আপনার সন্তানের বয়ঃসন্ধিকাল কি আপনাকে সমস্যায় ফেলছে?

আপনার সন্তানের বয়ঃসন্ধিকাল কি আপনাকে সমস্যায় ফেলছে?

আমার মেয়ের বয়স ১৭। সবসময় আমার মাথার মধ্যে ঘোরে যে আর ছ মাসেরও কম সময়ে তার ১৮ বছর পূর্ণ হবে। আমি কি সঠিক ভাবে বয়ঃসন্ধিকালে তার পাশে থেকেছি?
Published on

আমার মেয়ের বয়স ১৭। সবসময় আমার মাথার মধ্যে ঘোরে যে আর ছ’মাসেরও কম সময়ে তার ১৮ বছর পূর্ণ হবে। আমি কি সঠিক ভাবে বয়ঃসন্ধিকালে তার পাশে থেকেছি? সে এবার একজন প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার দোরগোড়ায় এসে হাজির হয়েছে। তাই আমার মনে হয়, বয়ঃসন্ধিকালকে বোঝা দরকার এবং সেটিকে মা-বাবারা কেন ভয় পান, তা নিয়েও কথা বলা প্রয়োজন। 

বয়ঃসন্ধিকাল কোনও দুঃসময় নয়। এই সময় সঠিক পদক্ষেপ নিলে অভিভাবক ও সন্তানের সম্পর্ক আরও মজবুত উঠবে। কিন্তু এই সময়টিকে সাফল্যের সাথে পার করতে হলে বুঝতে হবে, যে এটি শুধু মাত্র শারীরিক ও মানসিক বিকাশের সময় না, এটি মা-বাবা ও অন্য সকলের সঙ্গে নতুন করে একটি সম্পর্ক তৈরি করারও সময়। 

যে শারীরিক পরিবর্তনগুলি এই সময় দেখতে পাওয়া যায়, সেগুলি সম্পর্কে আপনারা সকলেই জানেন, তাই নতুন করে আর কিছু বলছি না। মানসিক বিকাশের বিষয়টি বোঝা একটু কঠিন। বয়ঃসন্ধিকালে, পুনরায় মস্তিষ্ক দ্রুত গতিতে বিকাশ পেতে থাকে, এর ফলে মস্তিষ্কে অনেক জটিল চিন্তাভাবনার আনাগোনা হয়। যদিও তাদের অ্যামিগড্যালা (মস্তিষ্কের অংশ যেখানে বিভিন্ন আবেগ যেমন, খুশি, ভয়, রাগ জন্ম নেয়) একজন প্রাপ্তবয়স্কর মতো সক্রিয় হয়ে ওঠে না, কিন্তু মস্তিষ্কের অন্য সকল অংশ ভাল ভাবেই গড়ে ওঠে।

বয়সন্ধিকালের প্রথম দিকে ছেলেমেয়েরা নিজেদের স্কুল ও বাড়ির বিষয়ে ব্য ক্তিগত সিদ্ধান্ত নিতে শেখে, তারা গুরুজন ও সমাজের নিয়মকানুনের ওপর প্রশ্ন করতে শেখে। নিজেদের জীবন নিয়েও ভাবনাচিন্তা করতে শেখে (আমি কি খেলব? কাদের সঙ্গে মিশব? অভিভাবকদের কোন নিয়মটি বদলাতে বলব, ইত্যাদি)। 

বয়ঃসন্ধিকালের মাঝামাঝি গিয়ে তাঁরা নানান দার্শনিক বিষয় এবং নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে শুরু করে– তারা বেশি প্রশ্ন করতে শুরু করে, বিচার বিবেচনা করে; নিজেদের নিয়মকানুন নিজেরাই সৃষ্টি করে। বিভিন্ন পরিকল্পনা নিয়ে ভাবে এবং নিজেদের ভবিষ্যতের লক্ষ তৈরি করে সেগুলি পূরণ করার চেষ্টা করে।

বয়ঃসন্ধিকালের শেষ পর্যায়ে তাঁরা নিজেদের বিষয়ে না ভেবে, জাগতিক বিষয় নিয়ে ভাবতে শুরু করে, যেমন ন্যায়-অন্যায়, রাজনীতি। নিজেদের মতাদর্শ তৈরি করে, তর্ক করা শুরু করে এবং বিপক্ষ মতের প্রতি অসহিষ্ণুতা দেখায়। তাঁরা নিজেদের ভবিষ্যতের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পাশাপাশি সামাজিক কর্তব্যের কথাও ভাবা শুরু করে। কিন্তু এই মানসিকতা তাঁদেরকে আত্মকেন্দ্রিক করে তিলতে পারে। একটি সমস্যাকে তারা বিভিন্ন দিক থেকে দেখতে শুরু করে। সবকিছুকে তারা সত্যি বলে মেনে নেয় না, তাই তারা তাদের অভিভাবকদের নিয়েও প্রশ্ন তোলে। ফলে মা-বাবারা ভাবেন তাঁদের পক্ষে সন্তানদের সামলানো কঠিন হয়ে যাচ্ছে।

একজন তরুণ যখন নিজের পরিচয় খোঁজার চেষ্টা করে: নিজেদের প্রশ্ন করে, “আমি কে?” এটা জানা তাঁদের পক্ষে খুব প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে। অভিভাবকরা নিজেদেরকে সন্তানের আদর্শ মনে করেন। যদিও বাস্তবে আদর্শ তাঁদের বন্ধুবান্ধব, আশেপাশের লোকজন, পাড়া প্রতিবেশী, বা মিডিয়ার সংস্পর্শ থেকেও জন্মাতে পারে। এই উত্তরণের সন্ধিকাল, তাদের দুটি ধাপের মধ্যে দিয়ে পার করতে হয়। প্রথমত হল, নিজেদের ছোটবেলায় শিখে আসা সমস্ত জিনিস কে প্রশ্ন করা এবং যুক্তি সহকারে বিবেচনা করা এবং নতুন করে কিছু জিনিসে বিশ্বাস করা। দ্বিতীয়ত, নিজেদের জন্য একটি পরিচয় তৈরি করা।

এই সময়টা নিজের বিষয়ে অনেক নতুন জিনিস বিবেচনা করা ও খুঁটিয়ে দেখার সময়। এই সময় তাদের পুরনো জীবনধারা, নতুন সমস্যা, সমাজের চাহিদা, আশা আকাঙ্ক্ষাকে কেন্দ্র করে ছেলেমেয়েদের মধ্যে এক নাটকীয় পরিবর্তন আসতে পারে। তাঁরা নিজেদের জন্য যে পরিচয় তৈরি করে, তা সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়াও প্রয়োজন। তাই তাঁরা এই সময়টিতে এক আদর্শের সন্ধান করে। নিজেদের মধ্যে দলবদ্ধ হয়ে তথাকথিত নিয়মকানুনের বিরুদ্ধে তাঁরা লড়াই করার চেষ্টা করে।  

একজন ব্য ক্তির পরিচয় গড়ে ওঠে খুব অল্প বয়সে; তাঁরা নিজেদেরকে অন্যান্য লোকজন বা বাবা-মায়ের থেকে আলাদা মনে করে। এমনকি তাঁরা নিজেদের মা-বাবার থেকে আলাদা হয়েও থাকতে চাইতে পারে, এবং মা বাবার সাথে কথা বলাও তাদের বিরক্তির কারণ হয়ে উঠতে পারে। এই দূরে সরে যাওয়ার বিষয়টি মা-বাবাদের জন্য খুবই কষ্টকর হতে পারে। কিন্তু এটাই স্বাভাবিক।

অভিভাবক হিসাবে তাঁদের এই পরিচয় গড়ে তোলার সময় আমাদের পাশে থাকা উচিৎ, যাতে তাঁরা নিজেদের ক্ষমতা অনুযায়ী জীবনে সফল হতে পারে। এই সময় পরিচয় না তৈরি করতে পারলে পরবর্তীকালে তাঁদের মনে অন্তর্দন্ধ সৃষ্টি হয়। ফলে তাঁরা নিজেদের সন্দেহ যোগ্যতাকে করে, অন্যদের থেকে দূরে সরে যায়। অনেক সময় এই মানসিকতা বদমেজাজ বা দুর্ব্যবহারের মাধ্যমে প্রকাশ পেতে থাকে।

আমরা যদি এই বিষয়ে সচেতন হই, তাহলে কোনও সমস্যা ছাড়াই আমাদের মানসিক সুস্থতা বজায় রেখে তাঁদের সাহায্য করতে পারব। তাহলে আমাদের মেনে নিতে হবে যে আমরা ছেলেমেয়েদের জন্য বিরক্তির কারণ হয়ে উঠবো, বন্ধুবান্ধবরা তাদের কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। তাঁরা বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকৃষ্ট হবে, আর আমাদের সকল পরামর্শ তাঁরা খারিজ করে দেবে।

আমরা যদি এই সমটাকে, “নতুন সময়”, এবং একটি স্বাভাবিক চাপ বলে মেনে নেই, এবং তার সাথে তাল মিলিয়ে চলি তাহলে শুধু আমাদের সন্তানেরই নয়, আমাদের নিজেরও খুব উপকার হবে। আর নিজের কথা বলতে গেলে, আমি এই সময়টি প্রায় অতিক্রম করে ফেলেছি।

মল্লিকা শর্মা বেঙ্গালুরুর একজন কাউন্সেলার, যিনি নিজের কর্পোরেট চাকরি ছেড়ে মনোরোগ নিয়ে কাজ করছেন। তিনি নিয়মিত বেঙ্গালুরুর রীচ ক্লিনিকে বসেন। আপনাদের কোন বক্তব্য বা জিজ্ঞাস্য থাকলে তাঁকে columns@whiteswanfoundation.org তে লিখে জানাতে পারেন। সমস্ত প্রশ্নের উত্তর এখানে পাক্ষিকভাবে ছাপানো হবে।

logo
হোয়াইট সোয়ান ফাউন্ডেশন
bengali.whiteswanfoundation.org