আমি জানি নিজের রূপ নিয়ে নিরাপত্তাহীনতার অনুভূতিটা কীরকম এবং কীভাবে তা আপনার আত্মবিশ্বাস ভেঙে দিতে পারে
আমার বেশ মনে পড়ে আমার নাকের গড়ন সর্বদা আমায় খোঁচা দেওয়া চেষ্টা করত। যখন আমি আমাদের ঝাপসা হয়ে যাওয়া আয়নাটার সামনে দাঁড়াতাম তখন প্রতিদিন আমার নাকের গড়ন আমায় যেন খোঁচা দিত এবং তার প্রতি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করত। আমার অভিভাবকরা কখনোই এই বিষয়টাকে তেমন গুরুত্ব দিয়ে দেখেনি এবং সবটাই আমার কল্পনাপ্রসূত বিদঘূটে চিন্তা বলে উড়িয়ে দিত।
যখন আমার ১১ বছরের আশপাশে বয়স তখন আমার নাকের গড়নই শুধু একমাত্র বেখাপ্পা ধরনের ছিলনা। তখন আমার বয়ঃসন্ধিকাল শুরু হয়েছে। বয়সের তুলনায় তখন আমি বেশ লম্বা হয়ে গিয়েছিলাম, আমার স্তনের গঠন তখন থেকে শুরু হয়েছিল এবং আক্ষরিক অর্থেই আমি ছিলাম গোলগাল, নাদুসনুদুস ধরনের। আমি তখন মোটা ফ্রেমের চশমা পরতাম। আমার মায়ের যখন খুব অল্প বয়স, ২২ বছর, তখন আমি জন্মাই। মা তখন ছিলেন দোহারা, ছিপছিপে এবং ফর্সা। আমার গায়ের রং ছিল 'সাদাটে' বা ফ্যাকাশে ধরনের। এটি ভারতীয়দের একপ্রকার অনন্য বৈশিষ্ট্য এবং যে তামাটে রঙের পৃষ্ঠপোষকতা তারা করে আমি তখনও তা পছন্দ করতাম না এবং এখনও করিনা। যেখানে আমার নাক বোঁচা ছিল, সেখানে আমার মা, বাবা, কাকা বা কাকিমার নাম ছিল রোমানদের মতো টিকোলো ধরনের।
সেই সময় থেকেই আমি অসম্ভব লাজুক ও অর্ন্তমুখী হওয়ার তকমা পেয়ে গিয়েছি। আমার আত্মীয়স্বজন আমায় বইয়ের পোকা বলে তখন থেকেই নিয়মিত তকমা দিতে আরম্ভ করেছিল। পারিবারিক অনুষ্ঠানগুলোতে যেতে আমার একেবারে ভাল লাগত না। আমি নিয়মিত আমার আত্মীয়দের দ্বারা নানাভাবে সমালোচিত হতে শুরু করি। আমার সঙ্গে কথপোকথনের সময়ে তারা বারবার আমায় মনে করিয়ে দিত যে আমি নাকি দিন-দিন কালো হয়ে যাচ্ছি। তাদের মধ্যে আবার কেউ কেউ আমায় সান্ত্বনা দিয়ে বলত যে আমি মোটামুটি ফর্সার দিকেই রয়েছি! এসব কিছুর সঙ্গে আমার এটাও মনে আছে যে সেই সময়ে আমায় নিয়ে ইঁদুর-দৌড় শুরু হয়েছিল।
কিন্তু আমি তখনই বেশি করে দুঃখ পেতাম যখন মায়ের সঙ্গে আমার রূপ ও ব্যক্তিত্বের তুলনা টানা হত। আমায় দেখে প্রায়শই বলা হত যে আমায় নাকি মায়ের বোন বলে মনে হয়। আর এভাবেই আমার মায়ের প্রশংসা করা হত। কখনও একথাও বলা হত যে মাকে নাকি দেখতে আমার থেকে কমবয়সি লাগে। এসব কথা কি মজা করে বলা হত নাকি তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে বলা হত, তা আমি তখন একেবারেই বুঝতে পারতাম না। আপাতদৃষ্টিতে কি সেগুলো খুব সহজ-সরল আলোচনা ছিল? সম্ভবত তা-ই ছিল। আবার হয়তো তেমন ছিলনা।
যেহেতু তখন আমার ১১ বছর বয়স তাই সেসব কথাগুলো শুনতে আমার খুব খারাপ লাগত। আমি সবসময়ে ভাবতাম যদি আমি আমার মায়ের মতো দেখতে হতাম, মায়ের মতো আমি নতুন চোখ বা নতুন চিন্তাভাবনার অধিকারী হতে পারতাম তাহলে কত ভালো হত! আমি এখন এই বয়সে এসে স্বীকার করি ওইসময়ে আমার ভাবনাচিন্তাগুলো আদৌ সুস্থ-সুন্দর ছিল না, বরং বিপজ্জনক ছিল। বেপরোয়াভাবে আমি মায়ের মতো হতে চাইতাম আবার বেপরোয়াভাবে চাইতাম যেন মায়ের মতো না হতে। একদিকে আমি চাইতাম যেন আমার মাকে খুব সুন্দর দেখতে লাগে আবার উল্টোদিকে চাইতাম মাকে যেন বেঢপ, আলথালুর মতো দেখায়। আমার আবছা মনে পড়ে আমি আমার মাকে বলেছিলাম যে মা যেন আর সালোয়ার কামিজ না পরে; এর পিছনে আমার উদ্দেশ্য ছিল মাকে শাড়ি পরানো, কারণ শাড়ি পরলে মাকে বয়স্ক দেখতে লাগবে।
এসবের ফলে পুরো বয়ঃসন্ধিকাল জুড়ে আমার মধ্যে একপ্রকার দমবন্ধকর পরিস্থিতির জন্ম হয়েছিল। যখন পড়াশোনার চাপ এসে হাজির হয়েছিল তখন সেই দমবন্ধকর পরিস্থিতির শিকল ভাঙতে শুরু করেছিল। বই আমার সামনে মানুষের আসল জগৎ খুলে দিয়েছিল। সে মানুষ কালো, সাদা, তামাটে বা গোলাপি- যে কোনও বর্ণেরই হতে পারে। সে মানুষের চামড়ায় অনেক দাগ থাকলেও তাকে দেখলে ভালোবাসতে ইচ্ছে করে; যেখানে বোঁচা নাক, টিকোলো নাক- দু'রকমই থাকতে পারে, এমনকী সেখানে চশমা পরিহিত মেয়েও থাকতে পারে। কিন্তু এতসবের পরেও আমি মনে মনে আমার দৈহিক গড়নের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলাম। থিয়েটার বা নাচ আমার খুব ভালো লাগার বিষয় হলেও সেগুল শেখার ক্ষেত্রে আমি দ্বিধা বোধ করতাম।
আমার মনের গভীরে কী ভাবনা-চিন্তা চলছে তা কখনোই আমার সুশিক্ষিত বাবা-মা বুঝতে পারেনি। অথবা তারা এটাও বুঝতে পারেনি যে এসব ঘটনা আমার চিন্তা বা ব্যক্তিত্বের উপর কতখানি সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলতে পারে। তাদের স্নেহ-মমতাপূর্ণ চোখে তাদের মেয়ের চাইতে আর কাউকেই বেশি সুন্দর বলে কখনো মনে হয়নি এবং তাদের সেই অন্ধ ভালোবাসা তাদের মেয়ের উপর কী প্রভাব ফেলছে সে বিষয়ে তারা অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসী ছিল। একমাত্র আমার কাকিমা এই বিষয়টা নিয়ে আমার সঙ্গে কথা বলেছিলেন যা বহু বছর পরেও আমার মনে আছে। তিনি বলেছিলেন,''রেশমি, তুমি এত সুন্দর একজন মা পেয়েছ, তবু কি তুমি খুশি নও? বাকি বিষয়গুলো মন থেকে দূর করে দিয়ে বা অগ্রাহ্য করে শুধু এই বিষয়টা নিয়েই তুমি খুশি থাকো।'' সেই প্রথমবার আমি কারোর মুখে অগ্রাহ্য শব্দটা শুনেছিলাম।
আজ আমার ৩৮ বছর বয়স। আমার একটি তিন বছরের মেয়ে আছে, যার নাকটা বোঁচা এবং সে আমার কাছে পৃথিবীর সবচাইতে মিষ্টি ও সুন্দর সন্তান। আমরা আমার মেয়ের নাক নিয়ে নানারকম ঠাট্টা-তামাশা করে থাকি, (যেমন- তোমার ছোট্ট নাকটা ক্রমশ যেন আরও ছোট হয়ে যাচ্ছে!) তবে তাকে উপহাস করার সঙ্গে সঙ্গে এটা নিয়ে নিজেকেও উপহার করা উচিত। আমরা চাই যে মেয়ে আসলে বুঝুক যে কাউকে নিয়ে হাসাহাসি করাটা আদৌ তেমন গুরুত্বপূর্ণ কোনও বিষয় নয়। কিন্তু সেই সঙ্গে তাকে আমরা এই বিষয়েও নিশ্চিত করতে চাই যে তার নাক পৃথিবীর সবার চাইতে সুন্দর।
আমরা আমাদের মেয়ের মধ্যে ইতিবাচক দৈহিক গড়নের মনোভাব গড়ে তোলার শিক্ষা দিই এবং এই বিষয়ে লোকের কথা অগ্রাহ্য করা জরুরি বলে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করি। কারণ সে যাতে স্বাস্থ্যকর ও সুস্থ-সবলভাবে বড় হয়ে উঠতে পারে আমরা সেদিকেই বেশি করে নজর রাখি। মানুষের দৈহিক সৌন্দর্য নিয়ে আমাদের সমাজের কতগুলো স্থির ধ্যান-ধারণা ও চিরাচরিত আলোচনা রয়েছে। জনসমক্ষে দৈহিক গড়নজনিত ভাবমূর্তির সমস্যা নিয়ে আলাপ-আলোচনা সেই ধ্যান-ধারণার চরম পর্যায়। এর ফলে অল্পবয়সি মেয়েদের মধ্যে খাদ্যাভ্যাসজনিত অব্যবস্থা গড়ে ওঠে। প্রাত্যহিক জীবনে মেয়েদের গায়ের রং বা তাদের শারীরিক গঠন নিয়ে নানারকম অপ্রিয় সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়। আমি জানি, বুঝি যে এসবের ফলে একজন মানুষের মধ্যে নিজের সৌন্দর্য নিয়ে কেমন নিরাপত্তাহীনতার বোধ জাগে বা কীভাবে তার আত্মবিশ্বাস তলানিতে পৌঁছয় এবং কত মানুষের প্রতিভার যথার্থ প্রকাশও সম্ভব হয় না, তা নানাভাবে বাধাপ্রাপ্ত হয়। আমরা অধিকাংশ মানুষই এমন আচরণ করি। কিন্তু বয়সে বড় বা অভিভাবক হিসেবে আমাদের উচিত এবিষয়ে আমাদের মেয়ে এবং ছেলের প্রতি বারবার সচেতন এবং সংবেদনশীল থাকা ও তাদের চিন্তাভাবনাকে গুরুত্ব সহকারে বিচার করা।
আমরা চাই আমাদের সন্তান যেমনই দেখতে হোক সে যেন সবসময়ে ভালো থাকে এবং আরও গুরুত্বপূর্ণ হল সে কে- এই প্রশ্নটা যেন তার মনে প্রধান হয়ে দেখা না দেয়। সেই সঙ্গে সে পৃথিবীর কাছ থেকে কী চাইছে এবং তার আত্মপ্রত্যয় বোধ যেন দুর্বল হয়ে না যায় সেদিকে লক্ষ রাখা। আমরা সবসময়ে তাদের শেখাতে চাই যে প্রশংসার দ্বারা অতিরিক্ত আনন্দিত না হওয়া বা সমালোচনার মুখে ভেঙে না পড়া। কিন্তু কীভাবে আমরা এসব কাজে সফল হব?
ছেলে-মেয়েদের চাকচিক্য বা রূপ কোনও গুরুত্ব দেওয়ার মতো বিষয় নয় বা আমাদের চারপাশে চাকচিক্যময় মানুষের কোনও অস্তিত্ব নেই- এই ধরনের ভাষণ দেওয়া একপ্রকার ভান করা বা ভন্ডামি। আমাদের চারপাশে চাকচিক্যও রয়েছে এবং মানুষের বাহ্যিক গঠন, সৌন্দর্য- এগুলোও যথেষ্ঠ গুরুত্বপূর্ণ। এই সম্ভাবনাগুলোর কথা মাথায় রেখেই অভিভাবকত্বের দায়িত্ব পালন করা জরুরি। তাই নিজের সন্তানের ভাবনাচিন্তাগুলোর প্রতি সচেতন থাকতে হবে, বাস্তবতাকে স্বীকার করতে হবে এবং ছেলে বা মেয়েকে নিজের জীবনের অভিজ্ঞতার কথা বলতে হবে। তাদের জানাতে হবে যে সমস্যা যেমন আছে তেমন তার সমাধানও রয়েছে। তাই আমাদের মধ্যে দৈহিক ভাবমূর্তিজনিত সমস্যা থাকলেও তা অতিক্রম করার উপায়ও যে রয়েছে তা একজন অভিভাবক হিসেবে সন্তানকে বোঝানো প্রয়োজন।
এক্ষেত্রে আরেকটি ঘটনাও লক্ষ্য করা যায়। বাবা-মায়েদের মানসিক উদ্বেগ তাদের বাচ্চাদের খানিকটা দিশাহারা করে তোলে। তাই যদি ছেলে বা মেয়ে তার বাবা-মাকে দৈহিক গঠন নিয়ে খুব চিন্তাগ্রস্ত হতে দেখে তাহলে এই বিষয়টা যে অতিরিক্ত গুরুত্বপূর্ণ সে ব্যাপারে তারা নিশ্চিত হয়ে যাবে। সেজন্য আমরা কীরকম সে বিষয়ে আমাদের উচিত বাচ্চাদের সঠিক শিক্ষা দেওয়া। এই কাজটি করা মোটেই সহজ নয়। তবে অসম্ভবও নয়।
আমাদের সন্তানদের বলা উচিত যে অন্যরা তার নাক, চুল বা চোখ নিয়ে কী বলছে সে বিষয়ে বেশি চিন্তাভাবনা করার দরকার নেই। যখন তারা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মাথার ক্লিপ দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে পড়ে এবং মনে মনে নিজেকে সুন্দর লাগছে কিনা তা জিজ্ঞাসা করে তখন আমাদের অর্থাৎ অভিভাবকদের উলটো প্রশ্ন করা জরুরি। যেমন- কী ভাবছ তুমি? তোমার কি মনে হয় তুমি খুব সুন্দর দেখতে? এর উত্তর যদি হ্যাঁ হয়, তাহলে তাকে বলা উচিত যে সত্যিই সে সুন্দর দেখতে।