কিশোর-কিশোরীদের মাথায় কী চলতে থাকে

কিশোর-কিশোরীদের মাথায় কী চলতে থাকে

কেন আমি এভাবে ভাবি? কেন আমি আমার আবেগানুভূতিকে বুঝতে পারি না? আমার কাজকর্ম কেন অন্যদের কাছে বোধগম্য হয় না? আমাদের চারপাশে থাকা বড়দের আচরণ কেন হঠাৎ করে বদলে যায়? কেন আমার নিজের উপরে নিয়ন্ত্রণ থাকে না? এমনটা কি শুধু আমারই হয়? নাকি অন্যান্যদেরও হয়? একথা কাকে আমি জিজ্ঞাসা করব? এক্ষেত্রে আমি কি করব? আমি দেখছি যে আমি কিছুতেই অন্য কাউকে বিশ্বাস করতে পারছি না...

একজন কিশোর বা কিশোরী হিসেবে তোমার মনে কি এই প্রশ্নগুলো ওঠে? এখানে আমরা এমনই কিছু প্রশ্নের উত্তরের মধ্য দিয়ে তোমাকে বা তোমাদের সাহায্য করব নিজেকে বা নিজেদের ভালোভাবে বুঝতে।   

কী ঘটছে, তা আমি বুঝতে পারছি না। কেন আমি এমন বিভ্রান্ত হয়ে যাই বা দিশাহারা বোধ করি?

শুধু তুমি একা নও, তোমার মতো আরও অনেক কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে এমন বিভ্রান্তি ও হতাশা দেখা যায়। তোমার মধ্যে দেখা দেওয়া আবেগ বা অনুভূতির জন্য  দায়ী হল তোমার শারীরিক হরমোনগুলো এবং সেই সঙ্গে রয়েছে এইসময়ে অর্থাৎ কৈশোর কালে তোমার মস্তিষ্কের বিকাশজনিত কারণটিও। নিজের অবস্থাটি ভালোভাবে বুঝতে পারলে বা উপলব্ধি করতে পারলে তা তোমার পক্ষে খুবই সাহায্যদায়ক হবে এবং তোমার মধ্যে ঘটা রূপান্তরগুলোকে সহজ করে তুলবে।

কৈশোরে ঘটা বিকাশগুলো শুধু শারীরিক বা দৈহিক হয় না, তা মস্তিষ্কেরও হয় এবং সেগুলো পরিবর্তনশীল হয়ে থাকে। আমাদের মধ্যে প্রচলিত একটা বিশ্বাস রয়েছে যে ছ'বছর বয়সের মধ্যেই মস্তিষ্কের গুরত্বপূর্ণ বিকাশ ঘটে এবং এই বিকাশের ধারা কুড়ি বছরের শুরু পর্যন্ত বজায় থাকে। বয়ঃসন্ধিকাল মস্তিষ্কের সেইসব অংশের বিকাশের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ সময় যে অংশগুলো আমাদের মধ্যে যুক্তিপূর্ণ চিন্তাভাবনা, যৌক্তিকতা, মতামত ক্ষমতা, পরিকল্পনা শক্তি এবং আরও অন্যান্য উচ্চতর   মানসিক প্রক্রিয়ার প্রয়োগ ঘটাতে সাহায্য করে।

এখন দেখা যাক বয়ঃসন্ধির সময়ে আমাদের মস্তিষ্কের বিভিন্ন পরিবর্তনগুলোকে।

হরমোনের পরিবর্তন

তোমরা হয়তো বড়দের কাছ থেকে হরমোনের বিষয়ে শুনে থাকবে যে এর সঙ্গে কিশোর-কিশোরীদের আচার-আচরণের একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। তোমরা  হয়তো এটা জানোই যে একবার বয়ঃসন্ধির দোরগাড়ায় পৌঁছানো মানে শরীর থেকে আগের থেকে অনেক বেশি পরিমাণ যৌন হরমোন নির্গত হওয়া, যার ফলে একজন কিশোর বা কিশোরী কোনওরকম চিন্তাভাবনা না করে একমুহূর্তে বা চটজলদি বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে। তবে শুধু এক্ষেত্রেই নয়, হরমোন আরও নানাভাবে মানুষের আচার-আচরণ বা কার্যাবলীর উপর প্রভাব বিস্তার করে থাকে।

মস্তিষ্কের অধিকাংশ বিকাশ আমাদের ঘুমের সময়ে ঘটে, যখন স্নায়ুস্পন্দনের নতুন প্রবাহ গড়ে ওঠে এবং স্মৃতিশক্তি জোড়ালো বা শক্তিশালী হয়। পিটুইটারি গ্রন্থি থেকে বিকাশজনিত হরমোন নির্গত হয় এবং সেক্ষেত্রে নতুন কিছু শেখার ও তা প্রতিষ্ঠা করার জন্য ঘুম খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় হিসেবে পরিগণিত হয়। কৈশোরকালে  নিদ্রাচক্রের অবস্থান বা ধরনটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।  

দুটো হরমোনের দ্বারা আমাদের ঘুম নিয়ন্ত্রিত হয়। এই হরমোন দুটি হল- কর্টিসল  এবং মেলাটোনিন। কর্টিসল আমাদের ঘুম ভাঙাতে বা ঘুম থেকে উঠতে সাহায্য করে এবং মেলাটোনিন আমাদের নিদ্রাচ্ছন্ন বা ঘুমাতে সহায়তা করে থাকে। ঘুম সংক্রান্ত গবেষণায় দেখা গিয়েছে বড়দের ক্ষেত্রে রাত ১০টা বাজলে মেলাটোনিন নির্গত হয়। তবে কিশোর-কিশোরীদের ক্ষেত্রে মেলাটোনিনের নিঃসরণ দেরি করে হতে পারে, যদি তারা অন্য কোনও কাজে ব্যস্ত থাকে এবং তাদের মনোযোগ  সেদিকেই বেশি করে থাকে। এর পিছনে অংশত সাংস্কৃতিক কারণ থাকে (যদি কিশোর-কিশোরীরা বেশি রাত পর্যন্ত তাদের বন্ধুবান্ধব বা প্রিয়জনের সঙ্গে পার্টি করতে ব্যস্ত থাকে)। কিন্তু জৈবিকভাবে এর জন্য দেরি করে মেলাটোনিন হরমোনের নিঃসরণই দায়ী থাকে। এই পরিস্থিতিতে যদি তোমাদের অর্থাৎ কিশোর-কিশোরীদের খুব ভোরে স্কুল বা কলেজে যেতে হয় তাহলে রাতে পর্যাপ্ত ঘুম না হওয়ার জন্য তাদের মধ্যে খিটখিটে ভাব ও লেখাপড়ায় মনোযোগের অভাব দেখা যায়।

তোমাদের শারীরিক ও মস্তিষ্কের বিকাশের জন্য কমপক্ষে ছ'ঘণ্টা গভীর ঘুম বা সম্পূর্ণ আরামদায়ক ঘুম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সারাদিনের কাজকর্মের রুটিন বা তালিকা এমনভাবে করতে হবে যেখানে পড়াশোনা ও বিনোদনের জন্য শুধু সময় নয়, পর্যাপ্ত ঘুমের জন্যও নির্দিষ্ট সময় হাতে রাখতে হবে। এই সময়ের বিভাজন যথাযথভাবে করার জন্য অভিভাবক বা বড় দাদা-দিদিদের কাছ থেকে সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। 

প্রিফন্টাল লোবের বিকাশ

প্রিফন্টাল লোব মস্তিষ্কের এমন একটি অংশ যা আমাদের সকল প্রকার যুক্তিগ্রাহ্য সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে। এর ফলে আমরা কোনও নির্দিষ্ট কাজে ঝুঁকি রয়েছে কিনা তা বিচার করতে পারি, মতামত প্রকাশ করতে পারি, যুক্তিবাদী হতে পারি, ঝোঁকের বা খেয়ালের বশে কাজ করা থেকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ বা বিরত করতে পারি অথবা আচরণ প্রশমন করতে পারি প্রভৃতি। একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের ক্ষেত্রে  মস্তিষ্কের এই অংশটি পুরোপুরি বিকশিত হয় এবং মস্তিষ্কের অন্যান্য সব অংশের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তোলে। তাই বড়দের মস্তিষ্কের কাজ সর্বাত্মক হয়, মস্তিষ্কের সব অংশ থেকে পাওয়া তথ্যগুলোকে তারা ঐক্যবদ্ধ করতে পারে এবং সুসংবদ্ধ সিদ্ধান্ত নিতে পারে। কিন্তু কৈশোর কালে মস্তিষ্কের এই অংশটি পুরোপুরি বিকশিত হয় না, বিকাশের প্রক্রিয়া তখনও চলে এবং তা কুড়ি বছরের গোড়া পর্যন্ত
চলতে থাকে।

কিশোর-কিশোরীদের মস্তিষ্কের গঠনগত বিকাশের অস্পূর্ণতা যেমন থাকে, তেমন আবার তাদের মস্তিষ্কের কার্যাবলীর পরিপূর্ণতাও গড়ে ওঠে না। বড়দের মস্তিষ্কের মতো তাদের মস্তিষ্ক তথ্যের আদান-প্রদান তত তাড়াতাড়ি করতে পারে না। এর জন্য দায়ী থাকে নিউরোনের ত্রুটি। নিউরোন হল এমন একধরনের কোষ যা মস্তিষ্কের এক অংশ থেকে অন্য অংশে তথ্যের আদান-প্রদান বা সরবরাহে সাহায্য করে। এই কোষগুলো একধপ্রকার চর্বির স্তরের মতো সুরক্ষা কবচ ইনসুলেটিং মেটেরিয়াল) দ্বারা ঢাকা থাকে, যা মায়োলিন শিদ (myelin sheath) নামে  পরিচিত। মায়োলিন শিদ ছাড়া নিউরোনের তথ্য আদান-প্রদানের গতির চেয়ে মায়োলিন সিদ যুক্ত নিউরোন প্রায় ১০০গুণ বেশি গতিতে মস্তিষ্কের এক অংশ থেকে অন্য অংশে তথ্যের আদান-প্রদান করতে সক্ষম হয়। তাই তোমরা (কিশোর-কিশোরীরা) দেখে থাকবে যে তোমাদের ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের নিউরোন নামক কোষের এহেন ফুলে-ফেঁপে ওঠার প্রক্রিয়াগত বিকাশ তখনও চলে বলে তোমাদের মস্তিষ্কের এক অংশ থেকে অন্য অংশে তথ্যের আদান-প্রদান ধীর গতিতে হয় এবং ঝোঁকের বা খেয়ালের বশে কাজ করার প্রবণতা বা আবগেপ্রবণতা তোমাদের মধ্যে বেশি দেখা যায়।

নিউরোনের উপর মায়োলিনের এই স্তরের গঠন প্রথম পশ্চাদ মস্তিষ্ক থেকে শুরু হয়  আর এই অংশটি কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে এমন আবেগ ও অনুভূতি জন্মাতে  সাহায্য করে যার ফলে তারা 'অনুভব করে বেশি এবং চিন্তা করে কম'। এই পরিস্থিতির ফলে তোমাদের মতো কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে একপ্রকার দুর্বল বা বিপজ্জনক আবেগপ্রবণতা গড়ে ওঠে এবং মেজাজ-মর্জির পরিবর্তনও বেশি পরিমাণে ঘটে। তোমাদের আবেগপ্রবণতা তোমাদের বাচ্চাবেলার থেকে এখন অর্থাৎ কৈশোরকালে অনেক বেশি গভীর হয়ে ওঠে এবং প্রায়শই তোমাদের দিশাহারা করে তোলে। এর ফলে তোমাদের মধ্যে ঝোঁক বা খেয়ালের বশে সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রবণতা ক্রমশ বেড়ে যায় এবং এই প্রবণতায় যুক্তির চাইতে আবেগই প্রধান হয়ে দেখা দেয়।

এই সমস্যার মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে হঠাৎ সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রবণতা দূর করতে হবে এবং যে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে তার আগে-পিছের পরিস্থিতি বা খুঁটিনাটি বিষয় বিবেচনা করতে হবে। এক্ষেত্রে তোমরা এমন কারোর সঙ্গে কথাবার্তা বলতে পারো যে তোমাদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসবে। তবে খেয়াল রাখতে হবে  যে যার সঙ্গে কথা বলছ সে যেন তোমাদের মতো আরেকজন কিশোর বা কিশোরী না হয়, যার মধ্যে তোমার মতো একইরকম বদল দেখা দিচ্ছে। সেক্ষেত্রে তোমাদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসতে পারে তোমাদের অভিভাবক, বড় দাদা-দিদি, শিক্ষক বা অন্য কোনও বিশ্বস্ত মানুষ।

 সাইন্যাপস বা প্রান্তসন্নিকর্ষের লঘুকরণ (সিন্যাপটিক প্রুনিং)   

এর ফলে যে শুধু তোমাদের মস্তিষ্কের স্নায়ুস্পন্দন-প্রবাহের গুণমানের পরিবর্তন ঘটে  তা নয়, প্রবাহের মাত্রারও বদল ঘটে। বয়ঃসন্ধির দিকে তোমরা যত এগোতে থাকবে  তোমাদের মধ্যে এই প্রবাহের মাত্রা প্রকৃতপক্ষে কমতে থাকবে। ৫ বছর বয়সে তোমাদের মস্তিষ্কের এক অংশের সঙ্গে অন্য অংশের মধ্যে যদি ১৫টি স্নায়ুস্পন্দনের  প্রবাহ গড়ে ওঠে তাহলে কৈশোরে তার পরিমাণ ২টোতে এসে ঠেকে। এই দুটোর  মধ্যে ১টা অধিকাংশ সময়ে সক্রিয় থাকে, আর অন্যটা তার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে অপ্রচলিত হয়ে যায়। এই স্নায়ুস্পন্দনের প্রবাহটি আগের ১৫টি প্রবাহের থেকে বেশি শক্তিশালী হয়। এর সাহায্যে সহজে তথ্যের আদান-প্রদানের দ্বারা মস্তিষ্কের চিন্তন প্রক্রিয়া অনেক বেশি নিয়মানুগ এবং সংগঠিত হয়ে ওঠে।     

অ্যামিগডালা এবং লিম্বিক সিস্টেম

একটা বিষয় ভাবলে আমরা অবাক হই যে কেন ২১ বছর বয়সটা মদ্যপানের ক্ষেত্রে আইনসংগত? নীচের অংশটি পড়লে তা বোঝা যাবে।

লিম্বিক সিস্টেম এবং অ্যামিগডালা আমাদের আবেগপ্রবণ করে তোলে। মস্তিষ্কের এই অংশের বিকাশ প্রিফন্টাল কর্টেক্সের বিকাশের আগে হয়। আবেগজনিত অনুভূতিগুলোকে চিহ্নিত বা শনাক্ত করার ক্ষেত্রে প্রিফন্টাল কর্টেক্স গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই কারণেই হয়তো আবেগময় পরিস্থিতি বুঝতে বা তার মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে তোমাদের অসুবিধা বা সমস্যা হয়। মস্তিষ্কের এই অংশটি আমাদের সুখকর অনুভূতি ও আত্মসন্তুষ্টি বা তৃপ্তি বোধকে নিয়ন্ত্রণ করে। এই অংশটির   বিকাশ যখন সম্পূর্ণ হয়, তখনও মস্তিষ্কের ঝুঁকি বিবেচনাকারী অংশটির বিকাশের প্রক্রিয়া চলতে থাকে। আর সেজন্যই ড্রাগ নেওয়া, মদ্যপান করা এবং নিরাপদ নয় এমন মোটর গাড়ি ইত্যাদির দৌড়-প্রতিযোগিতায় নামার মতো ঝুঁকিপূর্ণ বা বিপজ্জনক আচার-আচরণগুলো তোমাদের কাছে একপ্রকার মানসিক সন্তুষ্টি বা সুখ প্রদানকারী অথবা তৃপ্তিদানকারী বিষয় বলে মনে হয়।  

২১ বছর বয়স মদ্যপানের জন্য আইনসংগত কারণ তখনও তোমাদের মস্তিষ্ক বিকাশের প্রক্রিয়া চলতে থাকে এবং মদের মতো যেকোনও নেশার বস্তু এই প্রক্রিয়ার গতি কমিয়ে দিতে পারে। আর এই বয়সে অতিরিক্ত মদ্যপান করলে তা তোমাদের মতো কিশোর-কিশোরীদের নেশার বস্তুর প্রতি আসক্তিজনিত ঝুঁকি বা বিপজ্জনকতার দিকে ঠেলে দিতে পারে।                           

Related Stories

No stories found.
logo
হোয়াইট সোয়ান ফাউন্ডেশন
bengali.whiteswanfoundation.org