অভ্যাস কীভাবে আসক্তিতে পরিণত হয়
চিন্তা করুন যে আপনি প্রথমবার জিমে গেছেন। প্রথম প্রথম জিমে গিয়ে শরীরচর্চা শুরু করার জন্য আমাদের ঠিক সময়ে ঘুম থেকে ওঠার অনেক চেষ্টা করতে হয়। তারপর সেই কাজ প্রতিদিন করতে করতে তা রুটিনে পরিণত হয় এবং কাজের শুরুতে যতটা কষ্ট করে আমাদের চেষ্টা করতে হয় পরের দিকে আর ততটা কষ্ট আমাদের হয় না। একইরকমভাবে জুয়া খেলা, সিগারেট খাওয়া, অনিয়ন্ত্রিত মদ্যপান, দাঁত ব্রাশ করা প্রভৃতি কাজ প্রতিদিন করতে করতে তা আমাদের অভ্যাস হয়ে ওঠে।
কীভাবে গড়ে ওঠে এই অভ্যাসগুলো? এবং কয়েকটি অভ্যাস কীভাবে আসক্তিতে পরিণত হয়?
কীভাবে আমাদের মধ্যে অভ্যাস গড়ে ওঠে?
অভ্যাস গড়ে ওঠার তিনটি ধাপ বা পর্যায় রয়েছে। প্রথম হল কিয়ু (বা কনটেক্সট বা আচরণ অথবা কাজের ধরন), দ্বিতীয় হল রেসপন্স বা জবাব এবং তৃতীয় হল রিওয়ার্ড বা ফলাফল, এগুলো একটি লক্ষ্যে চালিত হয়। পরিবেশগত আচরণের নানারকম উত্তর দিই আমরা এবং আচরণ ও তার ফলাফলের সঙ্গে আমাদের মস্তিষ্কের যোগ থাকে। এভাবেই আমরা এক কাজ বারবার করতে শিখি। আর এই কাজ বা আচরণ একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্যই আমাদের মধ্যে অভ্যাস গড়ে ওঠে। বৃহত্তর ক্ষেত্রে এই লক্ষ্যগুলো নমনীয় ও পরিবর্তনশীল হয়, কিন্তু আমাদের অভ্যাসগুলো ক্রমশ স্থায়ী হয়ে পড়ে। যদি অভ্যাসগুলোর উদ্দেশ্য বা লক্ষ্যের আর গুরুত্ব না-ও থাকে তাহলেও তাদের কর্মসূচি এক জায়গাতেই স্থায়ী হয়।
এর সঙ্গে মস্তিষ্কের নিউরাল সার্কিটের যোগ থাকার ফলে অভ্যাসগুলো ক্রমশ স্থায়ী হয়ে ওঠে। বিশেষ করে যদি তার থেকে স্বস্তি বা ইতিবাচক সাড়া মেলে তাহলে তার স্থায়িত্ব দীর্ঘমেয়াদি হয়। এই কারণেই মানুষ তার দীর্ঘদিনের অভ্যাস ভেঙে বেরোতে পারে না।
একটা উদাহরণ দিয়ে বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করা যেতে পারে। যেমন- আপনার খুব খিদে পেয়েছে। তখন আপনি হঠাৎ দেখতে পেলেন যে দোকানের ভিতরে খুব লোভনীয় কেক সাজানো রয়েছে। এখানে কেক হল কিয়ু; খিদে হল মানুষের আচরণ বা কনটেক্সট। কেকটা আপনি খেয়ে আচরণের জবাব দিলেন; এর ফলে আপনার মধ্যে ভালো অনুভূতি জন্মালো এবং আপনার শরীর বারবার এই প্রক্রিয়া বজায় রাখার চেষ্টা শুরু করল (আর এটাই হল চূড়ান্ত লক্ষ্য)। এখানে অতিরিক্ত এক প্রকার ইতিবাচক সাড়াও মেলা সম্ভব হয়। যেমন - কেক খাওয়ার পরে আপনার ভালো লাগলে সেই আচরণ আপনাকে উদ্বুদ্ধ করে তুলবে। তাই পরের বার যখনই আপনি কেক দেখতে পাবেন তখনই আমাদের মস্তিষ্ক অটোপাইলট হিসেবে কাজ করে ওই কেক খেতে আপনাকে বারবার উৎসাহ জোগাবে।
প্রকৃতিগতভাবে এই ধরনের আচরণের মধ্যে কোনও ভুল নেই। কিন্তু যখন তা উপকারের চেয়ে অপকার করে বেশি তখন আমাদের মধ্যে বদ অভ্যাসের জন্ম হয়। যেমন- কারও যদি মানসিক চাপ দেখা দেয় তাহলে তার মিষ্টি জাতীয় খাবার খাওয়ার প্রবণতা জাগে। যখন আমরা মিষ্টি জাতীয় খাবার খাই তখন আমাদের দৈহিক সংকেতের মধ্য দিয়ে আমরা কী খাচ্ছি সেই খবর মস্তিষ্কে পৌঁছায়। তাই যখন আমরা মানসিক চাপ অনুভব করি তখন মস্তিষ্কই আমাদের কেক বা আইসক্রিম খেতে উদ্বুদ্ধ করে। কারণ আগে ওই খাবার খেয়ে আমাদের ভালো অনুভূতি হয়েছিল, তাই বারবার সেই অনুভূতি জাগার ইচ্ছে আমাদের মধ্য জাগে। এটা একপ্রকার প্রতিফলনের মতো কাজ করে। ভালো লাগার উপরে আমাদের কোনও নিয়ন্ত্রণ থাকে না।
এক্ষেত্রে আরেকটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। যেমন- সিগারেট খাওয়া। আমাদের প্রত্যেকেরই এমন কিছু বন্ধুবান্ধব থাকতে পারে যারা হাতে সিগারেট নিয়ে খুব স্বস্তি পায়, গাড়ি চালানোর সময়ে মুখে কায়দা করে সিগারেট ধরায় আর ধোঁয়া ছাড়ে। তখন সেই অনুভূতি খুবই সুখের মনে হয়। মানুষ তখন নিজেকে ভিড়ের মধ্য থেকে আলাদা মানুষ বলে মনে করে। কিন্তু বহুবার চেষ্টা করা সত্ত্বেও কলেজ ছাড়ার ১৫ বছর পরেও মানুষ সিগারেট খাওয়া বজায় রাখে। হয়তো এই চেষ্টা কখনও কখনও সফল হলেও, যখনই মানুষ কোনও মানসিক চাপের মধ্যে পড়ে তখনই সে আবার সিগারেট খাওয়া ধরে।
মানসিক চাপের মধ্যে পড়লে আমাদের মস্তিষ্কে কী ঘটে?
এক্ষেত্রে মস্তিষ্কের প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স মুখ্য ভূমিকা নেয়। মস্তিষ্কের এই অংশ আমাদের যুক্তিবোধ, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা এবং সৃষ্টিশীলতা গড়ে তুলতে সাহায্য করে। সেক্ষত্রে অনিয়ন্ত্রিত মদ্যপান বা সিগারেট খাওয়া যে খারাপ অভ্যাস তা প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স আমাদের জানিয়ে দেয়।
মানসিক চাপের পরিস্থিতিতে মস্তিষ্কের এই অংশটাই প্রথম তার কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। এর ফলে আমাদের যুক্তিবোধ ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই কারণে মানুষ মানসিক চাপের শিকার হলে তার মধ্যে বদ অভ্যাস গড়ে ওঠার প্রবণতা দেখা দেয়। যদিও সে জানে যে এই বদ অভ্যাস তাকে কোনওভাবেই সাহায্য করবে না।
রিওয়ার্ড বা ফলাফল সংক্রান্ত শিক্ষা থেকে আমাদের অভ্যাসগুলো গড়ে ওঠে। অভ্যাস আমাদের বেঁচে থাকতে সাহায্য করলেও, কিছু অভ্যাস ঘটনাক্রমে আমাদের ক্ষতিও করে থাকে। যেমন- সমগ্র পৃথিবীতে মৃত্যুর অন্যতম প্রতিষেধক রূপী কারণ হল ওবেসিটি এবং তামাক।
সব অভ্যাসের একটা দৃঢ় ফলাফল রয়েছে, যা মস্তিষ্ককে সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে যে কীভাবে একটা অভ্যাস প্রথমবারের পরে দ্বিতীয়, তৃতীয় এবং চতুর্থ বার একইরকমভাবে কাজ করবে।
কিন্তু জুয়া খেলার মতো আসক্তির ক্ষেত্রে কী ঘটে? একজন বিহেভায়রল সাইকোলজিস্ট স্টিফেন কেনডাল, যিনি অভ্যাস এবং তার দৃঢ়তা বা শক্তিশালী ফলাফল নিয়ে গবেষণা করেছেন, তিনি অভ্যাসের শক্তি ও তার ফলাফলের বিষয়টা ভালোভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি দু'টি পাখির বাসায় দুটো পায়রা রেখেছিলেন এবং তাদের কাছে ছিল একটি করে লিভার বা ভারত্তোলক দণ্ড। একটা বাসার পায়রা প্রতিবার দণ্ড নাড়ালে খাবার খেত। আবার অন্য বাসার পায়রাটির খাওয়ার ঝোঁক স্বতঃস্ফূর্তভাবে ছিল। কেনডাল লক্ষ্য করেছিলেন যে দ্বিতীয় বাসার পায়রাটার কাছে রাখা লিভার অন্যটার চেয়ে বেশিবার নাড়ানো হয়েছিল।
জুয়া খেলার ক্ষেত্রেও এই একইরকম নীতি কাজ করে। এক্ষেত্রে কৌতূহলের বশবর্তী হয়ে মানুষের মধ্যে যা আছে তার থেকে বেশি পাওয়ার লোভ পেয়ে বসে। বাচ্চারা যখন কোনও যন্ত্রপাতি নিয়ে খেলা করে তখনও এই একই নীতির প্রয়োগ ঘটে। কেনডাল পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরে বিষয়টা ব্যাখ্যা করে বলেছিলেন যে অভ্যাসের শক্তি বারবার ঘটা ফলাফলের মধ্য দিয়ে ক্রমশ দৃঢ় হয়।
অভ্যাসগুলো যখন আমাদের সামাজিক, ব্যক্তিগত এবং পেশাগত জীবনকে ক্ষতিগ্রস্ত করে তোলে তখনই তা সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। যখন কেউ সিগারেট না খেয়ে কোনও কাজ ঠিকঠাক করতে পারবে না বা সামান্য মানসিক চাপেই প্রত্যেকেবার চকোলেট খেতে বাধ্য হবে তখন নিজেকে পরীক্ষার করার প্রয়োজন পড়ে। প্রত্যেকটা আসক্তির মূলে থাকে মানুষের অভ্যাস। যদিও আসক্তির পিছনে আরও অন্যান্য উপাদান যেমন- তাড়না, হঠকারী মনোভাব প্রভৃতি থাকে, তবু অন্যান্য অভ্যাসের মতো আসক্তির অভ্যাসের কার্যকারণ একইরকম হয়।
এই বিষয়ে আরও জানতে পড়ুন- আপনি কি অভ্যাস ভাঙতে পারেন?