মানসিক অসুস্থতা বিষয়ক আলাপ-আলোচনা
মানসিক অসুস্থতার বিষয়টি খুবই সংবেদনশীল, বিশেষ করে যদি এমন একজন মানুষের সাথে এই বিষয়ে কথা বলতে হয় যার মধ্যে মানসিক অসুখের লক্ষণ রয়েছে। প্রায়শই দেখা যায়, পরিবারের সদস্য এবং বন্ধুরা তাদের কাছের মানুষের মেজাজ এবং আচরণের পরিবর্তনগুলো ধরতে পারে এবং সে কথা কীভাবে কাছের মানুষজনকে বলবে তার উপায় বা রাস্তা খুঁজে বের করার চেষ্টা করে। এইসময় পরিবারের লোকজন বা বন্ধুদের মনে প্রশ্ন জাগে, ''কীভাবে আমি আমার কাছের মানুষকে জানাবো বা বোঝাবো যে আমি তাকে নিয়ে চিন্তায় রয়েছি ও তাকে আমি সাহায্য করতে চাই? মানসিক অসুখের সঙ্গে কলঙ্কের বোধ এমনভাবে জড়িয়ে রয়েছে যে আমি যদি তাকে একজন মনোবিদ বা কাউন্সেলরের কাছে যেতে বলি তাহলে সেই পরামর্শ সে কি খোলা মনে মেনে নেবে?''
মানসিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তিদের নিয়ে এধরনের চিন্তাভাবনাগুলি খুবই স্বাভাবিক। অধিকাংশ পরিচর্যাকারী তাদের কাছের মানুষদের সঙ্গে কথা বলার আগে এসব বিষয়ে ভাবনাচিন্তা করেই থাকেন। যদি কেউ এহেন পরিস্থিতিতে পড়ে তাহলে সে কীভাবে বিষয়টি নিয়ে কথাবার্তা বলবে, সেই সম্পর্কে এখানে আলোচনা করা হয়েছে:
সমস্যাটিকে বুঝতে হবে
প্রথমেই বোঝা দরকার যে, একজন মানসিকভাবে অসুস্থ মানুষ ঠিক কী অবস্থার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। মানসিক অসুস্থতা সম্পর্কে পড়াশোনা করতে হবে এবং একজন মানসিক রুগির মধ্যে কী ধরনের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে সেই নির্দিষ্ট বিষয়টিকে জানা ও বোঝা জরুরি। তথ্যগুলো একত্রিত করার জন্য প্রয়োজনীয় সময় দিতে হবে এবং এই বিষয়ে আরও সাহায্যের প্রয়োজন হলে অন্যান্য মানুষজনের সঙ্গে কথাও বলা যেতে পারে। এটা বোঝা জরুরী যে শারীরিক অসুস্থতার আর মানসিক অসুস্থতার মধ্যে পার্থক্য নেই, দু'টোরই চিকিৎসা রয়েছে এবং মানসিক রোগ যেকোনো ব্যক্তির হতে পারে। এই কথাগুলো মনে রাখলে আতঙ্কিত না হয়ে কাছের মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল ব্যবহার করে তাদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়াটা অনেক সহজ।
একথাও মনে রাখা জরুরি যে মানসিক অসুখের বিভিন্ন সমস্যা সম্পর্কে পড়াশোনা থাকলে তা একজনকে তার কাছের মানুষের অসুখ ও রুগির সম্বন্ধে সচেতন থাকতে সাহায্য করে, কিন্তু এটা কখনই একজন মনোবিদের সাহায্য ও যত্নের বিকল্প হয়ে উঠতে পারে না।
সাহায্যের জন্য কথোপকথন
ভেবে দেখুনঃ এমন কেউ আছেন কি যিনি এই আলোচনা বা কথাবার্তায় আপনাকে সাহায্য করতে পারবেন? বা এমন কোনও মানুষ আছেন যিনি এই কাজের জন্য একদম যোগ্য? সবচেয়ে ভালো হয় যদি এই আলোচনা এমন একজন মানুষ শুরু করেন যিনি আপনাদের কাছের মানুষের অর্থাৎ যিনি অসুস্থ ব্যক্তির খুব প্রিয়। এমন কোনও মানুষ যিনি অসুস্থ ব্যক্তির বিশ্বাসভাজন হয়ে উঠতে সক্ষম এবং যার সাথে মনোরুগির তার অসুস্থতা নিয়ে আলাপ-আলোচনা করার সময় কখনোই ভাববে না যে সে অবহেলিত বা কোনঠাসা হয়ে পড়ছে।
সাধারণভাবে আলোচনা হওয়াই বাঞ্ছনীয়
অসুস্থ মানুষদের সঙ্গে তাদের আচরণের পরিবর্তন নিয়ে অত্যন্ত সাধারণ ভাষায় কথা বলা উচিত। বোঝার চেষ্টা করতে হবে যে রুগি তার সমস্যা বা লক্ষণ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল কি না। স্কিৎজোফ্রেনিয়ার রুগিদের ছাড়া অধিকাংশ মনের অসুখে আক্রান্ত রুগি তাদের আচার-আচরণের বদল সম্পর্কে সচেতন থাকে। তারা অসুখে আক্রান্ত হওয়ার আগের এবং পরের আচরণের পরিবর্তন বা অন্যদের থেকে কতটা আলাদা আচরণ করছে সে বিষয়ে তারা সচেতন থাকে। যারা মানসিক উদ্বিগ্নতা এবং অবসাদের শিকার তাদের মধ্যেও নিজেদের অসুখ নিয়ে সচেতনতা দেখা যায়।
রুগির সঙ্গে কথাবার্তা চলার সময়ে তাকে জিজ্ঞাসা করা প্রয়োজন যে সে কেমন বোধ করছে। অসুখে আক্রান্ত হওয়ার পরে কি তার নিজেকে অন্যরকম মনে হচ্ছে? যদি সে নিজের মধ্যে অনুভব করা পরিবর্তনের কথা কারোর কাছে বলতে চায় তাহলে নিজের কোনও মতামত না জানিয়ে তার কথা মন দিয়ে শুনতে হবে।
রোগীকে সহানুভূতি জানানো
সহানুভূতি বা সহমর্মিতা মানুষের এমন এক গুণ যা একজনকে অন্যজনের সমস্যা, দুঃখ, কষ্ট বুঝতে সাহায্য করে। অসুস্থ মানুষকে সহানুভূতি দেখিয়ে এটাই বোঝাতে হবে যে তাদের মধ্যে যে পরিবর্তন এসেছে তা সত্যিই খুব ক্লান্তিকর এবং হতাশাজনক। তাদেরকে এই বলে আশ্বস্ত করতে হবে যে মানসিক রোগের চিকিৎসা রয়েছে এবং চিকিৎসা করার জন্য বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিরাও আছেন। এছাড়া তাদেরকে এটাও বোঝানো দরকার যে কোনওভাবেই এর প্রভাব তার সমস্ত জীবনের উপর পড়বে না। সহমর্মিতার সঙ্গে একজন রুগিকে সাহায্য করতে গেলে এটাও বুঝতে পারা যাবে যে, অসুস্থ মানুষের আচার আচরণে যে পরিবর্তন হয় তার উপর তাদের কোনও নিয়ন্ত্রণ থাকে না এবং এর ফলে তাদের কীরকম অনুভূতি হয় তাও উপলব্ধি করা সম্ভব।
মনোরোগীদের চিন্তাভাবনা বা দৃষ্টিভঙ্গিকে সম্মান করা জরুরি
এক পর্যায় থেকে পরের পর্যায় যাওয়ার ক্ষেত্রে একজন অসুস্থ মানুষের ইচ্ছা বা পছন্দকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। তাদেরকে জিজ্ঞাসা করতে হবে যে তারা সাহায্য নিতে রাজি কিনা। তাদের পছন্দের উপরেই বিষয়টা ছেড়ে দিতে হবে। যেমন- আপনি কি সাহায্যের বিষয় নিয়ে চিন্তাভাবনা করছেন? তুমি কি অন্যের সাহায্য নিতে প্রস্তুত?
একজন অসুস্থ মানুষের চিন্তাভাবনাকে গুরুত্ব সহকারে বিচার করা দরকার। যদি আপনার কাছের মানুষকে জোর করে চিকিৎসা করানো হয়, তাহলে সে চিকিৎসা করাতে রাজি নাও হতে পারে এবং সেই চিকিৎসা কার্যকরীও হবে না। মানসিক স্বাস্থ্যের বিশেষজ্ঞদের মতে রুগি যদি নিজে থেকে চিকিৎসার সাহায্যে নিজেকে সারিয়ে তুলতে ইচ্ছুক হয় তাহলে সেটাই হবে সেরা চিকিৎসা। এক্ষেত্রে অবশ্য গুরুতর মানসিক রোগ যেমন স্কিৎজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে তাদের অসুখ নিয়ে চিন্তাভাবনার অভাব দেখা যায় এবং যারা সামগ্রিকভাবে মানসিক দিক দিয়ে পিছিয়ে পড়েছে, তাদের ক্ষেত্রেও মানসিক উৎকর্ষতার খামতি লক্ষ্য করা যায়। এই সমস্যাগুলো একমাত্র গুরুতর অসুখের ক্ষেত্রেই দেখা যায় যেখানে রুগিরা মানসিক স্বাস্থ্যের বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিয়ে চিকিৎসা করাতে রাজি হয় না। এক্ষেত্রে অসুস্থ মানুষ তার চিকিৎসা পদ্ধতিতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে না।
বাড়িয়ে দিন আপনার সাহায্যের হাত
একজন রুগিকে সাহায্যের ব্যাপারে আশ্বস্ত করা দরকার। এবং প্রয়োজন না হলে তার দেওয়া তথ্যগুলো বাইরে প্রকাশ করা উচিত নয়। একজন দক্ষ মানসিক স্বাস্থ্যের বিশেষজ্ঞের কাছে আপনি আপনার কাছের মানুষকে নিয়ে যেতে পারেন। এভাবেই কাছের মানুষের রোগ নির্ধারণের ক্ষেত্রে আপনি কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে পারেন।
যদি আপনি দিশাহারা বোধ করেন তাহলে আপনারও প্রয়োজন সাহায্যের
একজন রোগীর অসুস্থতার সময়কালীন প্রক্রিয়াগুলো চলার সময়ে যদি আপনি দিশাহারা বোধ করেন বা আপনার মনে সন্দেহ বা অপরাধ বোধ জাগে তাহলে একজন কাউন্সেলর বা মানসিক স্বাস্থ্যের বিশেষজ্ঞের সঙ্গে আপনার যোগাযোগ করা প্রয়োজন। নিজের অনুভূতিগুলি ধরা ও বোঝা দরকার। আমরা প্রত্যেকে নিজেদের ক্ষমতা অনুযায়ী মানসিক সমস্যার বাধাগুলোর মোকাবিলা করি। আর এভাবেই রোগ নির্ণয়ে সাহায্য করি। এর মধ্য দিয়েই কাছের মানুষের জন্য সঠিক চিন্তাভাবনা করার উপায় থাকে। নিজেকে ইমোশনাল সাপোর্ট প্রদান করে আপনি আপনার কাছের মানুষের সাহায্যের এবং যত্নের জন্য সঠিক কৌশল অবলম্বন করতে সক্ষম হবেন।
এই প্রবন্ধটি লেখা হয়েছে দিল্লির ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট এবং অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ মেডিক্যাল সাইন্সেস থেকে পিএইচডি প্রাপক ডাক্তার গরিমা শ্রীবাস্তবের সক্রিয় সহযোগিতার উপর ভিত্তি করে।