নিখুঁত নাকি মন্দের ভালো? নিঃস্বার্থ না স্বার্থপর?
আমি এই বিষয়টি সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল যে, আমার কিছু লেখা পড়ে অভিভাবকদের মনে নিজেদের যোগ্যতা সম্বন্ধে সন্দেহ দানা বাঁধতে শুরু করেছে। ভয়মুক্ত হয়ে তাঁরা হয়তো এটাই বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন যে, তাঁরা যা করছেন বা করার কথা ভাবছেন তা তাঁদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের উপর বিরূপ প্রভাব ফেললেও, এতে অভিভাবকদের বিন্দুমাত্র যায়-আসে না। যদিও বাবা-মায়েরা তাদের সন্তানের ভবিষ্যৎ এবং নিজেদের দক্ষতা সম্পর্কে মোটেই চিন্তিত নন। তবু এই নিয়ে তাঁদের সম্পর্কে আমার মনে ভয় ছাড়াও রয়েছে আরও একটি ভাবনা। কারণ আগামী যে সময় আগত, তা কেবল অন্ধকারময়ই নয়, অনিবার্যও বটে।
আমার এই লেখার উদ্দেশ্য এমন নয় যে, আমি অভিভাবকত্বের আনন্দকে একেবারে মাটি করে দিচ্ছি বা অভিভাবকদের যোগ্যতা বা কর্মক্ষমতাকে সন্দেহের দৃষ্টিতে বিচার করতে চাইছি। কোনোরকম বিভ্রান্তির অবকাশ না রেখে আমি এইটুকুই বলার চেষ্টা করছি যে, কীভাবে একটি সহজ বিষয়কে সঠিক দিশা না দেখিয়ে ভুল পথে চালিত করা হয় এবং লক্ষ্যে পৌঁছনোর বৃথা চেষ্টা চালানো হয়, যদিও আমরা প্রত্যেকেই নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে মরিয়া। এই বিষয়টি সম্পর্কে অভিভাবকদের সচেতন করার উদ্দেশ্যেই আমার এই লেখা।
জীবনে চলার পথের অন্যান্য অনেক বাঁকের মধ্যে একটি হল অভিভাবকত্ব। একদিকে এই বিষয়টি আমাদের কাছে অত্যন্ত আনন্দের, লোভনীয়। অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আমরা নতুন কত দৃশ্য প্রত্যক্ষ করি এবং বাধা-বিঘ্ন অতিক্রম করে নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছাতে চাই। আবার অন্যদিকে, অভিভাবকত্বের যাত্রাপথটি কারও কারও কাছে মোটেই মসৃণ নয়। তাদের কাছে এই পথ অত্যন্ত দীর্ঘ, ক্লান্তিকর এবং যেনতেনপ্রকারণে এই পথ পেরিয়ে তাঁরা লক্ষ্যে পৌঁছতে সচেষ্ট। যাত্রাপথের বাধাগুলি তাঁদের কাছে অসহনীয় ও গন্তব্যে পৌঁছনোর ক্ষেত্রে বিঘ্ন সৃষ্টিকারী বলে মনে হয়। এই দু'টি রাস্তার মধ্যে কোনটিকে আমরা বেছে নেব,তা সম্পূর্ণ আমাদের ইচ্ছাধীন। আর কোন রাস্তায় আমরা হাঁটলাম তা বড় কথা নয়। আসলে এখানে গুরুত্বপূর্ণ হল আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং প্রত্যাশা। আচ্ছা, আমরা কি সব সময়ে আশা করতে পারি যে, আমরা নিখুঁত হব? যতক্ষণ না আমরা আমাদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারি, ততক্ষণ আমরা নিজেদের নিখুঁত ভাবতে পারি না। আসলে আমরা ঠিক যেরকম, আমাদের উচিত ঠিক সেইভাবেই নিজেদের গ্রহণ করা। আমাদের উচিত নিজেদের সমস্ত শক্তি, দক্ষতা, বিচক্ষণতা, ইচ্ছাশক্তি দুর্বলতা, সন্দেহ, উদ্বিগ্নতা অর্থাৎ ভালো-মন্দ উভয়কে সমান ভাবে গ্রহণ করা। অভিভাবক হিসেবে আপনি কি নিজেকে নিখুঁত করে গড়ে তুলতে চান? নাকি জীবনের ভুল-ভ্রান্তি এবং দুর্বলতা নিয়ে খুব স্বাভাবিক ভাবেই নিজের গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যাবেন?
বাবা-মা হওয়া বা সন্তানের অভিভাবক হওয়াটা সবার কাছেই একান্ত কাম্য, খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই সময়ে তাঁদের মধ্যে অদ্ভূত মানসিকতার জন্ম হয়। যেমন—কেউ ভাবেন যে, 'আমাকে এখন যেভাবেই হোক নিখুঁত হতে হবে' বা 'এটাই হল সেই ক্ষেত্র যেখানে আমি কোনও ভুল করতে পারি না' কিংবা 'এখানে আমি এমন কোনও কাজ করব না, যার ফলে অন্য কেউ আমাকে আমার অভিভাবকত্ব নিয়ে কোনও প্রশ্ন করতে পারে' অথবা 'এখন থেকে প্রত্যেকে আমাকে আমার পরিচয়ে নয়, বরং আমার সন্তানের পরিচয়ে চিনবে, জানবে, বুঝবে'। এতদ্সত্ত্বেও অনেক সময়ই একজন অভিভাবক তাঁর যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে সফল হন না। আসলে একটি বাচ্চা জন্মানোর পরে তার বাব-মায়ের দায়িত্ববোধ উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া যায় না, তা ভিতর থেকে আসে। বাচ্চার জীবনের ভালো-মন্দ, তার অস্তিত্ব যে তার বাবা-মায়ের দায়িত্ব-কর্তব্যের উপর নির্ভরশীল, তা অভিভাবকদের একান্তভাবে মনে রাখা উচিত। এবং তখনই একজন প্রকৃত অভিভাবক তাঁর সন্তান তাঁকে মনে রাখবে কি না, বা সন্তানের জন্য তিনি যা করছেন তা সঠিক কি না—এই সব নানা অজানা ভয় থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারবেন।
আমার মতে, অভিভাবকত্বের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে একজন মানুষের মধ্যে বিপরীতধর্মী চিন্তাভাবনা এবং পরস্পরবিরোধী অনুভূতিগুলির অবসান প্রয়োজন। এগুলির মধ্যে প্রধান হল—আশা ও ভয়, ভালোবাসা এবং রাগ বা ঘৃণা, আনন্দ ও দুঃখ, আশা এবং নিরাশা, বিশ্বাস ও সন্দেহ, স্বার্থত্যাগী এবং স্বার্থপরতা, স্বনির্ভর বনাম নির্ভরশীলতা, নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে গিয়ে সন্তানের জীবনকে দুর্বিসহ করে তোলা প্রভৃতি।
তাই একজন প্রকৃত অভিভাবক নিঃস্বার্থবাদী না স্বার্থ-সচেতন— এই প্রশ্ন বারেবারে মাথাচাড়া দেয়। প্রথমবার এই প্রশ্ন আমার কানে এলে আমি অভিভাবকদের নিঃস্বার্থবাদী হিসেবেই দেখতে চাইব। কিন্তু এখন পরিবেশ-পরিস্থিতির বিচার করে এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার ক্ষেত্রে একটু বেগ পেতে হবে বইকি!
আমার মনে হয় এত সব অস্পষ্টতার দিকে না গিয়ে অভিভাবকদের উচিত নিজের যথাযথ কাজকে উপভোগ করা। কারণ কোনও মানুষই একদম নিখুঁত বা ভ্রান্ত হয় না। বা এরকম হওয়া উচিৎও নয়। নিজেকে কখনও চরম মনোভাবাপন্ন প্রতিপন্ন করা ঠিক নয়। একজনের উচিত নিজেকে দোষে-গুণে গড়ে তোলা। পরিস্থিতি অনুযায়ী কাজের ঠিক-ভুল, উচিৎ-অনুচিৎ বিচার করা বাঞ্ছনীয়। পরিস্থিতি বদলের সঙ্গে সঙ্গে নিজেকেও সেই মতো করে গড়ে তুলতে হবে। নিঃস্বার্থবাদীতা বা স্বার্থ-সচেতনতার মতো শব্দগুলিও নেহাতই অকিঞ্চিৎকর। বস্তুতপক্ষে আত্মবিশ্বাসী হয়ে অভিভাবকত্ব পালনের মতো গুরুদায়িত্বকে উপভোগ করাটাই প্রকৃত মানুষের মতো কাজ।
মল্লিকা শর্মা বেঙ্গালুরুতে অবস্থিত একজন কাউন্সেলার যিনি নিজের কর্পোরেট চাকরি ছেড়ে মনোরোগ নিয়ে কাজ করছেন। তিনি নিয়মিত বেঙ্গালুরুর রীচ ক্লিনিকে বসেন। আপনাদের কোন বক্তব্য বা জিজ্ঞাস্য থাকলে তাঁকে columns@whiteswanfoundation.org তে লিখে জানাতে পারেন। সমস্ত প্রশ্নের উত্তর এখানে পাক্ষিকভাবে ছাপানো হবে।