বারবার নির্যাতনের জন্য আমাকে দোষারোপ করে সবার থেকে আমায় বিচ্ছিন্ন করা হয়েছিল
ঘটনাটা ৩৫ বছর আগে ঘটলেও তা আমার এখনও পরিষ্কার মনে আছে। তখন আমি ৯ বছর বয়সি একজন শিক্ষার্থী। একদিন দুপুরবেলায় যখন আমি স্কুলের সিঁড়ি দিয়ে টিফিন বাক্স হাতে নিয়ে নামছিলাম তখন আমার হাত থেকে সেটা মাটিতে পড়ে গিয়েছিল। তা দেখে স্কুলের হেডমাস্টার, যিনি অত্যন্ত শৃঙ্খলাপরায়ণ হিসেবে সবার কাছে পরিচিত ছিলেন তিনি তখন আমায় দেখেন এবং আমার উপর ভীষণ রেগে গিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন টিফিন বাক্স হাত থেকে পড়ে যাওয়ার জন্য আমার কঠিন শাস্তি পাওয়া দরকার। কারণ আমি নাকি খাবারকে অসম্মান করেছি। উনি আমাকে তখন ওনার অফিসে নিয়ে যান এবং সেখানে আমাকে যৌন নির্যাতন করেন।
এখানেই শেষ নয়। এই যৌন নির্যাতন ছ'বছর ধরে চলেছিল। হ্যাঁ সময়টা ছ'বছর।
এখনও আমার সবকিছু মনে আছে। যেমন- সেই ডেস্ক, যেখানে আমাকে সে শোওয়াতো, তার পেন স্ট্যান্ড, এবং কীভাবে ঘরটাতে সবকিছু সাজানো ছিল। আমার এটাও মনে আছে যে মুহূর্তে আমি সাহস করে একজন দিদিমণির কাছে আমার অবস্থার কথা বলার জন্য যেতাম তখনই ওই শিক্ষিকা আমায় বলতেন, উনি নিশ্চিত যে এই কথাগুলো আমি সব বানিয়ে বলছি। কারণ তার কাছে হেডমাস্টার ছিল খুব ভালো মানুষ, যত্নবান শিক্ষক। তাই এরকম মানুষ কখনোই এত ঘৃণ্য কাজ করতে পারে না বলেই ওই দিদিমণি বিশ্বাস করতেন।
পরবর্তী কয়েকটা বছর ধরে আমাকে শুনতে হয়েছিল যে আমার উপর যে এভাবে যৌন নির্যাতন হচ্ছে তা আমি অন্য কাউকে বলার চেষ্টা করেছি কিনা। আমি বাড়িতে বাবা-মাকে ওই ঘটনার কথা জানাতে ভয় পেয়েছিলাম। কারণ হেডমাস্টার ছিল আমাদের পারিবারিক বন্ধু ও সম্মাননীয় একজন ব্যক্তি। আমার ভাই আমার স্কুলেই পড়ত এবং আমার জীবনের কঠিন অবস্থাকে সে গুজব বলে উড়িয়ে দিয়েছিল এবং স্কুলে আমার সঙ্গে কোনও যোগাযোগই রাখত না। এমনকী স্কুলে আমার অস্তিত্বটাকেই সে স্বীকার করতে চাইত না। এসব কারণে আমি সত্যিই খুব একা হয়ে পড়েছিলাম।
আমার সঙ্গে যা ঘটছিল তা অন্য কাউকে বলার ঝোঁকটাই আমি হারিয়ে ফেলছিলাম। কারণ মানুষজন ওই ঘটনাকে তেমন আমলই দিত না। এর পিছনে ছিল তাদের অজ্ঞতা বা অন্যের বিষয়ে নির্লিপ্ত থাকার মনোভাব। আমি ভাবতাম এভাবে আমার চিন্তা থেকেও একদিন আমার সঙ্গে যা কিছু ঘটছে তা উধাও হয়ে যাবে। কিন্তু যতক্ষণ না আমার স্মৃতি থেকে ওই ঘটনা সম্পূর্ণ মুছে যাচ্ছে ততক্ষণ কোনও কিছুই আমাকে ওই ঘটনা ভুলতে সাহায্য করবে না। অথচ নির্যাতনের অভিজ্ঞতা কখনোই আমার স্মৃতি থেকে মুছে যায়নি।
অন্যদিকে হেডমাস্টার আমার অভিভাবকদের কাছে একটা গল্প ফেঁদেছিলেন। তিনি বলেছিলেন পড়ুয়া হিসেবে আমার মধ্যে অনেক ত্রুটি ছিল। কারণ শেখার ক্ষেত্রে আমি খুবই ধীরগতিসম্পন্ন ছিলাম। তাই লেখাপড়ার জন্য আমার অতিরিক্ত যত্ন দরকার যা ওই হেডমাস্টার আমায় খুশি হয়ে দিতে চাইছে। আমার অভিভাবকরা তার এসব কথা বিশ্বাস করেছিল। কিন্তু কিছুতেই বুঝতে চাইছিল না যে আমি কেন স্কুলে যেতে চাইছি না বা হেডমাস্টারের নাম শুনেই প্রত্যেক সময়ে ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছি।
শেষমেশ ছ'বছর ধরে নির্যাতনের শিকার হওয়ার পরে আমি একদিন সাহস সঞ্চয় করে একজনকে সব কথা খুলে বললাম। এবার যাঁকে বললাম তিনি আমাদের পরিবারের বন্ধু ছিলেন এবং যাঁকে আমি খুবই বিশ্বাস করতাম। তিনি একজন বেশ ক্ষমতাবান লোকও ছিলেন। উনি সব শুনে ওই হেডমাস্টারের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়টাও নিশ্চিত করেছিলেন। এর ফলে হেডমাস্টার এতটাই রেগে গিয়েছিল যে এর আগে আমি কখনোই তাকে এমনভাবে রেগে যেতে দেখিনি।
যখন আমি বুঝলাম যে এমন নির্যাতনের মুখোমুখি আমায় আর হতে হবে না তখন আমি খুব স্বস্তি পেয়েছিলাম। তবু যেন মনের ভয় আর কিছুতেই কাটতে চাইছিল না। আমি মানসিকভাবে নিজেকে একেবারেই শান্ত রাখতে পারছিলাম না। আমার স্কুলের নতুন হেড দিদিমণি আমার নির্যাতনের ঘটনাটা শুনেছিলেন। তিনি আমাকে আলাদা করে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে আমার অনুভূতির কথা একটা কাগজে লিখতেও বলেছিলেন। এরপর তিনি আমায় খেলার মাঠে নিয়ে গিয়ে সেই কাগজটা পুড়িয়ে দিতে বলেন এবং মন থেকে ওই অনভিপ্রেত ঘটনার অভিজ্ঞতা ঝেড়ে ফেলতে বলেন। আমিও তাই করেছিলাম। ব্যস এইটুকুই। কারণ আমি আশা করেছিলাম এভাবেই এই সমস্যাটার হাত থেকে আমার মুক্তি হোক। একটা সময় আমি শুধু ভাবতাম যে কেউ একজন আমার মনের সন্দেহ, রাগ, হতাশা এবং বিদ্বেষ চিহ্নিত এবং তা দূর করতে আমায় সাহায্য করবে। আর কবে, কীভাবে তা শেষ হবে সেই নিয়েই চিন্তা করতাম।
আমি নিজেকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছিলাম
আমার জীবনের ওই দুঃসময়ে আমি এতটাই হতাশ হয়ে পড়েছিলাম যে নিজেকে সমাজ থেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছিলাম। আমি একটা কথা বিশ্বাস করাই ছেড়ে দিয়েছিলাম যে কোনও মানুষ আমার সমস্যাটাকে একটু বুঝবে এবং সেই বিষয়ে আমাকে কথা বলার সুযোগ করে দেবে অথবা মনে কোনওরকম সন্দেহ না রেখে আমার কথা মন দিয়ে শুনবে। এই ঘটনার প্রভাব সবসময়েই আমার মনে পড়ত।
আমার যত বয়স বাড়তে শুরু করেছিল তত আমার মধ্যে অনবরত বিষণ্ণতার বোধ জেগে উঠছিল। কোনও মানুষের ছোঁয়াই যে আমি পছন্দ করছি না তা আমি মনে মনে উপলব্ধি করছিলাম। ঘৃণা এবং আতঙ্কে আমার গা শিরশির করে উঠত। মানসিকভাবে পরিবার ও বন্ধুদের কাছ থেকে আমি নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলাম। আমি কাজ নিয়ে থাকতেই খুশি হতাম, যা আমাকে আমার বাড়ি থেকে মাসে তিন সপ্তাহেরও বেশি সময় বাইরে রাখত। আমি বাড়ি আসতাম শুধুমাত্র নিজেকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য। তারপর আবার জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতাম। এইসময়ে ক্রমশ আমি মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছিলাম। আমার অভিভাবকরা আমায় নিয়ে চিন্তান্বিত হয়ে উঠছিল। সেই সময়ে যে আমি অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলাম তাও বুঝতে পারিনি। অনেকবার আত্মহত্যার চেষ্টা করি। কিন্তু প্রতিবারই ব্যর্থ হই।
এর কয়েক বছর পর একাকিত্ব থেকে আমার জীবনে আবার একটা দুঃসময় এসেছিল। তখনও আমি আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলাম। পুলিশ সেই সময়ে আমায় উদ্ধার করে এবং কাউন্সেলরের কাছে নিয়ে যায়। যখন আমি তার কাছে নির্যাতনের ঘটনা জানালাম তখন সে আমায় বলল যে আমি ওই হেডমাস্টারকে থামাইনি বলেই আমার উপর সে অবলীলায় নির্যাতন চালিয়েছে। এবং আরও যা কষ্টকর তা হল ওই কাউন্সেলর আমায় বলে যে নির্যাতনের ঘটনাকে আমি বারবার প্রশ্রয় দিয়েছি। এই কথা শুনে আমি আবার খুব ভেঙে পড়েছিলাম। তখন আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যদি কাউন্সেলিং-এর নমুনা এটাই হয় তাহলে সেই কাউন্সেলিং আমায় কোনও সাহায্য করতে পারবে না। যেসব লোককে বিশ্বাস করে আমি আমার নির্যাতনের কথা বলেছিলাম আর তা শুনে তারা আমায় যা যা বলেছিল, পরবর্তীকালে কাউন্সেলরও ঠিক তাদের মতোই আচরণ করেছিল। ফলে আমার আশা-ভরসা মন থেকে একেবারেই চলে গিয়েছিল।
যখন আমার ২৩ বছর বয়স তখন কলেজে আমি এমন একজন মানুষের দেখা পাই, যিনি আমার জীবনে প্রেরণাদায়ক হিসেবে এসেছিলেন। তাঁর সঙ্গে আমার সহসাই দেখা হয়। তিনি প্রতিদিন সময় করে আমার সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করতেন। আর শুধুমাত্র আমার জীবনের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা, আমার চিন্তাভাবনা, আমার মদ্যপান ও যৌন নির্যাতনের বিষয় নিয়েই কথাবার্তা বলতেন। তিনি ছিলেন সম্ভবত প্রথম ব্যক্তি যিনি আমার জীবনে ঘটা ঘটনার গভীরতাটিকে বুঝতে পেরেছিলেন। আমার মনে আছে যখন তিনি আমায় বলেছিলেন, ''হ্যাঁ, তোমাকে ধর্ষণ করা হয়েছিল'', তা শুনে আমি একেবারে ভেঙে পড়েছিলাম। সেটাই ছিল আমার জীবনে প্রথমবার, যখন আমি একজন মানুষকে মনে থেকে পুরোপুরি বিশ্বাস করে নিজের জীবনের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা মন খুলে বলেছিলাম। আর যে মানুষটা আমার অভিব্যক্তিকে বুঝতে পেরেছিল। আমার জীবনে ওই মানুষটির অবদান কখনোই ভোলার নয়।
দুর্ভাগ্যবশত কিছুদিনের মধ্যেই আমার জীবনে আসা ওই নির্ভরযোগ্য মানুষটির শারীরিক সমস্যা দেখা দেওয়ার ফলে তাঁর সঙ্গে আমার যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। এইভাবে আমার জীবনে আসা একমাত্র সাহায্যদাতাটিও চলে যায়। এরপরে আমার কর্মক্ষেত্রে আমি একজন কাউন্সেলরের পরামর্শ নিতে শুরু করি। ফলে আস্তে আস্তে সুস্থতার দিকেও এগোতে থাকি। যদিও আমার স্মৃতিতে এখনও সেই ভয়াবহ ঘটনার বেদনা উঁকি দেয়।
সাহায্য পাওয়ার পর জীবন আবার এগিয়ে চলল
এখন আমার বিয়ে হয়ে গিয়েছে। দুটো বাচ্চাও হয়েছে। তবু এখনও কোনও কোনও সময়ে আমি সেই ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা চিন্তা করে স্তম্ভিত হয়ে পড়ি। কাউন্সেলিং বন্ধ করে দিলেই সমস্যাগুলো আমার জীবনে আবার ফিরে আসে। আমার অবসাদকে বাড়িয়ে দেয়। এমনকী, আত্মহত্যা করারও ইচ্ছে জাগে। তবে আমি এটা মেনে নিয়েছি যে জীবন কখনো থেমে থাকে না। সে তার আপন গতিতে এগিয়ে চলে। কিন্তু আমি যেন নৌকোয় পিছন ফিরে বসে রয়েছি। যেখান থেকে আমি কোথায় আছি তা দেখা গেলেও, কোথায় গিয়েছিলাম তা দেখা যায় না। এবং আমার জীবন-তরীও এখন ক্ষুদ্র লক্ষ্যের দ্বারাই চালিত। আমার কল্পনায় জীবনও এভাবেই এগিয়ে চলে।
২০১৬ সালের জানুয়ারি মাসে শেষবারের মতো আমি নিজেকে মেরে ফেলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমি মরিনি। বেঁচে গিয়েছি। ব্যাঙ্গালোরের সেন্ট জন্স হাসপাতালের একদল কাউন্সেলর এবং মনোরোগ বিশেষজ্ঞের আন্তরিক সহায়তায় আমি আবার মৃত্যুমুখ থেকে ফিরে এসেছি। ৪৩ বছর বয়সে আমি নিজের সম্পর্কে নতুন করে কতকিছু শিখলাম, জানলাম। আমার ভয় এবং নিরাপত্তাহীনতা এখন অনেক দূরে চলে গিয়েছে। তাঁদের চিকিৎসার জাদু আমায় উপলব্ধি করতে সাহায্য করেছে যে মানুষের জীবনে কখনও আশা ছাড়তে নেই। এখন আমি বুঝেছি যে আমার পরিবারের প্রতি আমার অনেক দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। আর আমি আবার জীবনের মূলস্রোতে ফিরে এসেছি।
আমার বিয়ের চোদ্দ বছর কেটে গিয়েছে। আমি আমার জীবনের গল্প আমার স্ত্রীকে বলেছি এবং তার কাছে খুব কান্নাকাটিও করেছি। তার কাছে সব কথা খুলে বলতে পেরে যেমন কষ্ট বোধ করেছি, তেমন আবার মন থেকে হালকাও হতে পেরেছি। কারণ আমার স্ত্রী আমাকে মন থেকে গ্রহণ করেছে এবং কোনও মতামত ছাড়াই আমার কথা মন দিয়ে শুনেছে।
আমার মধ্যে এখন কিছু শূন্যতা এবং ক্ষত থাকলেও, কোনও বিদ্বেষ নেই। আমি আনন্দেই জীবনযাপন করছি। বহু কাঠখড় পুড়িয়ে আমি বুঝেছি যে আমার সঙ্গে যা হয়েছিল তাতে আমার কোনও দোষ ছিল না। আমি অনেকের মুখে শুনেছিলাম শিশুদের যৌন নির্যাতনের ক্ষেত্রে ছেলেরা রেহাই পায়। কিন্তু আমার নিজের জীবন দিয়ে প্রমাণ হয়ে গেছে যে সেকথা আদৌ সত্য নয়। আমি চাই এই সত্যিটা তাদেরও জানাতে যারা আমাকে সেদিন উলটো কথা বলেছিল।
আমি চাই এমন কেউ একজন থাকুক যে আমাকে বলবে যে নির্যাতনের ঘটনায় আমার কোনও দোষ ছিল না। সে আমার কথা শুনবে এবং সাহায্য করবে। আমার মনে পড়ে যখন আমি একাকিত্ব বোধ করতাম তখন কার কাছে গেলে আমি সাহায্য পাব তা আমি জানতাম না। আমি চাইতাম যার সঙ্গে আমি আমার জীবনের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নেব সে আমার বিশ্বাসভাজন হবে। তার মধ্যে আমার অভিভাবক, শিক্ষক, যে কোনও বয়স্ক মানুষ থাকতে পারে, যে আমাকে সহায়তা করতে পারবে। আমি ভাবতাম যাদের কাছে আমি আমার জীবনের কথা বলব তারা বিভিন্নভাবে আমায় সাহায্য করতে এগিয়ে আসবে। এর ফলে আমার মনে জাগা একাকিত্বের বোধ অনেক ফিকে হয়ে যাবে।
এই অভিজ্ঞতা যিনি হোয়াইট সোয়ান ফাউন্ডেশনের কাছে বলেছেন, তাঁর অনুরোধেই তাঁর নাম এই লেখায় প্রকাশ করা হয়নি।