ছেলেদের মধ্যে পুরুষত্বের ধারণা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বাবাদের একটা বড় ভূমিকা রয়েছে
আজকের #MeToo জগতের মানসিক স্বাক্ষরতা এবং লিঙ্গ ও সমানুভূতিগত ভারসাম্যের দৃষ্টিভঙ্গি অল্পবয়সি ছেলেদের মধ্যে থাকা অত্যন্ত জরুরি। আর এজন্য প্রয়োজন বাবা-ছেলের সুদৃঢ় সম্পর্ক ও নিবিড় বন্ধন, যা দীর্ঘ সময় ধরে একটি ছেলেকে তার অনুভূতির বহিঃপ্রকাশের বিকাশ ঘটাতে সক্ষম করে তুলতে পারে, কঠিন সময়ে কীভাবে নিজেদের অনুভূতির পরিচালনা করতে হবে তা বুঝতে সাহায্য করে, মানসিক চাপের মোকাবিলা করতে শেখায় এবং নেতিবাচক বা কষ্টের অনুভূতিগুলোর বহিঃপ্রকাশ যে স্বাভাবিক, তা যে দুর্বলতার লক্ষণ নয়, সেই বোধও ছেলে বা যুবকদের মধ্যে গড়ে তুলতে সাহায্য করে।
আমি চিকিৎসা করতে গিয়ে সাধারণভাবে দেখেছি যে বহু বাচ্চার মা তাদের প্রসব-পরবর্তী জীবনকে মানিয়ে নেওয়ার জন্য সক্রিয়ভাবে একজন ডাক্তারের সাহায্য চান। সন্তানদের সঙ্গে সম্পর্কের জটিলতা দূর করে সঠিক পথে এগোনোর জন্য অথবা আত্মহত্যা বা অসুস্থতার কারণে সন্তানকে হারিয়ে ফেলার যন্ত্রণা থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য চিকিৎসকের দ্বারস্থ হন। এই ধরনের চিকিৎসার সঙ্গে অভিভাবকত্ব সংক্রান্ত গবেষণারও মিল রয়েছে যেখানে মায়েদের দিশাহারা এবং মা ও সন্তানের সম্পর্কের বন্ধনজনিত নানারকম সমস্যার সমাধানই অগ্রাধিকার পায়। কিন্তু একজন বাবা এসেছে আমার চেম্বারে?- এমন ঘটনা সচরাচর ঘটে না বললেই চলে। চিকিৎসাশাস্ত্রের গবেষণায় মাতৃত্বের সঙ্গে পিতৃত্বের বিষয়টিকে সমান গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করার অর্থ হল অল্পবয়সি ছেলেদের আচরণগত সমস্যার প্রাথমিক সূত্রপাতের সঙ্গে তার জীবনে বাবার অনুপস্থিতির প্রভাব, বাবা-ছেলের মধ্যে হিংসাত্মক পরিস্থিতি বা অশান্তির ইতিহাস, নেতিবাচক ও কঠোর শাস্তির ঘটনা এবং তাদের পুরুষতান্ত্রিকতার বোধ গড়ে ওঠা বা পৌরুষপূর্ণ ব্যক্তির ধারণা অথবা বাধাধরা লিঙ্গজনিত চিন্তাভাবনাগুলোর পারস্পরিক সম্পর্ক খুঁজে বের করা। ক্রমবর্ধমান গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে শিশুদের মানসিক এবং সামাজিক বিকাশের ক্ষেত্রে বাবাদের লালনপালন ও যত্নদানের বিষয়টি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ও ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।
ছেলেদের মধ্যে স্বাস্থ্যকর উপায়ে পুরুষালী ভাব বা পুরুষত্ব গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তাদের বাবার ভূমিকা কখনোই অগ্রাহ্য বা অবহেলা করা ঠিক নয়। উপরন্তু, কীভাবে একজন বাবা তার নিজের অভিজ্ঞতা এবং পারিবারিক গঠন ও প্রত্যাশা অনুযায়ী নিজের পুরুষত্বকে সঠিক পথে চালনা করছে, সেটাও এক্ষেত্রে বেশ বড় প্রশ্নচিহ্ন হয়ে ওঠে। পারিবারিক গঠন, পর্যবেক্ষণ, আলোচনা এবং অভিভাবক-সন্তানদের পারস্পরিক আলাপচারিতার মধ্যে থেকেই লিঙ্গের ভূমিকা, লিঙ্গ-ভাবনা এবং লিঙ্গ পরিচয়ের শিক্ষা গড়ে ওঠে আমাদের মধ্যে। ইদানীং টিভিতে শাশুড়ি-বৌমার যে অনুষ্ঠান আমরা সাধারণত দেখে থাকি তার মধ্যে লিঙ্গের ভূমিকা এবং লিঙ্গভিত্তিক সুযোগ-সুবিধার নিখুঁত ছবিটা ফুটে ওঠে।
বাচ্চা ছেলেদের মাঝে মাঝেই বলতে শোনা যায় যে বড় হয়ে তারা কেমন পুরুষ হতে চায় এবং তারা নিজেদের লিঙ্গ-বৈশিষ্ট্যের প্রকাশ ঘটাতে চায় তাদের বাবাকে অনুসরণ ও অনুকরণ করে, যেমন- তাদের বাবাদের কাজে যাওয়া, ঘরের কাজে অংশ নেওয়া বা না নেওয়া, পারিবারিক সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রভৃতি বিষয়গুলো ছেলেরা তাদের বাবাকে দেখেই শিখতে চায়। একটা ছেলের আচরণ ও তার সাংস্কৃতিক ভাবধারা গঠনের ক্ষেত্রে যে ধরনের শিক্ষাগুলো দেওয়া হয় সেগুলো হল- ''মেয়েদের মতো কান্নাকাটি কোরো না'' বা তাদের প্রতি সাধারণভাবে আমাদের প্রত্যাশা থাকে যে ''ও তো ছেলে, তাই ও তো দুষ্টু হবেই!'' আর এই মনোভাবগুলোর সঙ্গে তাদের জীবনে কঠিন সময়ের মোকাবিলা করার শিক্ষাগুলোকেও যুক্ত করা হয় (যেমন- সাইকেল থেকে পড়ে গিয়েও যেন কান্নাকাটি না করে) বা ''কঠিন-কঠোর করে নিজেদের গড়ে তোলা''। ছেলেদের মধ্যে যে অন্যের প্রতি বা দুর্বলের প্রতি মারমুখী হয়ে ওঠার প্রবণতা, নিজেদের যৌন সত্ত্বা এবং লিঙ্গ পরিচয়ের বিকাশ ঘটানো অথবা বন্ধুবান্ধব এবং সমবয়সিদের মধ্যে নিজেদের পুরুষসিংহ হিসেবে জাহির করার চেষ্টার মধ্যেও এই শিক্ষা বা মনোভাবের ছায়া লক্ষ্য করা যায়। বাচ্চা ছেলেদের সর্বাঙ্গীণ বিকাশের বিভিন্ন পর্যায় এটাই প্রমাণ করার চেষ্টা থাকে যে তারা যে কোনও পরিস্থিতিতেই কঠিন-কঠোর ও শক্তিশালী হবে এবং নিজেদের সব আবেগ-অনুভূতিগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে বা দমিয়ে রাখতে সক্ষম হবে। সেই সঙ্গে এটাও প্রত্যাশা করা হয় যে ছেলেদের কাছ থেকে কোনওরকম 'মেয়েলি আচরণ' গ্রাহ্য করা হবে না।
জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ছেলেদের সমানুভূতির শিক্ষা দেওয়ার ক্ষেত্রে বাবাদের বিরাট ভূমিকা রয়েছে। এক্ষেত্রে বাবারা নিজেদের পরিবারের পারস্পরিক সম্পর্কের মধ্যে সমানুভূতি ও সমবেদনা প্রকাশ করার দৃষ্টান্ত তুলে ধরে ছেলেদের সামনে আদর্শ হয়ে উঠতে পারে। পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবের পাশাপাশি তাদের মধ্যে যে অনুভূতিগত নমনীয়তা রয়েছে, সেটাও তারা নিজেদের আবেগপ্রবণতার বহিঃপ্রকাশের মধ্য দিয়ে তুলে ধরতে পারে। যেমন- ছেলেদের মধ্যে শারীরিক ও মানসিক ব্যথা-বেদনার বোধকে স্বীকার করার শিক্ষা দেওয়ার জন্য বাবারা নিজেরা সেই বোধগুলোকে স্বীকৃতি দিতে পারে, নিজের প্রিয় পোষ্যকে হারানোর জন্য প্রকাশ্যে তারা দুঃখ করতে পারে এবং এই একইরকম দুঃখ যাতে অভিভাবক, ভাই-বোন বা বন্ধুকে হারিয়ে হয়, ছেলেদের মধ্যে সেই বোধকেও বাবারা জাগিয়ে তুলতে পারে। এইভাবেই মানুষের মানসিক শক্তি ও নমনীয় অনুভূতিগত ভাবধারার মধ্যে একটা সেতু গড়ে তোলা সম্ভব হবে।
আসলে পুরুষতান্ত্রিক ভাবধারায় এই নমনীয়তাকে সাধারণত স্থান দেওয়া হয় না। যদিও এই নমনীয়তার শিক্ষা অল্পবয়সি ছেলে বা যুবকদের মধ্যে না থাকার ফলে তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক ও আত্মপরিচয়ের ক্ষেত্রে একধরনের মানসিক অচলায়তনের সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। সম্পর্কের মধ্যে স্নেহ ও উষ্ণতার বহিঃপ্রকাশ, সন্তানদের জন্য অভিভাবকদের গর্ববোধ এবং দুজনের একসঙ্গে সময় কাটানো, কাজকর্মে বাবা-ছেলের একসঙ্গে অংশগ্রহণ প্রভৃতি ঘটনা ছেলেদের মনে খুবই ইতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং সেগুলো তাদের কাছে মূল্যবান হয় ও সম্পর্কের বন্ধন নিবিড় হয়। এই ধরনের আচরণের সূক্ষ্মতা বাবা-ছেলের পারস্পরিক যোগাযোগের মাত্রা ও সক্রিয়তার উপরেই নির্ভরশীল। অনুভূতি প্রকাশের মৌখিক ও ভাব-ভঙ্গিগত আচার-আচরণ বা যোগাযোগ- উভয়ই বাচ্চাদের উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। তাদের মধ্যে লিঙ্গ-সমতা ও সব লিঙ্গের প্রতি সম্মান দেখানোর ক্ষেত্রে অনুভূতি প্রকাশের এই মাধ্যমগুলো খুবই কার্যকরী ফল দেয় এবং একক পরিবার, যেখানে বাবা মা দুজনেই কাজ করে, এবং যে পরিবারে বহুবিধ লিঙ্গ ও যৌন পরিচয়ের মানুষ থাকে সেইসব পরিবারে এর ইতিবাচক প্রভাব দেখা যায়।
সনাতন বা অনমনীয় পুরুষতান্ত্রিক ভাবধারার পুনর্গঠনজনিত আলোচনা এবং পুরুষতন্ত্র বনাম পিতৃতান্ত্রিক ভাবধারার বিচ্ছেদই বাবা-ছেলের সম্পর্কের পুনর্নির্দেশের সূচনা করে এবং উভয়ের সম্পর্ক আরও সহজ-সরল হয়, সম্পর্কের মধ্যে ভারসাম্য আসে ও তা লিঙ্গ পরিচয়ের ক্ষেত্রে সচেতন হতে সাহায্য করে।
প্রবন্ধটি লিখেছেন পিএইচডি ডিগ্রিধারী ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট দিব্যা খান্না। বর্তমানে ইনি ব্যাঙ্গালোরে চিকিৎসাকার্যে অনুশীলনরত। ডাক্তার খান্না মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাসভিল-র ভ্যান্ডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলেন, যেখানে তিনি বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে হিংসার শিকার হওয়া পূর্ণবয়স্ক মানুষকে নিয়ে কাজ করেছেন।
সূত্রঃ
- (Remmo, 2009; Yogman & Garfield, 2016)
- (Lindsay, Caldera, & Rivera, 2013; Castro et al, 2015)