যা আমি বয়ে বেড়াচ্ছি
আমার যখন বারো বছর বয়স তখন আমি একবার নিজের ওজন নেওয়ার জন্য ওজন মেশিনে দাঁড়িয়েছিলাম। ওজন মাপার যন্ত্রটির কাঁটা ৬০ কেজিতে পৌঁছেছিল। সেই দেখে তো আমার মাথা ঝিমঝিম করতে শুরু করেছিল। আমি তড়িঘড়ি ওটা থেকে নেমে এসে রবিবারের পিকনিকের জন্য পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মেতে উঠেছিলাম। আমার এখনও মনে পড়ে এরপর আমি আমাদের বাড়ির বাইরের বাগানে খুব জোরে জোরে দৌড়তে আরম্ভ করি। আমার মনে আশা ছিল যে এইভাবেই হয়তো আমি আমার শরীরের বাড়তি ওজনকে পেছনে ফেলে দিতে পারব। আমি কল্পনা করে নিয়েছিলাম যে যদি আমি আদা-জল খেয়ে পরিশ্রম করি তাহলে আমার ওজন সত্যিই কমে যাবে। আর বিয়ার জাতীর মদের প্রথম চুমুকে যেমন মানুষের শরীর-মন হালকা, ফুরফুরে বলে মনে হয় আমারও তখন তেমনই মনে হবে।
শেষ আড়াই দশক ধরে আমি অনেকবার আমার শরীরের অতিরিক্ত চর্বি ঝরিয়ে ছিপছিপে হওয়ার চেষ্টা করেছি। কিন্তু যখন আপনি তিরিশ বছর বয়সে পৌঁছবেন তখন দেখবেন যে আপনার শরীরের স্বাভাবিক ওজনের কাছাকাছি পৌঁছবেন, আবার ওজন বেড়ে যাবে। এমন দুবার তো হবেই। এই ঘটনা থেকেই আপনার মনে প্রশ্ন জাগবে যে আপনি কী ভুল করছেন? এবং পুরো ব্যাপারটা আসলে কী?
মোটাসোটা মানুষদের সারা জীবন ধরেই সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়।
জীবনের সবচাইতে সাধারণ কাজও যেন একটা যুদ্ধ মনে হয়। সকাল সকাল ঘুম ভেঙে বিছানা ছেড়ে ওঠা, প্রাতঃকৃত্য সারা, তারপর কী পরব, কী খাব, কতটা খাব, রেস্টুরেন্ট বা কফি শপে গিয়ে কোথায় বসব, আমার মনের কথা জোরে-জোরে বলব (কিন্তু তাহলে তো সবাই আমার দিকে তাকাবে) নাকি কিছু না বলে দেওয়াল আঁকড়ে দাড়িয়ে থাকব যাতে কেউ অস্বস্তিতে না পড়ে? নাদুসনুদুস গড়নের জন্য যেন শরীরের প্রত্যেকটা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আমার দিকে বাঁকা চোখে তাকাচ্ছে। মিষ্টি বা নোনতা যে খাবার খাওয়ার ইচ্ছাই হোক না কেন, সেটা আমার হাবাতে, অনিয়ন্ত্রিত স্বভাবের প্রমাণ। শুধুমাত্র কিলোগ্রাম দিয়েই যে শরীরের অতিরিক্ত ওজন মাপা হয়, তা নয়। মোটা হওয়াটা একটা পাপ, আমার দুর্বলতা, আমার ব্যর্থতা। আমরা অধিকাংশই আমাদের প্রকৃত ও কল্পিত ব্যর্থতাগুলোকে চোখের আড়াল করার জন্য অতিরিক্ত পরিশ্রম করি। তবে একটি বড়সড় চেহারার মানুষ হওয়ার মানেই হল সেটি একটি জীবন্ত, চলন্ত বিজ্ঞাপন ব্যর্থতার - নিজেকে সীমিত রাখার, নিয়ম মেনে চলার। আসলে দৈহিক ওজন শুধু বাহ্যিক একটা বিষয় নয়- শারীরিক ওজন হল মানসিক, অনুভূতিগত, মনস্তাত্ত্বিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং (একথা বলতে আমার অস্বস্তি হলেও বলতে হবে) আধ্যাত্মিক অস্তিত্ব।
আমরা মানুষের চরিত্রের বিভিন্ন দোষ-ত্রুটি, পছন্দ-অপছন্দ নিয়ে মন্তব্য করতে সংকোচ বা দ্বিধা বোধ করলেও, সমাজ একজন মানুষের রোগা-মোটা হওয়া নিয়ে হাসিঠাট্টা করতে ছাড়ে না। একটা মোটাসোটা মানুষের যখন তার পারিবারিক কোনও অনুষ্ঠানে অনেকের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ হয় তখন আত্মীয়স্বজনরা তাকে শরীরের চর্বি ঝরানোর জন্য কতশত পরামর্শ দেয়, সে কেন গোলগাল, মোটাসোটা হয়ে যাচ্ছে তা নিয়ে যত্নবান আত্মীয়স্বজনের চিন্তার শেষ থাকে না। আমার সঞ্চালনায় হওয়া এরকম একটা ওয়ার্কশপের কথা মনে পড়ছে যেখানে একজন মহিলা খুব কান্নাকাটি করেছিল। কারণ তাকে আমেরিকা ফিরে গিয়ে পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে দেখা না হওয়া আত্মীয়ের সঙ্গে দেখা করতে হবে। তারা ওই মহিলার চেহারার গড়ন নিয়ে এমন সব মন্তব্য, সমালোচনা করেছিল যে একবার সে তাঁদের উপর রাগে ফেটে পড়ছিল আবার নিজের উপর। “কেন আমি এই ওজনটা চিরকালের মতো কমিয়ে ফেলতে পারছি না” এই প্রশ্নের মধ্যে লুকিয়ে ছিল তার অসহায়তা এবং হতাশা।
আমাদের সমাজ একদিকে যেমন মোটা, নাদুস-নুদুস, গোলগাল প্রভৃতির তকমা আমাদের গায়ে লাগিয়ে দেয় তেমনই আবার অন্যদিকে এইসব সমস্যার সমাধানের পথও দেখিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। যেমন- অ্যাটকিন্স, পাল্ম বিচ, গ্রেপফ্রুট ডায়েট, রুজুতা দিভেকারের লেখা বই (করিনা কাপুরের রোগা, ছিপছিপে চেহারার পিছনে যাঁর অবদান রয়েছে), গার্সিনিয়া কাম্বোগিয়ার মতো একধরনের ফলজাতীয় খাবার, যা ওজন কমাতে সাহায্য করে, সেইসবের নিয়মিত যোগানও সমাজই আমাদের দেয়। অতি সম্প্রতি কেটো ডায়েটের জাদুতে আমি প্রায় মজে গিয়েছি। এই খাদ্যতালিকা অনুযায়ী আমি অনেক কিছু খেতে পারব, যেমন- ফুলকপির পোলাও, যুকিনি নুডল্স; এরপর একটা কাগজে প্রস্রাব করে নিশ্চিত হতে পারব যে আমার শরীর কেটোসিস পর্যায়ে পৌঁছেছে কিনা। এই পদ্ধতিতে প্রতিদিন নিজের ওজন লিখে রাখতে হবে। সেই সঙ্গে আমি এটাও আশা করতে পারি যে হয়তো কয়েক মাসের মধ্যে আমিও সমাজের চাহিদা মতো তন্বী, ছিপছিপেদের দলে নিজের একটা জায়গা করে নিতে পারব।
যদি আমরা প্রতিদিন কী খাব আর কী খাব না এই চিন্তার পিছনে খরচ করা সময়, শক্তি এবং টাকা সঞ্চয় করে রাখতে পারতাম তাহলে তা দিয়ে বেশ দীর্ঘ সময়ের জন্য একটা ছোটখাটো দেশ শাসন করা যেত।
মনস্তাত্ত্বিক আঙ্গিক
একজন সাইকোথেরাপিস্ট হিসেবে আমি স্বভাবতই দৈহিক গঠন, তার আয়তন ও ওজনকে মনস্তাত্ত্বিক দিক দিয়ে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছি এবং এদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কটা বোঝার চেষ্টা করেছি। অধিকাংশ মানুষের কাছেই শরীরের ওজন কমানো সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ নয়। অনেকেই তাদের জীবদ্দশায় বহুবার এই কাজে সফল হয়। কিন্তু এই সাফল্যকে বজায় রেখে শরীরের ওজনকে স্বাস্থ্যকর করে তোলাটাই বড় চ্যালেঞ্জ। অপরাহ্, লুই হে এবং পরবর্তীকালে গেনিন রথ ও ক্যাথি লিছহেল্পড্ আমাকে সাহায্য করেছেন এক বিন্দু থেকে আরেক বিন্দুতে গিয়ে পুরো ছবিটা আঁকতে।
আমাদের দেহ বা অবয়বের শুধু বংশানুক্রমিক বা শারীরবৃত্তীয় কোনও স্থির সত্ত্বা বা অস্তিত্ব নেই। এর মধ্যে আমাদের মানসিক এবং অনুভুতিগত উপলব্ধির বাহ্যিক প্রকাশও রয়েছে। যদি কোনও মানুষের মজ্জাগত কোনও সমস্যা এবং অতিরিক্ত খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে বা বিশালাকার দেহের রক্ষণাবেক্ষণ সম্পর্কে অজ্ঞতা থাকে তাহলে তার দৈহিক ওজনের প্রবল ওঠা-পড়া চোখে পড়ে।
মানুষের বড়সড় চেহারা গড়ে ওঠাটা তার মানসিক আতঙ্কের বিরুদ্ধে প্রতিরোধকারী প্রয়োজনীয় একটা ব্যবস্থার ফলাফল হিসেবেও গন্য হতে পারে। যারা যৌন নির্যাতনের শিকার হয় তাদের মধ্যে পরতে-পরতে ওজন ধরে রাখার বিষয়টাকে প্রতিরোধমূলক বা অন্যদের নজরের বাইরে থাকা অথবা পরবর্তী নির্যাতন এড়ানোর ব্যবস্থা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যে বাচ্চাটি ভয়াবহ আতঙ্ক কাটিয়ে ওঠে তার মধ্যে সীমারেখা এবং প্রতিরোধ করার কোনও শিক্ষা গড়ে ওঠে না। তাই এক্ষেত্রে শরীর আতঙ্ক ধরে রাখা ও তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গড়ে তুলে দ্বৈত ভূমিকা পালন করে। একটা বাচ্চার মধ্যে অজ্ঞাতসারেই তার বড়সড় চেহারার প্রতিফলন বা প্রভাব পড়তে পারে এবং এর মধ্য দিয়েই জগৎ-সংসারে তার একটা স্থানও গড়ে উঠতে পারে। আর এই ঘটনার বাহ্যিক প্রকাশ বাচ্চাটির মধ্যে গভীর মানসিক সমস্যার কারণ হয়েও দেখা দিতে পারে।
চিকিৎসাশাস্ত্রে অ্যানোরেক্সিয়া নার্ভোসা ও বুলিমিয়া এবং শৈশবস্থা ও বয়ঃসন্ধির সমস্যার মধ্যে গভীর যোগাযোগের কথা বলা হয়েছে। ঠিক সেইভাবে বেশি খাওয়া ও ওবেসিটি বা স্থূলতার মধ্যে তেমন সম্পর্কের কথা এখানে বলা হয়নি, যাকে মানুষের মানসিক লড়াইয়ের ফলাফল হিসেবে না দেখে তার ব্যক্তিগত এবং নৈতিক ব্যর্থতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অথচ মজার বিষয় হল জীবনধারনের জন্য কোনও বস্তুর প্রতি আসক্তিরও প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু আসক্তি যখন মাত্রাছাড়া হয়ে যায় তখনই পরিস্থিতি জটিল হয়ে দাঁড়ায়। দৈহিক ওজন, আয়তন এবং খাবারদাবার বিষয়ক গঠনমূলক আলোচনার ক্ষেত্রেও যেসব ধারণাগুলো আমাদের মনে ঘুরে-ফিরে আসে সেগুলো হল মানুষের ইচ্ছাশক্তি, দৃঢ়তা, শৃঙ্খলা এবং আলস্য বা কুঁড়েমি। আর মানুষের মধ্যে নিজের শারীরিক ওজন নিয়ে যে লজ্জা, অপরিপূর্ণতা, নিয়ন্ত্রণহীনতা এবং অসহায়তার বোধ জেগে ওঠে তার প্রভাবে আমাদের জীবন সংকীর্ণ হয়ে পড়ে, নানারকম দৈহিক বেড়াজালেও আমরা আটকে পড়ি।
বর্তমানে আমি আমার অনুশীলন, থেরাপির দল ও 'বডি বাউন্ডারিস' নামক কর্মশালার মধ্য দিয়ে মানুষকে সেই সুযোগ করে দেওয়ার চেষ্টা করি যাতে তারা নিজেদের শারীরিক ওজন ও তার সীমারেখা সম্পর্কে একটা সুস্পষ্ট ধারণা করতে পারে। এভাবেই মানুষের প্রকৃত ইচ্ছে-পছন্দগুলোর বিকাশ এবং ব্যক্তিমানুষ তথা বৃহত্তর জনসংখ্যার অস্তিত্বের বিষয়টা প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। যেসব মানুষ দীর্ঘদিন ধরে স্থূলতা বা ওবেসিটিতে ভুগছে এবং সারা জীবন ধরে যারা ওজন বাড়া-কমার সমস্যায় আক্রান্ত তাদের প্রতিই বিশেষ করে আমার আগ্রহ রয়েছে।
আমাদের সমাজে মানুষের বাহ্যিক গড়ন নিয়ে কতগুলো পূর্বনির্ধারিত ধারণা রয়েছে। 'সক্রিয় থাকো, স্বাস্থ্যকর খাবার খাও এবং সুস্থভাবে বাঁচো'- এই উপদেশগুলি শুনতেই আমরা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। এর উদ্দেশ্য খারাপ নয়। কিন্তু এই উপদেশগুলোর বাস্তব প্রয়োগ ঘটাতে গিয়ে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে রীতিমতো লড়াই করতে হয়, পাহাড়প্রমাণ বাধা টপকাতে হয়। যার ফলে মানুষের মধ্যে হতাশা, হাহাকার মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। আমি আমার কর্মশালায় বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে কথা বলি, তাদের নানারকম প্রশ্ন করি এবং তাদের মুখ থেকে আলাদা-আলাদা উত্তর শোনার চেষ্টা করি। এভাবেই আমি দৈহিক ওজন সম্পর্কে মানুষের মনে সঠিক ধারণা দেওয়ার জন্য এমনসব পদক্ষেপ নিই যাতে তারা ওজন নিয়ে জানার জন্য উৎসাহিত হয়; এছাড়া ওজন বাড়ার পিছনে কোন ভয় লুকিয়ে থাকে, ওজন কমানো, ওজন কমাতে গিয়ে যে পরিশ্রম করতে হয় তার জন্য যে ব্যথা-যন্ত্রণা হয়, কী ধরনের খাবার খাওয়ার উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে হয়, শরীরচর্চার ফলে শরীরের কোন অংশে কতটা চর্বি ঝরানো সম্ভব বা পুষ্টিকর ফলের রস খেলে তাড়াতাড়ি মোটা থেকে রোগে হওয়া যায় কিনা- এসব বিষয় নিয়েও আমি আলোচনা করে থাকি। আমার বিশ্বাস থেরাপির সঙ্গে এসব বিষয়ের উপর আলোকপাতের মধ্য দিয়েও মানুষের দৈহিক ওজন সংক্রান্ত সমস্যার সঠিক মূল্যায়ন করা সম্ভবপর হয়।
প্রবন্ধটি লিখেছেন মৃণালিনী। ইনি একজন সাইকোথেরাপিস্ট। ২০১০ সাল থেকে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করছেন। তিনি ব্যক্তি, দম্পতি, পরিবার ও প্রতিষ্ঠান নিয়ে কাজ করেন। আমাদের শরীর বা দৈহিক গড়নকে ঘিরে যে ধরনের মনস্তাত্ত্বিক পরম্পরা বা গতিময়তা রয়েছে, তা নিয়েই মৃণালিনী কাজ করছেন। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করতে হলে এই ঠিকানায় লিখুন - sharma.mrin@gmail.com
এই প্রবন্ধে লেখকের ব্যক্তিগত মতামত প্রকাশ পেয়েছে। তার সঙ্গে হোয়াইট সোয়ান ফাউন্ডেশনের মতামতের মিল না থাকতে পারে।