জুয়ার নেশা এক প্রকার মানসিক ব্যাধি
জুয়ার নেশা এক ধরনের মানসিক রোগ - এর অর্থ কী?
জুয়া খেলা কখন সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়? জুয়ার নেশা যখন জুয়াড়িদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক এবং দৈনন্দিন জীবনে নিরানন্দের কারণ হয়ে ওঠে তখন তা গুরুতর সমস্যায় পরিণত হয়। জুয়াকে কেন্দ্র করে ৮৭.৫ শতাংশ হারে সৃষ্ট সমস্যা একজন জুয়াড়ির জীবনে ২৫ বছর বয়সের আগেই শুরু হয়। এডিএইচডি হীন বয়ঃসন্ধির তুলনায় এডিএইচডি যুক্ত বয়ঃসন্ধির ছেলে-মেয়েদের জীবনে জুয়া খেলাকে কেন্দ্র করে নানা সমস্যার জন্ম হয়।
(২০১৪ সালে নিমহান্সে হওয়া এক গবেষণার উপর নির্ভর করে এই তথ্য দেওয়া হয়েছে)
ভারত সহ পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে জুয়া খেলা বহু পুরনো এবং প্রচলিত একপ্রকার অবসর-বিনোদনের মাধ্যম। তবে জুয়া খেলতে খেলতে অনেক মানুষই নিজের জীবনের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে এবং এই আচরণের জন্যই তাদের গোটা জীবনটা সমস্যায় ভরে যায়। জীবনের সব গুরুত্বপূর্ণ কাজকর্ম ছেড়ে দিয়ে তারা শুধু জুয়া খেলার সুযোগ খোঁজে এবং জুয়ার মধ্যেই নিজেদের জীবনকে ডুবিয়ে রাখে। অনেকে টাকাপয়সা খুইয়ে এবং নানা বিপত্তি সত্ত্বেও জুয়া খেলা ছাড়তে পারে না। বহুবার জুয়ার নেশা থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করেও অনেকে শেষ পর্যন্ত জুয়া খেলা থেকে নিজেকে দূরে রাখতে পারে না। এটা অনেকটা ড্রাগের আসক্তির মতো। কারণ যারা মাদকাসক্ত হন তারা সবসময়ে মাদক ব্যবহারের জন্য ছুতো খোঁজেন। জুয়ার নেশার মতো মনের অসুখকে প্রথম প্রথম মানুষের হঠকারি মনোভাব বা আচরণ বলে মনে করা হত। কিন্তু এখন একে মাদকাসক্তির মতোই একপ্রকার আসক্তি হিসেবে দেখা হয়। মানসিক অব্যবস্থার বিভিন্ন ভাগ বা পর্যায় অনুযায়ী, যেমন- ডিএসএম-৫ (ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড স্ট্যাটিস্টিক্যাল ম্যানুয়াল অফ মেন্টাল ডিসঅর্ডার) এবং আইসিডি-১০ (ইন্টারন্যাশনাল ক্লাসিফিকেশন অফ ডিজিজ) অনুযায়ী এখন জুয়া খেলার তাড়নাকে একপ্রকার আসক্তি বলেই বিবেচনা করা হয়।
২ থেকে ৩ শতাংশ মানুষ নিজের আনন্দের জন্য জুয়া খেলে এবং এভাবেই তাদের মধ্যেও জুয়ার নেশা মানসিক রোগে পরিণত হতে পারে।
জুয়ার নেশার মতো মানসিক রোগের লক্ষণগুলো কী ধরনের হয়?
তিন ধরনের জুয়ার নেশা রয়েছে। যেমন- প্রথম হল 'ঝুঁকিপূর্ণ জুয়া'- যখন জুয়াড়ির মধ্যে জুয়ার নেশা তীব্র হলেও এর জন্য তাকে কোনও বিরুদ্ধ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে না। দ্বিতীয় হল- 'সমস্যাবহুল জুয়া'- যখন জুয়া খেলা জুয়াড়ির ব্যক্তিগত, পারিবারিক এবং আনন্দময় জীবনে দুঃখ-দুর্দশা ডেকে আনে। অন্যদিকে 'জুয়া যখন মানসিক রোগ' হিসেবে দেখা দেয় তখন মানুষ জুয়ার তাড়না থেকে নিজেকে কিছুতেই দূরে রাখতে পারে না। এই জুয়ার জন্য যদি সে তার সর্বস্ব হারিয়ে ফেলে তাতেও সে কিছুতেই জুয়ার নেশা ত্যাগ করতে পারে না। আর এই নেশা যখন চরমে পৌঁছায় তখন তা মানুষের জীবনে ধ্বংস ডেকে আনে।
জুয়ার নেশার মতো মানসিক রোগ একনাগাড়ে অনেকদিন স্থায়ী হয় এবং বারবার ফিরে আসে। জুয়ার আসক্তির বা জুয়ার নেশা যখন মানসিক অসুখে পরিণত হয় তখন তার কয়েকটি লক্ষণ দেখা যায়। সেগুলো হল-
জুয়া খেলা নিয়ে এদের মনে সবসময়ে একপ্রকার বদ্ধমূল ধারণা থাকে (যেমন- পূর্ববর্তী জুয়া খেলার অভিজ্ঞতা ভুলে এরা পরবর্তী খেলার পরিকল্পনা করে, টাকার ব্যবস্থা করে)।
জুয়া এই জাতীয় মানুষের ব্যক্তিগত সম্পর্ক, অর্থনৈতিক ক্ষেত্র এবং কাজের জগতে ক্ষতি ডেকে আনে।
এরা জুয়া খেলে মূলত জীবনের ছোট-বড় সমস্যার মুখোমুখি হওয়া থেকে পালানোর জন্য অথবা মানসিক উদ্বেগ, অপরাধ বোধ, অসহায়তা, অবসাদের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য।
তারা জুয়া খেলার হাত থেকে নিষ্কৃতি পেতে চেষ্টা করে কিন্তু তাদের প্রচেষ্টা সফল হয় না।
তারা তাদের জুয়ার প্রতি আসক্তি অন্যান্যদের কাছ থেকে গোপন রাখতে চেষ্টা করে।
তারা জুয়া খেলার নেশায় নিজেদের এতটাই জড়িয়ে ফেলে যে জীবনের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বগুলোকে অবহেলা করে।
তারা জুয়া খেলার জন্য অসৎ পথে টাকা রোজগার করা শুরু করে। এরা জুয়া খেলার জন্য অন্যের কাছ থেকে টাকা ধার করে এবং ক্রমশই তারা ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ে।
জুয়ার নেশার মতো মানসিক অসুখের পিছনে কী কারণ রয়েছে?
গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, অন্যান্য আসক্তির সমস্যার মতোই জুয়ার প্রতি নেশার পিছনে রয়েছে জিনগত, পারিপার্শ্বিক পরিবেশ এবং জৈবিক বা বায়োলজিকাল কারণ। এর সঙ্গে যুক্ত হয় মস্তিষ্কের একটি বিশেষ কার্যাবলী (রিওয়ার্ড পাথওয়ে)। এর ফলে আমরা যে কাজই করি না কেন তা করতে আমাদের খুবই ভালো লাগে এবং এর মধ্য দিয়ে নিউরোট্রান্সমিটার হিসেবে যে ডোপামিন নিঃসরণ হয় তা আমাদের মধ্যে একধরনের সন্তুষ্টির জন্ম দেয়। যে কোনও আসক্তির ক্ষেত্রে তা সে মাদকাসক্তি বা জুয়ার প্রতি আসক্তি যাই হোক না কেন, সেখানে প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স সক্রিয় হয়, যা আমাদের আবেগের তাড়নাকে অবদমিত করে, তাকে দুর্বল করে দেয়। গবেষকদের মতে যে সব মানুষের মধ্যে জুয়ার নেশা রয়েছে তাদের মধ্যে রিওয়ার্ড অংশ সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং জুয়ার নেশার মতো এই ধরনের আসক্তিমূলক আচরণ করাই এই অবস্থায় অগ্রাধিকার পায়।
জুয়া খেলার মতো মানসিক সমস্যার ক্ষেত্রে কী কী ঝুঁকি থাকে?
পারিবারিক ইতিহাস, ক্রমবর্ধমান মানসিক চাপ, ড্রাগের প্রতি আসক্তি এবং বয়স- সবকিছুর ক্ষেত্রেই জুয়া খেলার প্রভাব পড়তে পারে। অল্পবয়সি ছেলে-মেয়ে বিশেষ করে যারা বেশ খোলামেলা স্বভাবের হয়, তাদের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে আগ্রহ থাকে, চিন্তাভাবনা, মেজাজ-মর্জির হঠকারিতা থাকে, কাজকর্মের ক্ষেত্রে খুব অস্থিরতা দেখা যায়, ঝুঁকিপূর্ণ কাজের দিকে এদের মনোযোগ বেশি হয়। ফলে তাদের আচরণের মধ্যে নানারকম নেশার বস্তুর প্রতি আসক্তি জন্মাতে দেখা যায়। এই বিষয়ে একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা মনে রাখা জরুরি, অন্যান্য আসক্তিগত সমস্যার মতো জুয়ার আসক্তিও পুরুষদের ক্ষেত্রেই বেশি দেখা যায়।
কীভাবে এই ধরনের মানসিক রোগ নির্ণয় করা হয়?
এই রোগ নির্ধারণের ক্ষেত্রে রোগের লক্ষণগুলিকে অনেকদিন ধরে স্থায়ী হতে হবে (এবং এই ঘটনা ঘটার এক বছরের মধ্যেই একজন চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে)। মানসিক স্বাস্থ্যের বিশেষজ্ঞরা এই রোগ নির্ধারণের জন্য মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ, ব্যক্তির জীবনের ইতিহাস এবং আরও কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন।
মানুষের জীবনে জুয়ার নেশা কী কী জটিলতার সৃষ্টি করে?
জুয়ার নেশাজনিত মানসিক রোগের সমস্যা সাধারণত বহুদিন ধরে স্থায়ী হয় এবং যদি এর সঠিক চিকিৎসা না হয় তাহলে অন্যান্য আরও অনেক জটিলতা বেড়ে যেতে পারে। সেই সমস্যাগুলো হল-
মদ এবং ড্রাগের প্রতি আসক্তি
ব্যক্তিগত, পেশাগত এবং অর্থনৈতিক সমস্যা যেমন- সর্বস্বান্ত বা দেউলিয়া হয়ে যাওয়া
জুয়া খেলার উত্তেজনায় মানুষ হৃদ্রোগে আক্রান্ত হতে পারে
উদ্বেগজনিত সমস্যা
আত্মহত্যার প্রবণতা
জুয়ার নেশা দূর করার চিকিৎসা
এই রোগের চিকিৎসা তখনই কার্যকরী হয় যখন একজন রুগি এই চিকিৎসা প্রক্রিয়ায় সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়। এই রোগের চিকিৎসা মূলত করা হয় কগনিটিভ বিহেভেরিয়াল থেরাপির (সিবিটি) মাধ্যমে; মাদকাসক্তি দূর করতে যে ধরণের ওষুধ দেওয়া হয় সেই ওষুধ জুয়ার নেশা দূর করার ক্ষেত্রেও ব্যবহার করা হয় এবং এই রোগ সারাতে সাহায্য করে স্বনির্ভর গোষ্ঠী বা সেলফ্ হেল্প গ্রুপ। এক্ষেত্রে একটা বিষয় মনে রাখা জরুরি যে, ৭০ শতাংশের বেশি মানুষ, যারা জুয়ার নেশায় আক্রান্ত হয়, তাদের প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই মনোরোগের শিকার হওয়ার ইতিহাস থাকে।
জুয়ার নেশা যাদের মানসিক অসুখে পরিণত হয় তাদের প্রতি অন্যের যত্নশীলতা
যদি কেউ দেখেন যে তার কাছের মানুষ জুয়া খেলার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ছে তাহলে প্রথমে তার সমস্যাটা ভালো করে বুঝতে হবে এবং এই নেশা থেকে তাকে দূরে সরাতে উৎসাহ দিতে হবে। সঠিক সময়ে ইতিবাচক চিন্তাভাবনা করতে হবে এবং অতীতের কথা আলোচনা করা চলবে না। শুধুমাত্র বর্তমানের সমস্যার দিকে নজর দিতে হবে ও জুয়া কীভাবে একজন মানুষের জীবনে বিপদ ডেকে আনছে সেই বিষয় নিয়ে ভাবনাচিন্তা করা জরুরি। এক্ষেত্রে জুয়ার নেশায় আক্রান্ত ব্যক্তিকে কঠোর ভাষায় আক্রমণ করা একেবারেই সঠিক কাজ নয়। একবার যদি তারা ডাক্তার দেখিয়ে চিকিৎসা করাতে রাজি হয় তাহলে তার কাছের মানুষের উচিত তার পাশে থাকা এবং তার জন্য অনেক সময় ব্যয় করা। তবেই একজন মানুষকে সর্বনাশা নেশা থেকে দূরে রাখার প্রচেষ্টা সফল হয়। জুয়া খেলার মতো বদ অভ্যাস যে মানুষের জীবনে ধ্বংস ডেকে আনতে পারে সেই বিষয়ে একজন জুয়াড়িকে সতর্ক করা প্রয়োজন। এই প্রক্রিয়া এক একজনের ক্ষেত্রে এক একরকম হয়। যেমন- কাউকে জুয়াখানা বা ক্যাসিনোর বিজ্ঞাপন দেখিয়ে সতর্ক করা জরুরি, অথবা কারোর হাতে অনেক টাকা দিয়ে তাকে মনে করিয়ে দেওয়া উচিত যে এমন কাজ করা উচিত নয় যেখানে বিপদের সম্ভাবনা রয়েছে। আসলে বিপদ চেনানোর কাজে তাকে সাহায্য করা এবং সেই বিপদের মধ্যে যেন সে ঝাঁপ না দেয় সেদিকে লক্ষ্য রাখা একান্ত জরুরি।
যদি কাছের মানুষের জুয়া খেলার সমস্যা থাকে তাহলে একজন মানুষ নিজেকে কীভাবে সেই সমস্যার মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুত করবে
কাছের মানুষের আচরণের পরিবর্তনের জন্য নিজেকে দোষারোপ করা উচিত নয়। কারণ এক্ষেত্রে যে মানুষটি নেশা করছে না তার কোনও দায়িত্ব থাকে না।
নিজের চিন্তা বিশ্বাসভাজন বন্ধু এবং পরিবারের লোকের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া প্রয়োজন। এক্ষেত্রে একজন কাউন্সেলর বা প্রশিক্ষিত পেশাদারের সঙ্গেও কথাবার্তা বলা জরুরি।
যদি কারোর প্রিয়জনের জুয়ার নেশা তার অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায় তাহলে ওই নেশাগ্রস্ত মানুষটির সঙ্গে পারস্পরিক আলোচনা করে টাকা পয়সার সমস্যার বিষয়টি সমাধান করা জরুরি। যদি নেশাগ্রস্ত ব্যক্তি টাকা পয়সার বিষয়টি নিজের দখলে রাখতে চায় তাহলে অন্য ব্যবস্থা করতে হবে। যেমন- এক্ষেত্রে তার জন্য আলাদা ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খোলা দরকার।