমা কোনও অধূমপায়ীর তুলনায় সাধারণত  ১৫ বছর কমে যায়।    

সেকেন্ড হ্যান্ড স্মোক বা প্যাসিভ স্কোকিং থেকেও শরীরে কুপ্রভাব পড়ে, যাতে অনেক সময় মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। দীর্ঘদিন ধরে পরোক্ষ ধূমপানের কারণে লাং, ব্রেস্ট ও লিভারে ক্যানসারের সম্ভাবনা থাকে। এর জন্য স্ট্রোক ও হার্ট অ্যাটাকও হয়। প্রচলিত বিশ্বাসের বিপরীতে বলা চলে, সেকেন্ড হ্যান্ড স্মোক-এর পরিনতিতে কোনও 'নিরাপদ মাত্রা পাওয়া যায় না। ধূমপানের যেকোনও পরিণতিই অসুবিধাজনক।

বিড়ি, নস্যি ও অন্যান্য ধূমহীন তামাকজাত বস্তুকে সাধারণত সিগারেটের তুলনায় কম ক্ষতিকর বলে মনে হয়। এটা সত্যি নয়। এগুলিও সিগারেটের মতোই ক্ষতি করে। এতে গ্রাহক ও তার আশপাশে যারা রয়েছে, তাদের দেহেও কুপ্রভাব বিস্তার করে।

তামাকের আসক্তি বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি কার?  

যে ব্যক্তি দীর্ঘদিন ধরে তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার করছে তার আসক্তি বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। কোনও নিকটাত্মীয় তামাক আসক্ত, শিশু বা কিশোর বয়স থেকে তামাকজাত দ্রব্যের নেশা করলে, অন্যান্য মাদকের নেশা এবং অতীতে মানসিক অসুস্থতা, প্রত্যেকটি বিষয়কে একজনের আসক্তির প্রতি দুর্বলতা বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে ধরা হয়।  

তামাকের আসক্তি কীভাবে চিহ্নিত করা যায়?

প্রতিদিন কারও কয়েকটা সিগারেট বা খৈনিজাতীয় তামাক নেওয়ার অভ্যাস থাকলে সেই ব্যক্তিকে আসক্ত বা আসক্তি বেড়ে উঠেছে বলা চলে।

ধূমপায়ীদের নিকোটিন নির্ভরতা বা আসক্তি চিহ্নিতকরণের কয়েকটি লক্ষণ

  • ধূমপান ক্ষতিকর জেনে ছেড়ে দেওয়ার জন্য চেষ্টা করেও অসফল হওয়া।

  • যখন শুরু হয়েছিল, তখনকার তুলনায় প্রতিদিন অনেক বেশি সিগারেট টানা।

  • কয়েকমাস আগে যতগুলো দরকার হত, তার থেকে বেশি সিগারেট এখন প্রতিদিন লাগছে।

  • দিনের শেষে দেখা যাচ্ছে, চাহিদার থেকেও বেশি সিগারেট টানা হয়েছে। সিগারেটে সুখটান না দিলে মন আনচান করে।

  • ধূমপান বন্ধ করলে উইথড্রয়াল সিম্পটম হয়, ফলে দৈনন্দিন জীবনে অস্বাভাবিকতা দেখা দেয়।

  • কিছুক্ষন ধূমপান না করলেই মনে হয় কখন এবং কোথায় গিয়ে পরবর্তী সিগারেট টানা যাবে।

  • নিজের জন্য কর্মপদ্ধতির পরিকল্পনা ও স্থান এমনভাবে নির্দিষ্ট করা, যাতে রেস্টুরেন্ট বা যে কোনও জায়গায় ধূমপানের সুবিধা রয়েছে এবং আশপাশে সিগারেট কেনার ব্যবস্থা আছে, অর্থাৎ ধূমপানের ব্যাঘাত না ঘটে।

  • যে সমস্ত জায়গায় ধূমপান নিষিদ্ধ, সেই জায়গাগুলি এড়িয়ে যাবার ইচ্ছে থাকা।

  • অসুস্থ বা স্বাভাবিকভাবে কাজ করার অবস্থায় না থাকলেও ধূমপান চালিয়ে যাওয়া।

উপরের কয়েকটি লক্ষণ থেকেই বোঝা যাবে যে, ওই ব্যক্তি সিগারেট আসক্ত এবং তার সহায়তা প্রয়োজন।

নিয়মাবলি অনুসারে নিজেকে কখনও ধূমপান বা অন্যান্য তামাকজাত দ্রব্যে আসক্ত মনে হলে তার ব্যবহার বন্ধ করা উচিত।

তামাক আসক্তির কারণে যে ধরনের উইথড্রয়াল সিম্পটম দেখা দেয়, তার সঙ্গে কাঁপুনি বা খিঁচুনি, উদ্বেগ, ভারাক্রান্ত মানসিকতা, ঘুমের সমস্যা, হার্ট রেট কমে যাওয়া, খিদে বেড়ে যায় এবং বিরক্তি লাগে।

পরীক্ষা ও চিকিৎসা -

অমর (নাম পরিবর্তিত) সারাদিনে অনেক সিগারেট টানা অভ্যেস করে ফেলেছিল। পেশাদারি ব্যস্ততার ফাঁকে সর্বক্ষণ সিগারেট ব্রেক-এর জন্য সুযোগ খুঁজত। সিগারেটের প্রতি দারুণ আসক্ত হয়ে পড়ায় তার খেয়াল হল, সে টানা একঘন্টার বেশি কোনও কাজেই মনোনিবেশ করতে পারছে না। সে পকেটে সিগারেট লুকিয়ে রাখত, নেশার টানে তাড়াতাড়ি মিটিং থেকে বেরিয়ে যেত এবং ধূমপান নিষিদ্ধ হওয়ার কারণে ফ্লাইটে যাতায়াত এড়িয়ে চলত।

মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক এক পেশাদার গোষ্ঠীর সাহায্য পেয়ে অমর লক্ষ করল, তার কার্যক্ষমতা ও জীবনের মান উন্নত হয়েছে। চিকিৎসকে জানাল যে, সে আর যখন তখন সিগারেটের প্রতি টান অনুভব করছে না এবং অবসাদমুক্ত জীবন কাটাচ্ছে।

উপরের ঘটনাটি বাস্তব জীবনের ওপর ভিত্তি করেই বোঝানোর জন্য তৈরি। বহু মানুষই 'কোল্ড টার্কি' কাটিতে উঠতে সক্ষম এবং নিজেরাই নিকোটিন আসক্তি থেকে মুক্ত হতে পারে। যদিও কোল্ড টার্কি পদ্ধতিটি সাইকিয়াট্রিস্টরা অনুমোদন করেন না। অন্যান্য চিকিৎসকের সহায়তা প্রয়োজন হয়। যদি ধূমপান ছাড়তে চেয়েও কেউ সফল না হয়, তার নিরাশ হওয়া ঠিক নয়। কিছুটা সহায়তা পেলে একজনের পক্ষে আসক্তি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। সেক্ষেত্রে সাইকিয়াট্রিস্টকে সাহায্যের জন্য জানানো যেতেই পারে।  

হিসেব মতো মাত্র তিন শতাংশ ধূমপায়ী নিজে থেকে এই অভ্যাস ছাড়তে পারে। অধিকাংশেরই পেশাদারদের সাহায্য প্রয়োজন। তামাকের আসক্তি কাটানো সহজ নয়। এজন্য কারও সহায়তা গ্রহণ সবসময়ই সঠিক।  

বহু ক্ষেত্রেই পরিবারের কোনও সদস্য বা বন্ধু আসক্ত ব্যক্তির চিকিৎসা করানো বা মনোবৈজ্ঞানিকের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। চিকিৎসক বা কাউন্সেলর রোগীকে প্রশ্ন করে আসক্তির গভীরতার বিষয়ে নিশ্চিত হন। আসক্তের স্ট্রম টেস্ট বা ওই ধরনের পদ্ধতিতে রোগের মাত্রা নির্ধারণ করে চিকিৎসার সেরা পদ্ধতি অবলম্বন করা সম্ভব। এর জন্য আসক্ত ব্যক্তি ও তার বন্ধু বা বাড়ির লোকের সঙ্গে আলোচনা করে বিষয়গুলি নির্ণয় করা দরকার।  

ড্রাগ বা অ্যালকোহল আসক্তের সঙ্গে নিকোটিন আসক্তের চিকিৎসার তফাত রয়েছে। এতে রোগী চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ফিরে যায়। এখানে চিকিৎসার মূল লক্ষ্য থাকে, আসক্তি কাটানোর জন্য বা ধূমপান ছাড়ার জন্য ওই ব্যক্তিকে মানসিকভাবে উদ্‌বুদ্ধ করা। এটা করার জন্য তাকে অধূমপায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে সাহায্য করতে হয়। যাতে তারা যে কোনও ধরনের প্রতিবন্ধকতা বা উস্কানির সামনে পড়লেও তা কাটিয়ে উঠতে সফল হতে পারে।  

সাধারণত তামাক ব্যবহারকারীকে 'কুইক ডেট' বা একটা নির্দিষ্ট দিন বেছে নিতে বলা হয়। ছেড়ে দেওয়ার পদ্ধতিকে সহজ করে নেওয়ার জন্য যাতে তারা নিজেকে তৈরি করে নিতে পারে। তাদের কিছু ওষুধ দেওয়া হয়, যা উইথড্র্য়াল সিম্পটম কাটাতে সাহায্য করে।  

রোগীকে কোনও সহায়ক গোষ্ঠীর সঙ্গে মিলিত হয়ে উইথড্রয়াল সিম্পটম কাটিয়ে উঠতে এবং নেশা ছেড়ে দেওয়ার সক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করা উচিত। একই সঙ্গে নিকোটিনের ব্যবহার ও ত্যাগ করার বিষয়ে সচেতন হওয়া দরকার। বন্ধুবান্ধব, পরিবার ও সহায়ক গোষ্ঠীর মানুষজন রোগীকে দীর্ঘ সময় ধরে আসক্তি এবং তামাক মুক্ত হতে সাহায্য করবে।     

Related Stories

No stories found.
logo
হোয়াইট সোয়ান ফাউন্ডেশন
bengali.whiteswanfoundation.org