আপনার টিনেজার কি শারীরিক গঠন নিয়ে অনলাইন বিদ্রূপের শিকার হচ্ছে?
ইন্টারনেট এবং প্রযুক্তি একপ্রকার দ্বিমুখী বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন মাধ্যম। একদিকে কিশোর-কিশোরী এবং অল্পবয়সি ছেলে-মেয়েরা প্রযুক্তি ব্যবহারের মধ্য দিয়ে জ্ঞান অর্জন করে। এই সম্ভাবনা এবং কার্যক্রম ইন্টারনেটের দ্বারা আমাদের কাছে সহজলভ্য হয়েছে। অন্যদিকে, অল্পবয়সি ছেলে-মেয়েরা ইন্টারনেট এবং প্রযুক্তির প্রতি দিনে দিনে আসক্ত হয়ে পড়ছে। জীবনের বহু মূল্যবান সময় তারা এর পিছনে ব্যয় করছে এবং ইন্টারনেটের প্রভাব তাদের জীবনে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু ইন্টারনেট প্রযুক্তির ক্ষেত্রে যেটা সবচাইতে চিন্তার বিষয়, যা নিয়ে আমরা খুব কম সংখ্যক মানুষই ওয়াকিবহাল, তা হল অনলাইন নির্যাতন। মাইক্রোসফ্ট সংস্থার করা এক সমীক্ষা অনুযায়ী সাইবারবুলিইং (ফেসবুক, টুইটার, ইন্সটাগ্রামের মতো ইন্টারনেট- প্রযুক্তির মাধ্যমে মানুষের উপর যে আক্রমণ বা নির্যাতন করা হয়)-এর ক্ষেত্রে ভারতের স্থান তৃতীয়। প্রথম ও দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে যথাক্রমে চিন এবং সিঙ্গাপুর। এবং এখনও পর্যন্ত নির্যাতনের সংখ্যা বা পরিমাণ নির্দিষ্টভাবে কোনও গবেষণায় ধরা পড়েনি। এই সমস্যাটা যত বড় ও গভীরই হোক না কেন, সাইবার-নিরাপত্তা নিয়ে আমাদের মধ্যে এখনও পর্যন্ত সচেতনতার অভাব রয়েছে এবং এই বিষয়ে একজন বাচ্চাকে সঠিক শিক্ষা দেওয়ার ক্ষেত্রে বহু অভিভাবক ও শিক্ষকের মধ্যে অনীহাও দেখা যায়।
ভারতের ৩৫টা শহরে বসবাসকারী শিশুদের মধ্যে ইন্টারনেটের ব্যবহার নিয়ে যে সমীক্ষা করা হয়েছিল তাতে ২৮ লক্ষ (সমীক্ষা হয়েছিল ৪০০ লক্ষকে নিয়ে) ইন্টারনেট ব্যবহারকারী বাচ্চা ছিল স্কুল পড়ুয়া, যাদের বয়স ছিল ১৪ বছর এবং তার উপরে। এর থেকে ইন্টারনেটের নিরাপত্তা বিষয়ক শিক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে ধারণা করা যায়।
অনলাইনে শিশুদের উপর নির্যাতন ও শোষণ তিনভাবে ঘটতে পারে-
১. সাইবারবুলিইং- বাচ্চাদের আবেগ-অনুভূতিকে হেনস্থা করা, মানহানি ঘটানো বা অপবাদ দেওয়া, ভয় দেখানো বা ধমকানো এবং সমাজ থেকে বিছিন্ন করে দেওয়ার হুমকি
২. অনলাইন যৌন নির্যাতন- যৌন হেনস্থা, বাচ্চাদের যৌন পছন্দ সম্পর্কে জানতে চাওয়া, ভয় দেখিয়া টাকা হাতানো
৩. অনলাইন যৌন শোষণ- বাণিজ্যিকভাবে যৌন শোষণ এবং শিশু পাচার
এই তিনটে ভাগের মধ্যে সাইবারবুলিইং- বেশি করা হয়। তবে সবসময়ে ক্ষতিগ্রস্ত বাচ্চার বন্ধু বা পরিচিত লোকরাই এই ঘটনা ঘটায়, তা নয়। অন্যান্য বলপূর্বক আক্রমণের মতো সাইবারবুলিইং-এর ক্ষেত্রেও অল্পবয়সি ছেলে-মেয়েদের কেমন দেখতে সে সম্পর্কে কূট মন্তব্য করা হয়, তাদের মানসিক ভাবে হেনস্থা করা হয়, মানহানি বা লজ্জা দেওয়া হয় এবং শেষ পর্যন্ত তাকে সমাজচ্যুত করার পদক্ষেপ করা হয়।
অনেক কমবয়সি ছেলে-মেয়ের লেখাপড়ার জীবনে অনেকেই তাদের কাছের মানুষ হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু অনলাইনে যখন তাদের দৈহিক গড়ন নিয়ে হেয় করা হয় এবং তার ফলে যখন বাচ্চাদের মনে দাগ কাটে, তখন তা আমাদের কাছে ততটা গ্রাহ্য হয় না। ব্যাঙ্গালোরের ফর্টিস লা ফেম্মে-র মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডঃ অশ্লেষা বাগাডিয়ার মতে ''কিছু অল্পবয়সি ছেলে-মেয়েদের মনে সাইবারবুলিইং-এর মতো আচরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর ক্ষেত্রে ভয় রয়েছে। কারণ তারা ভাবে যে এর ফলে তাদের সামাজিক সম্মান কমে যাবে এবং তারা আরও বেশি করে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের শিকার হবে।''
নিজের শারীরিক গঠন নিয়ে অন্যদের কাছ থেকে লজ্জিত হওয়ার জন্য মানুষের মনে কী প্রতিক্রিয়া হয়?
২২ বছর বয়সি অভিনেত্রী ও একটা কনটেন্ট সৃষ্টিকারী দলের সদস্য অনুপমা মান্নে 'গার্ল ফরমুলা' নামে একখানা ওয়েব সিরিজ তৈরি করেছিল যেখানে সে নিজেও সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিল। সে জানিয়েছিল যে এমন কিছু মন্তব্য সে তার দর্শকদের কাছ থেকে শুনেছিল, যা ছিল খুবই 'শোচনীয়' ও 'ভয়াবহ'। সে বলেছিল ভিডিওয় ফুটে ওঠা তার দৈহিক গড়ন নিয়ে তাকে অনবরত হেয় করা হত। দর্শকরা তার রূপ, কণ্ঠস্বর এবং দৈহিক গঠন নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করত। এমন অনেক দর্শক ছিল যারা সরাসরি সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজেদের মতামত দিয়ে লিখত যে ওই মেয়েটি নাকি কোম্পানির নাম ডোবাবে অথবা ভিডিওয় যখন তাকে দেখা যায় তখন পুরো স্ক্রিন জুড়ে তার উপস্থিতি থাকে। এসব মন্তব্য শুনে অনুপমা লম্বা কুর্তি পরা শুরু করেছিল। কারণ ভিডিওয় তাকে কেমন দেখতে লাগছে তা নিয়ে অনুপমার মধ্যে অত্যন্ত সচেতনতার বোধ জেগেছিল।
ব্যাঙ্গালোরের ইনারসাইট কাউন্সেলিং অ্যান্ড ট্রেনিং সার্ভিস-এর একজন কাউন্সেলর অজন্তা দে-র মতে বয়ঃসন্ধি এবং অল্পবয়সি ছেলে-মেয়েরা যখন স্কুল বা কলেজে পড়ে তখন তাদের মধ্যে সদর্পে এগিয়ে যাওয়ার একপ্রকার মনোভাব থাকে এবং নিজেকে সমাজে বাকি পাঁচজনের চেয়ে আলাদা বলে ভাবার প্রবণতা জন্মায়। এই অবস্থায় যদি অনলাইনে তাদের দৈহিক গঠন বা গড়ন নিয়ে কেউ তাদের অপ্রস্তুত করে তখন তা সহজভাবে মেনে নেওয়া তাদের পক্ষে খুবই কষ্টকর হয়। এই পরিস্থিতিতে মানুষের নিজস্ব সত্ত্বার পরিচয় ও তার মূল্যায়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। তাই এইসময়ে কারোর শরীর-স্বাস্থ্যের গঠন নিয়ে অন্যদের হাসিঠাট্টা ওই মানুষটির নিজের সম্পর্কে লজ্জার বোধকে বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে তাদের কাছে এই বার্তাই পৌঁছয় যে অন্যদের চোখে 'তুমি মোটেই ঠিকঠাক বা সমুচিত নও''।
এই ধরনের দৈহিক গঠন সংক্রান্ত লজ্জা একজন কমবয়সির মনে কেমন প্রভাব ফেলে? এর উত্তরে মুম্বই-এর রেসপন্সিবল নেটিজ্ম নামক একটি ট্রাস্ট, যারা অনলাইনে বাচ্চাদের নিরাপত্তার বিষয় নিয়ে কাজ করে, তার প্রতিষ্ঠাতা সোনালি পাটকর জানিয়েছেন যে, এর প্রভাব অত্যন্ত চরম হয়। এটা নির্ভর করে কী ধরনের নির্যাতন একজন কিশোর বা কিশোরীকে সহ্য করতে হচ্ছে এবং সে কীভাবে ওই পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে সক্ষম হচ্ছে তার উপর। অল্পবয়সি ছেলে-মেয়েদের আচরণের উপর এই ঘটনার নানারকম প্রভাব পড়তে পারে। যেমন- তার মধ্যে রাগ, অস্থিতরতা, ভয়, নিজেকে একটা খোলসের মধ্যে লুকিয়ে রাখা, বাড়িতে খুব হিংস্র আচরণ করা এবং এর থেকে হতাশা, নিজেকে সমাজ থেকে দূরে সরিয়ে ফেলা প্রভৃতি দেখা দেয়। অনেক ক্ষেত্রে তারা অবসাদগ্রস্তও হয়ে পড়তে পারে।
অনলাইন উপহাসের ফলে মানুষের অপ্রস্তুত হওয়ার বহিঃপ্রকাশ খুবই ব্যক্তিগত একটা বিষয় এবং বয়ঃসন্ধির ছেলে-মেয়েদের পক্ষে এই ঘটনার দিশা খুঁজে পাওয়া ও নিজেদের আচরণের বাস্তবতা উপলব্ধি করা খুবই কঠিন।
ডঃ বাগাডিয়ার মতে, অফলাইন নির্যাতনের (বুলিইং) চেয়ে অনলাইন নির্যাতনের (সাইবারবুলিইং) প্রভাব সুদূরপ্রসারী। অনলাইন মন্তব্যের তুলনায় অফলাইন মন্তব্যের জোর তেমন থাকে না। কারণ এখানে কথাবার্তা তখনই শেষ হয়ে যেতে পারে যখন আর দুটো মানুষের মধ্যে কোনও যোগাযোগই থাকে না। এছাড়া যেহেতু অনলাইন মন্তব্যের ক্ষেত্রে ছদ্মনাম ব্যবহার করা যায় সেহেতু অন্যের প্রতি উপহাস, ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ বা তাকে লজ্জায় ফেলার মতো ঘৃণ্য আচরণ করার প্রবণতা বাড়তে থাকে।
কাউন্সেলর অজন্তা দে বলেছেন যে এই ধরনের ঘটনা মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর গভীর প্রভাব ফেলে। তাঁর মতে ''অনলাইনে বা অফলাইনে, যেভাবেই মানুষের দৈহিক গঠন নিয়ে তাকে লজ্জায় ফেলা হোক না কেন, এর প্রভাব তার আত্মনির্ভরতার উপর পড়ে। এই ঘটনার কুপ্রভাব হিসেবে আবেগের বশবর্তী হয়ে খাওয়াদাওয়া, মানসিক উদ্বেগ এবং কিছু ক্ষেত্রে খাদ্যাভ্যাসজনিত অব্যবস্থাও দেখা দেয়। অধিকাংশ মানুষের ক্ষেত্রে নিজের প্রতি বিচার ক্ষমতা হারিয়ে যায় এবং এর জন্য জরুরি যথাযথ মূল্যায়ন করার ব্যবস্থা নেওয়া।''
কীভাবে এই সমস্যার প্রতিকার করতে বাচ্চার অভিভাবকরা তাদের সাহায্য করতে পারে?
একবার যদি কোনও বয়ঃসন্ধির ছেলে বা মেয়ে অনলাইনে নির্যাতনের শিকার হয় তাহলে তার অভিভাবকরা সেই ছেলেটাকে বা মেয়েটাকেই দোষ দেয় এবং মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট ব্যবহার বন্ধ করতে বলে। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে এভাবে এই সমস্যার সমাধান করা আদৌ সম্ভব নয়। ডঃ বাগাডিয়া বলেছেন, ''যখন অভিভাবকদের কাছে বয়ঃসন্ধির ছেলে-মেয়েরা এই সমস্যার কথা বলবে তখন অভিভাবকদের উচিত সে কথা সময় নিয়ে শোনা। কারণ অনেক ছেলে- মেয়েরা এই ব্যাপারে তাদের অভিভাবকদের কাছে কিছু বলতেই চায় না। তাই যদি অভিভাবকরা তাদের বাচ্চাদের সমস্যার সমাধান করতে চায় তাহলে দু'পক্ষের মধ্যে যোগাযোগের রাস্তা খোলা রাখতে হবে। ছেলে-মেয়েকে এই বলে আশ্বস্ত করা দরকার যে অভিভাবকরা তাদের পাশে রয়েছে ও সমস্যার সমাধান করার জন্য উপযুক্ত পথ খুঁজছে।''
বিশেষজ্ঞের পরামর্শ অনুযায়ী নিম্নলিখিত উপায়ে অভিভাবক এবং স্কুল যৌথভাবে অনলাইন-নিরাপত্তার দায়িত্ব নিতে পারে-
ইন্টারনেট ব্যবহারের উপর সময়সীমা বেঁধে দেওয়া এবং অল্পবয়সি ছেলে- মেয়েকে খেলাধুলো ও শরীরচর্চা করতে উৎসাহিত করা
বাচ্চাদের সঙ্গে সাইবার সংক্রান্ত সমস্যা নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা করা জরুরি
বাড়িতে সাইবার শিক্ষার পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। ইন্টারনেট ও প্রযুক্তির ভালো-মন্দ নিয়ে আলাপ-আলোচনা করতে হবে
বাড়িতে বাচ্চাদের সঙ্গে যোগাযোগের সব রাস্তা খোলা রাখতে হবে এবং তাদের সঙ্গে অনলাইন-প্রযুক্তি সংক্রান্ত সব তথ্য আদান-প্রদান করতে হবে
স্কুল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যৌথভাবে সচেতনতা গড়ে তোলার জন্য ব্যবস্থা
নিতে হবেপ্রতিটি মানুষের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য, তাদের ভিন্ন ভিন্ন দৈহিক গঠন নিয়ে বাচ্চাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলা প্রয়োজন। সেই সঙ্গে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল মানুষে-মানুষে পারস্পরিক সহানুভূতির ধারণা গড়ে তোলা
সূত্র:
Child Online Protection In India—UNICEF
এই প্রবন্ধটি লিখতে সাহায্য করেছেন নিমহ্যান্সের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট ডঃ মনোজ শর্মা, ব্যাঙ্গালোরের ফর্টিস লা ফেম্মের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডঃ অশ্লেষা বাগাডিয়া, মুম্বইয়ের রেসপন্সিবল নেটিজম-এর প্রতিষ্ঠাতা সোনালী পাটকর এবং ইনারসাইট কাউন্সেলিং সার্ভিস-এর কাউন্সেলর অজন্তা দে।