নার্কোলেপ্সি
নার্কোলেপ্সি কী?
নার্কোলেপ্সি এক ধরনের স্নায়বিক ব্যাধি যা মানুষের মস্তিস্কের সেই জায়গাটাকে প্রভাবিত করে যেটা আমাদের নিদ্রা আর জাগরণ কে সঞ্চালনা করে। এই ব্যাধিতে আক্রান্ত রোগীর দিনের বেলায় খুব ঘুম পায় বা হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়েন। হঠাৎ করে ঘুমিয়ে পড়ার দৃষ্টান্তগুলো আচমকাই হয়, স্থান-কাল নির্বিশেষে। নার্কোলেপ্সিতে আক্রান্ত ব্যক্তি গাড়ি চালাতে চালাতে, কথা বলতে বলতে, এমনকি খেতে খেতেও হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়তে পারেন। বেশিরভাগ রোগী জানেন না যে তাঁরা নার্কোলেপ্সিতে ভুগছেন। এটি একটি গুরুতর ব্যাধি, কিন্তু নিয়মিত ওষুধ খেলে আর জীবনশৈলীতে কিছু পরিবর্তন আনলে নার্কোলেপ্সিকে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।
সাধারন অবস্থায় ক্লান্তি বা ঝিমুনিভাব অনুভব করার মানেই এই নয় যে নার্কোলেপ্সি হয়েছে। অন্য কোন নিদ্রা বিকার, মানসিক সমস্যা বা সঠিক পরিমাণে ঘুমের অভাবে এই সমস্ত উপসর্গ দেখা দিতে পারে। আপনার যদি মনে হয় যে অনেক দীর্ঘ সময় ধরে আপনি দিনেরবেলায় অতিরিক্ত ঝিমিয়ে থাকছেন বা হঠাৎ করে প্রায়ই ঘুমিয়ে পড়ছেন তাহলে দেরি না করে অবিলম্বে কোন মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।
নার্কোলেপ্সীর মুখ্য উপসর্গগুলো কী?
নার্কোলেপ্সির মুখ্য উপসর্গগুলো হল -
দিনের বেলায় অতিরিক্ত ঝিমুনিভাব – রাতে ভালো করে ঘুমানোর পরেও সারাদিন ধরে আপনার ক্লান্ত লাগে। এর ফলে আপনি হয়ত অল্পক্ষণের জন্য ঘুমিয়ে নিয়ে সতেজ অনুভব করেন কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই আবার আপনার ক্লান্ত লাগতে শুরু করে।
কেটাপ্লেক্সি – একধরনের শারীরিক স্থিতি যেটায় মাংসপেশীর ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যায়। শরীরের কোন মাংসপেশী এতে প্রভাবিত হচ্ছে তাঁর ওপর নির্ভর করে রোগী কি ধরনের বিকারের সম্মুখীন হতে পারেন। উচ্চারণ অস্পষ্ট হয়ে যেতে পারে, বা হাঁটু দুর্বল হয়ে পড়ে যেতে পারেন। অবশ্য সমস্ত নারকোলেপ্সি রোগীর কেটাপ্লেক্সি হয় এমন না।
বিভ্রম – ঘুমিয়ে পড়ার ঠিক আগে মানসিক বিভ্রমের জন্য কখনো কখনো আপনি কাল্পনিক দৃশ্য দেখতে পারেন। যেহেতু এইসব বিভ্রম জেগে থাকা অবস্থায় দেখা যায়, দৃশ্যগুলো সত্যি মনে হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এইসব বিভ্রম থেকে আপনার মনের ভয় আর আতঙ্ক আরো বেড়ে যেতে পারে।
স্মৃতিভ্রম – আধো ঘুমের মধ্যে দেখা বা শোনা অনেক কথা পরবর্তী সময় মনে করতে অসুবিধে হতে পারে আপনার।
ঘুমের মধ্যে অসাড় ভাব –ঘুমিয়ে পড়া বা ঘুম থেকে ওঠার সময় আপনি কথা বলার চেষ্টা করে বা ওঠার চেষ্টা করে অসাড় ভাব অনুভব করতে পারেন। এই অবস্থা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না – এক বা দুই মিনিট। এই সময় আপনি শ্বাসরুদ্ধ বোধ করবেন না কিন্তু অনুভুতিটায় আপনার ভিতিভাব বেড়ে যেতে পারে।
যদি আপনি বা আপনার চেনা কোনো মানুষের মধ্যে এইসব উপসর্গ লক্ষ্য করেন, সময় নষ্ট না করে অবিলম্বে কোনো মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।
নার্কোলেপ্সি কী কারণে হয়?
নার্কোলেপ্সি হওয়ার সঠিক কারণ এখনো জানা যায়নি। যদিও গবেষকদের মতে জিনগত কারনে মস্তিকের হাইপোক্রেটিন রাসায়নিকের ঘাটতির ফলে আক্রান্ত ব্যক্তি হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়েন বা জেগে যান।
নার্কোলেপ্সির চিকিৎসা
নার্কোলেপ্সি পুরোপুরি সারিয়ে তোলা যায় না। কিন্তু ওষুধ আর জীবনশৈলীতে কিছু কিছু পরিবর্তন এনে নার্কোলেপ্সির প্রভাব আয়ত্তের মধ্যে রাখা যায়। আপনাকে দিনের বেলা জাগিয়ে রাখার জন্য ডাক্তার কিছু উদ্দীপক ওষুধ দিতে পারেন, অ্যান্টিডিপ্রেসেন্টের সাহায্যে কেটাপ্লেক্সি, বিভ্রম আর ঘুমের মধ্যে অসাড়তা নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।
জীবনশৈলীতে কিছু পরিবর্তনের সাহায্যে নার্কোলেপ্সির উপসর্গ আয়ত্তের মধ্যে রাখা সম্ভব। রুটিন মেনে ঘুমানো আর দিনের বেলায় অল্প সময় বিশ্রাম নিলে ঝিমুনিভাব নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। সক্রিয়তা বজায় রাখার জন্য নিয়মিত ব্যায়াম করা উচিৎ। মদ, তামাক আর ক্যাফেইন সেবন এড়িয়ে চলা উচিৎ।
নার্কোলেপ্সি রোগীর শুশ্রূষা
নার্কোলেপ্সি বা তার উপসর্গ সম্বন্ধে সাধারণ মানুষের স্পষ্ট ধারনা নেই এবং অনেক ক্ষেত্রে নার্কোলেপ্সি রোগীদের বিদ্রূপের সম্মুখীন হতে হয়। যেমন ধরুন অফিসে যদি কোন কর্মচারী ঝিমুতে থাকেন বা হঠাৎ হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়েন, তাঁকে অনেক নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হতে হয়। এই পরিস্থিতিতে শুশ্রূষাকারী হিসেবে রোগীকে উৎসাহিত করতে হবে যাতে তিনি বিমর্ষ না হয়ে পড়েন। তাঁর সাথে সমস্যা নিয়ে কথা বলুন, আলোচনা করুন, এবং তাঁকে মনোবিদের পরামর্শ নিতে এবং মদ, তামাক আর ক্যাফেইন সেবন থেকে বিরত থাকতে উত্সাহিত করুন। তাঁকে বোঝান যে আপনি তাঁর সঙ্গে আছেন এবং তাঁর সমস্যা বোঝেন। ওষুধের সাথে সাথে নার্কোলেপ্সি রোগীদের পরিবার এবং বন্ধুবান্ধদের সহযোগিতার খুব প্রয়োজন হয়।
নার্কোলেপ্সির মোকাবিলা
নার্কোলেপ্সি নিয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপন করা কঠিন কিন্তু জীবনশৈলীতে কিছু কিছু পরিবর্তন এনে আপনি আনায়াসে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারবেন। প্রথমত, আপনাকে নিজের আশপাশের লোকেদের নার্কোলেপ্সি সম্বন্ধে জানাতে হবে। নিজের সমস্যা আপনার সহকর্মী বা শিক্ষকদের খুলে বলুন, যাতে তাঁরা আপনাকে বিশ্রাম নিতে সাহায্য করতে পারেন। সামান্যতম ঝিমুনি অনুভব করলে গাড়ি চালানো বা একাগ্রতার প্রয়োজন এমন কোন কাজ করবেন না। যদি গাড়ি চালাতে চালাতে হঠাৎ ঘুম পায়, গাড়ি রাস্তার একপাশে দাঁড় করিয়ে বিশ্রাম নিন। নিয়মিত ব্যায়াম করুন, এতে আপনার শারীরিক স্ফূর্তি বাড়বে। মদ, তামাক আর ক্যাফেইন সেবন এড়িয়ে চলুন। আপনার ডাক্তারের যদি নির্দিষ্ট চিকিৎসা পরিকল্পনা থাকে, আপনাকে অবশ্যই সেটাকে কঠোরভাবে মেনে চলতে হবে এবং ওষুধের কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বা উপসর্গে কোন পরিবর্তন লক্ষ্য করলে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসককে জানান।