আপনার উচ্চাশার ভার আপনার সন্তান সইতে পারবে তো?
সম্প্রতি আমার একজন ক্লায়েন্টের সাথে সাক্ষাৎ হয় যিনি বিবাহ বিচ্ছেদের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন। আমি আশা করেছিলাম যে তিনি হয়ত সেই জন্যে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভুগছেন। কিন্তু তাঁর বদলে দেখলাম তিনি তাঁর বাবা-মাকে নিয়ে চিন্তিত। তিনি কোনও দিনই তাঁদের খুশী করে উঠতে পারেননি। তার উপরে এইসব! এখন তাঁর বাবা-মা সমাজে মুখ দেখাবেন কি করে? এই ধাক্কা সামলাবেন কি করে? এই সমস্ত প্রশ্নে আমার ক্লায়েন্ট বিচলিত বোধ করছিলেন।
আমি এরকম প্রচুর বাবা-মাকে দেখেছি যারা নিজের সন্তানের প্রতিটি নড়াচড়া ঠিক করে দেওয়ার চেষ্টা করেন। এবং সন্তানদের সেটিই মেনে নিতে হয়। এতে সন্তানদের আখেরে মঙ্গলই হয়, এবং এটাই নিয়ম, এটাই অনন্ত কাল ধরে হয়ে আসছে।
যদিও প্রত্যেকটি শিশুরই, নিজের গতিপথ নিজেই বেছে নেওয়া উচিৎ। বাবা-মা হিসেবে আমাদের তাকে শুধুমাত্র সাহায্য করা উচিৎ। সেটা তবেই সম্ভব যদি আমরা তাঁদেরকে একটি মজবুত শেকড় এবং খোলা আকাশে উড়ে যাওয়ার জন্য ডানা মেলতে দেই। মার্কিনি টিভি সঞ্চালক ব্রায়ান স্টেসির মতে, “তাঁদের মধ্যে যে কোনও কাজ করতে পারার আত্মবিশ্বাস জাগান, অভিভাবক হিসেবে এর থেকে সেরা আশীর্বাদ আর কিছু হতে পারে না।”
আপনার মনে রাখা উচিৎ যে সে পৃথিবীতে নিজের লক্ষ্য জয় করতে এসেছে, আপনার শখ-আহ্লাদ পূরণ করতে না। সে এখানে আপনার পরিবারের নাম উজ্জ্বল করতে বা আপনার পারিবারিক ব্যাবসা সামলাতে, বা আপনাকে বৃদ্ধ বয়সে দেখতেও আসেনি। তারা এসেছে নিজেদের জীবন নিজেই গড়ে তুলতে এবং এই ভাবে যখন তারা জয়ের মাইল ফলক পেরোবে আমাদের তাতে গর্বিত অনুভব করা উচিৎ।
তাহলে সন্তানের প্রকৃত মঙ্গল কামনার জন্যে সবার আগে আমাদের উদার মনের অধিকারী হতে হবে — না হলে আমার ক্লায়েন্টের মতই তাঁর জীবনও এক সময় অসহ্য হয়ে উঠবে।
আমাদের সমাজে বহুদিন ধরেই অভিভাবকত্বের দুটি ধরণ নিয়ে মতানৈক্য চলছে। চীনদেশীয় পদ্ধতি ও মার্কিনি পদ্ধতি। প্রথমটি, কড়া শাসন ও উচ্চাশায় মোড়া। উদাহরণস্বরূপ চীনা শিশুদের, বাইরে রাত কাটাতে, প্রেম করতে, স্কুলে খেলাধূলা করতে, টিভি দেখতে বা কম্পিউটার গেমস্ খেলতে, পরীক্ষায় ৯৫% ‘এর কম নম্বর পেতে, পিয়ানো বা ভায়োলিন ব্যতীত অন্য যন্ত্র বাজাতে, দেওয়া হয় না। মার্কিন পদ্ধতিতে আবার, সন্তানের শখ, আহ্লাদ, চাহিদা, স্বপ্নকে অনেক বেশী গুরুত্ব দেওয়া হয়। প্রথম পদ্ধতি অনুসরণ করলে নিঃসন্দেহে ভাল ছাত্র পাওয়া যায়, কিন্তু সৃজনশীল মানুষ পাওয়া যায় না। বলাই বাহুল্য, আমাদের দেশের ছবিটাও কিছুটা এরকমই।
আপনি নিজেই ইন্টারনেটে খুঁজে দেখুন যে সৃজনশীলতায় কারা এগিয়ে? চীন না আমেরিকা? এখন প্রশ্ন হল, সমগ্র দুনিয়া যেখানে অভিনব, সৃজনশীল, চটপটে, উপস্থিত বুদ্ধি সম্পন্ন ছেলে মেয়েকে চাইছে, সেখানে আপনি কি চান? যে আপনার সন্তান মুখস্থ বিদ্যায় পটু এক যন্ত্র হোক? যাকে শুধু যা করতে বলা হবে, তা সে মুখ বুজে যন্ত্রের মত পালন করে যাবে। সমস্যা কি শুধুই আমাদের বর্তমান শিক্ষা ব্যাবস্থার?
কাজেই স্কুলের পরীক্ষায় একশোয় একশো পেলেই যে আপনার সন্তান জীবনে সফল হবে, তাঁর কোনও মানে নেই। জীবন-পরীক্ষায় পাশ করাটাই হল আসল কথা। স্কুলের পরীক্ষায় সাফল্য শুধুমাত্র কয়েকটি দরজা খুলে দেয়। কিন্তু বহির্জগতের লড়াই তার চেয়ে অনেক বেশী কঠিন।
তার মানে এই নয় যে মাতা-পিতা হিসেবে আপনার কোনও আশা আকাঙ্ক্ষা থাকবে না। কারণ ছোটরা বড়দের খুশী করার জন্যে অনেক কিছু করতে চায়, কাজেই সামান্য কিছু চাহিদা তাঁদের জীবনে এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে, নতুন জিনিস শিখতে সাহায্য করবে।
মোদ্দা কথা হল যে সেই চাহিদা যেন শুধু নম্বর আর সামাজিক রীতি-নীতিতে আটকে না থাকে।
সে জীবনে যাই করুক, যেন ভালবেসে করে ও মন দিয়ে করে; তাঁর যেন বিবেক–বুদ্ধি-চিন্তা সুস্থভাবে বিকশিত হয়; সে যেন যে কোনও লড়াইতে জিততে পারে; সমাজে মিশতে পারে; নিজেকে বিশ্বাস করে; এবং স্বপ্ন দেখতে শিখতে পারে – মাতা-পিতা হিসেবে এইটুকুই আপনার কামনা হওয়া উচিৎ।
সঠিক শিক্ষা এবং স্বাধীন পরিবেশ – আমরা আমাদের সন্তানকে এইটুকু কি অন্তত দিতে পারি না?
প্রতিদান স্বরূপ আপনি কি পাবেন? শ্যারন গুডম্যানের ভাষায়, “আপনার সন্তানের নিজেকে চিনে ওঠার এক রোমাঞ্চকর যাত্রা,” ছাড়া আর কিছুই আশা করা উচিৎ নয়!
মল্লিকা শর্মা বেঙ্গালুরুর একজন কাউন্সেলার, যিনি নিজের কর্পোরেট চাকরি ছেড়ে মনোরোগ নিয়ে কাজ করছেন। তিনি নিয়মিত বেঙ্গালুরুর রীচ ক্লিনিকে বসেন। আপনাদের কোন বক্তব্য বা জিজ্ঞাস্য থাকলে তাঁকে columns@whiteswanfoundation.org তে লিখে জানাতে পারেন। সমস্ত প্রশ্নের উত্তর এখানে পাক্ষিকভাবে ছাপানো হবে।