পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার বা ব্যক্তিত্ব বিকার
ব্যক্তিত্ব কী?
একজন ব্যক্তি অন্যের সঙ্গে কীভাবে মেশেন তা বোঝাতেই মনস্তত্ব বিজ্ঞানে পার্সোনালিটি বা ব্যক্তিত্ব শব্দটি ব্যবহার করা হয়। আমাদের চালচলন বা ভাবভঙ্গী সবই এর অন্তর্গত। এই ব্যক্তিত্ব বংশানুক্রমে আমরা আমাদের মা-বাবা এবং বড় হবার সঙ্গে চারপাশের পরিবেশ থেকে শেখার ফলে গড়ে তুলি। এর ফলে আমরা সমাজে কোনটা ঠিক কোনটা বেঠিক এই সমস্ত শিখি। এর ফলে প্রত্যেকের মধ্যে আলাদা ভাবে জন্ম নেয় মৌলিক ব্যক্তিত্ব।
ব্যক্তিত্ব বিকার কী?
বাড়িতে বা কর্মস্থলে বা বিভিন্ন সম্পর্কের মধ্যে থাকবার কারণে আমাদের মধ্যে এক ব্যক্তিত্বের জন্ম নেয়। জীবনের বিভিন্ন পদে পরিবর্তনশীল পরিস্থিতিতে তা আমাদের চলতে সাহায্য করে। এই মৌলিক ব্যক্তিত্বের মধ্যে যখন কোনও সমস্যা দেখা দেয় তাঁকে পার্সোনালিটি ডিস্অর্ডার বা ব্যক্তিত্ব বিকার বলে। এর ফলে শুধু ব্যক্তির নিজেরই নয়, আশে পাশের লোকদেরও সমস্যা দেখা দেয়। বহু ক্ষেত্রেই তখন ব্যক্তি নতুন পরিবেশ বা পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারেন না। সামাজিক ব্যবস্থা মেনে নিতে বা আবেগের বহিঃপ্রকাশে তখন সমস্যা দেখা দেয়। এঁরা নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং কর্মপদ্ধতি সম্বন্ধে অত্যন্ত একগুঁয়ে ধারনা পোষণ করেন। ফলে নিত্য জীবনযাপনের প্রবল সমস্যা নিয়ে এরা প্রতিনিয়ত লড়াই করতে থাকেন।
“যতদূর মনে পড়ে, আমি কোথাও কারোর সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারতাম না। নিজের পরিবার-পরিজন, আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, সহপাঠী বা বন্ধু-বান্ধব; কাউকে পোষাত না। আমায় এই জীবনে আজ অবধি কেউ ভালোবাসেনি বা প্রাপ্য সম্মান দেয়নি। আমাকে কেউ বোঝার চেষ্টা করেনি, অথবা করতে চায়নি।
আমায় কেউ ভালবাসে না। আমি যত সবার কাছে যাবার চেষ্টা করেছি, তত তাঁরা আমায় দূরে সরিয়ে দিয়েছে। প্রতিটি দিনই যেন আমার কাছে এক নতুন অগ্নিপরীক্ষা। মাঝে মাঝে মনে হয় এই জীবন বেঁচে কী লাভ?
আমি নিজেকে শেষ করে দেবার ইচ্ছা ওদের সামনে প্রকাশও করেছি। আশা করেছিলাম তাতে ওদের মধ্যে কোনও পরিবর্তন লক্ষ করব। কিন্তু সবই অরণ্যে রোদন।
আমি ওদের ইচ্ছা অনুযায়ীও চলে দেখেছি। কিন্ত শত চেষ্টা করেও তাঁদের খুশী করতে পারিনি। ওদের জীবনে আমার কোনও অস্তিত্বই নেই। আমি একলা।”
(রোগটি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা দেবার উদ্দেশ্যে বাস্তব পরিস্থিতি অবলম্বনে এই কাল্পনিক কাহিনীটি বলা হল।)
মৌলিকতা বনাম বিকার
একজন ব্যাক্তির মৌলিক কোনও স্বভাব কে কিন্তু কখনই বিকার বলা যেতে পারে না। আমাদের অনেকেরই অনেক অদ্ভুত বা আলাদা চালচলন থাকে, কারও কম বা কারও বেশী। সহজ কথা বলতে গেলে, ব্যাক্তি বিকারের শিকার যিনি তাঁরও একই রকম চালচলন থাকবে। কিন্তু তার মাত্রা এতটাই বেশী হবে যে অন্যদের জীবনে তা সমস্যা দেখা দেবে।
এখানে এটাও মনে রাখা প্রয়োজন যে এর পেছনে শিক্ষা বা সংস্কৃতিও একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। কোন এক শ্রেণীর লোকের মধ্যে যে চালচলনগুলো স্বাভাবিক, তা অন্যদের কাছে অস্বাভাবিকও হতে পারে।
উদাহরণস্বরূপ, আমরা জানি যে প্রতেককে বিশ্বাস করা ঠিক নয়। এইবার এই অপরকে বিশ্বাস করার মানসিকতা নিয়ে যদি আমরা এক অপরিবর্তিত স্থানে দাঁড়াই তবে দেখা যাবে একপাশে রয়েছে অতি সরল কিছু লোক যাঁদের সহজেই ঠকানো সম্ভব, এবং ওপর পাশে কিছু লোক যারা দুনিয়ায় কাউকে বিশ্বাস করেন না। এঁদের মাঝে যারা পড়বেন তাঁদের কিন্তু সমাজে চলতে কোনও সমস্যা হবে না। তাঁরা নিজেদের বন্ধুবান্ধব বা আত্মীয়স্বজনকে বিশ্বাস করবেন, কিন্তু অচেনা লোকেদের কে কখনই করবেন না। তবে উপরোক্ত চরম দুটি অবস্থানে যারা থাকবেন তাঁরা কিন্তু ক্রমাগত সমস্যার মুখোমুখি হবেন।
লম্বা সময় জুড়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কিছু মৌলিক চালচলনের প্রকাশ থাকলেই ব্যক্তিত্ব বিকারে রোগনির্ণয় সম্ভব।
উদাহরণঃ অসামাজিক ব্যক্তিত্ব বিকারগ্রস্থ ব্যক্তিরা সাধারণত নিজের স্বার্থে অন্যকে সুকৌশলে পরিচালনা করে কাজ করিয়ে নেবার পক্ষপাতী হন। আশেপাশের লোকজনের প্রতি উদাসীন এবং উপেক্ষাসুলভ মানসিকতার জন্যেই তাঁরা এটা করে থাকেন। ধরা যাক কোনও ব্যক্তি অফিসে এই রকম ভাবে কাজ করেন, নিজের স্বার্থে সততাকে বলি দিয়ে অন্যের মাথায় পা রেখে সাফল্যের শীর্ষে পৌছতে তিনি মোটেই পিছপা হন না। কিন্তু সেই ব্যক্তিই বাড়িতে ফিরে একদম অন্যরকম ব্যবহার করতে পারেন। সেই ক্ষেত্রে আপাত দৃষ্টিতে তার ব্যক্তিত্ব বিকার আছে মনে হলেও, এটা মনে রাখতে হবে যে, এই মনোরোগে ব্যক্তি এই ধরণের চালচলন সব যায়গাতেই দেখান।
ব্যক্তিত্ব বিকারের উপসর্গগুলি কী?
পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার সাধারণত তিন ধরনের হয়, এবং সেই অনুযায়ী উপসর্গও আলাদা আলাদা দেখা যায়।
অধিকাংশ ব্যক্তিত্ব বিকারেই নিম্নলিখিত উপসর্গগুলি দেখা যায়।
লোকজনের সাথে মানিয়ে নিতে সমস্যা
পরিবর্তিত জীবনযাত্রায় মানিয়ে নিতে সমস্যা
হয় হ্যাঁ নয় না, এই দৃষ্টিভঙ্গিতে দুনিয়াকে দেখা
দীর্ঘস্থায়ী সুস্থ সম্পর্কে না থাকতে পারা
নিজের দোষ বুঝতে না পারা
যেকোনও ব্যাপারে হয় অতি আগ্রহী নয়তো সম্পুর্ণ উদাসীন মনোভাব পোষণ করা
অন্যের সমস্যা হচ্ছে তা বোঝার পরেও নিজের চালচলন পাল্টাতে না পারা
ব্যক্তিত্ব বিকার কেন হয়?
ছোটবেলায় বিভিন্ন দুর্ব্যবহার, অত্যাচার, হিংসাজনিত মানসিক আঘাত বা জিনগত কারণেও এই রোগ দেখা দেয়। বিভিন্ন জৈবিক, মানসিক এবং সামাজিক পরিবর্তনও এর কারণ।
জৈবিক কারণ: গবেষণায় দেখা গেছে যে বংশানুক্রমে বিভিন্ন জিনগত ত্রুটির কারণে অনেক সময় আমাদের মস্তিষ্কের নিউরোট্রান্সমিটারগুলি সঠিক ভাবে কাজ করে না। সেই কারণে অনেক সময় এই রোগ দেখা দেয়।
মানসিক কারণ: শৈশবস্থায় পাওয়া কোনও মানসিক আঘাত অনেক সময় এই রোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
সামাজিক কারণ: পরিবার থেকে পাওয়া ভালবাসা বা সুস্থ সম্পর্কে বহুদিন থাকা অনেক সময় এই রোগ এড়াতে আমাদের সাহায্য করে থাকে।
আমি কী করে বুঝব কারো ব্যক্তিত্ব বিকার আছে?
এই রোগের সূত্রপাত ছোটবেলায় বা কিশোর বয়সেই হয়ে থাকে। তখনই তা চিনতে পারা গেলে ভাল। আপনার যদি মনে হয় কারও ব্যক্তিত্ব বিকার আছে তবে লক্ষ করুনঃ
সবার সাথেই মানিয়ে নিতে সমস্যা হচ্ছে কি?
আবেগজনিত সমস্যায় ভুগছেন?
কাউকে ভালবাসতে চেয়েও সেই সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে পারছেন না?
মনমত সব না হলে নিজের ক্ষতি করার চেষ্টা করছেন?
মনে রাখবেন উক্ত সমস্যাগুলি সাধারণ মানুষের মধ্যেও থাকে। কাজেই এইগুলো দেখেই চট করে কোনও কিছু ভেবে বসা উচিত নয়। সবচেয়ে ভাল হবে এইরকম পরিস্থিতিতে যদি আপনি একজন অভিজ্ঞ মনোবিদের পরামর্শ নেন।
রোগনির্ণয়ের পদ্ধতি
এই রোগনির্ণয় পদ্ধতি খুবই জটিল কারণ আক্রান্ত ব্যক্তি বুঝতেই পারেন না যে তার চালচলনে আশে পাশের সবার অত্যন্ত সমস্যা হচ্ছে।
একজন অভিজ্ঞ মনোবিদ রোগী এবং তাঁর পরিচিত লোকজনেদের সাথে বিভিন্ন পর্যায় কথা বলে অন্তিম সিদ্ধান্তে উপনীত হন।
ব্যক্তিত্ব বিকারের চিকিৎসা
কথা বলে বোঝানোর মাধ্যমেই প্রধানত এই রোগের চিকিৎসা হয়ে থাকে। একজন অভিজ্ঞ থেরাপিস্ট রোগীর সাথে নিয়মিত কথা বলে তিনি কেমন বোধ করছেন তা জানার চেষ্টা করেন। এতে ব্যক্তিত্বের সমস্যা কে আলাদা করে চিহ্নিতকরণের ফলে চিকিৎসা এগিয়ে নিয়ে যেতে সুবিধা হয়।
দুশ্চিন্তা ও ইত্যাদি কারণে ওষুধপত্র দেওয়া হলেও সাধারণত ব্যক্তিত্ব বিকারের চিকিৎসায় কোনও ওষুধ লাগে না।
রোগীর যত্ন নেওয়া
একজন ব্যক্তিত্ব বিকারের রোগীর যত্ন নেওয়া অত্যন্ত কঠিন হয়ে দাঁড়াতে পারে। যেহেতু রোগীর বদ্ধমূল ধারণা থাকে যে তিনি সুস্থ তাই তাঁকে সঠিক ভাবে বোঝানো না গেলে চিকিৎসাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সমস্যার হতে পারে।
মনে রাখবেন ব্যক্তিত্ব বিকার ইচ্ছাকৃত জিদ নয়। কাজেই সঠিক সময় এর চিকিৎসা শুরু না করা গেলে রোগীর ব্যক্তিগত জীবনযাপনে প্রবল সমস্যা দেখা দিতে পারে।
বিশেষ কিছু ধরণের ব্যক্তিত্ব বিকার যেমন স্কিজয়েড বা অ্যান্টিসোশাল পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডারে ব্যক্তি মানতেই চান না যে তাঁর জন্য আশেপাশের লোকজনের সমস্যা হচ্ছে। কাজেই তাঁকে উদাহরণ দিয়ে বোঝানোটা জরুরি। কখনই সরাসরি তাঁকে দিয়ে বোঝাবেন না। এমন কিছু বলবেন না যার ফলে তিনি মানসিক অবসাদে ভুগতে পারেন।
যদি উনি মনোবিদের সাথে দেখা না করতে চান তবে কাউন্সেলিং এ যাবার জন্য উৎসাহ দিন। মনে রাখবেন আপনার থেকে উনি সহজে বোঝাতে পারবেন রুগীকে! তবে রোগী নিজের কোনরকম ক্ষতি করতে চাইছেন বুঝলে অবশ্য মনোবিদকে দেখানোটাই বাঞ্ছনীয়।