কেন আমার বাচ্চারা সবসময়ে নিজেদের মধ্যে লড়াই-ঝগড়া করে?
বাবা-মা বা অভিভাবকরা প্রায়শই দেখেন যে তাদের সন্তানরা একে অপরের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা বা ঝগড়া-বিবাদ করছে। অনেকসময়েই বাচ্চাদের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠা বা তাদের সম্পর্কের মধ্যে পারস্পরিক ভারসাম্য বজায় রাখাটা অসম্ভব বলে মনে হয়। বাচ্চাদের মধ্যে যদি লাগাতার রেষারেষি দেখা যায় তাহলে তার কুপ্রভাব তাদের বন্ধুত্ব ও পারিবারিক পরিবেশের উপরে পড়ে।
ভাইবোন বা সহোদরদের মধ্যে রেষারেষি বলতে কী বোঝায়?
ভাইবোনদের মধ্যে যখন পারস্পরিক প্রতিযোগিতা বা রেষারেষি অথবা হিংসা, ঈর্ষা বা পরশ্রীকাতরতা জন্মায় তখন তাকে সহোদর বা ভাইবোনদের মধ্যে দ্বন্দ্ব বলে মনে করা হয়। এই ঝগড়া-বিবাদ পারস্পরিকভাবে ঘটে বা একজনের থেকে অন্য ভাইবোনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। এর সঙ্গে যুক্ত থাকে মনের হিংসা, ঈর্ষা, বিরক্তি। আর এই থেকেই ভাইবোনদের মধ্যে তর্কাতর্কি ও ঝগড়াঝাটির সূত্রপাত হয়। এটা অনেকসময়ে ভাইবোনদের প্রতি বাবা-মা বা অভিভাবকদের দেওয়া সময় ও মনোযোগ সংক্রান্ত বিষয়ের প্রতিযোগিতায় পরিণত হয়।
ভাইবোনদের মধ্যে তখনই রেষারেষি শুরু হয় যখন তারা নিজেদের প্রতি বাবা-মা বা অভিভাবকদের দেওয়া সময় ও মনোযোগের বিষয়ে সচেতন হয়ে উঠতে আরম্ভ করে। বয়ঃসন্ধির সময়ে যখন বাচ্চাদের মধ্যে নিজের সত্ত্বা বা আত্মপরিচয়ের বিকাশ হতে শুরু করে তখন এই বিষয়টা আরও গভীর ও জটিল হয়ে ওঠে।
রেষারেষি এবং মাঝে-মাঝে হওয়া ঝগড়াঝাটির মধ্যে পার্থক্য কী?
খেলার সময়ে ভাইবোন বা বাচ্চাদের মধ্যে ঝগড়াঝাটি বা মারামারি খুবই সাধারণ একটা ঘটনা। যখন একটা বাড়িতে দু'জন বা তার বেশি বাচ্চা থাকে তখন তারা একসঙ্গে অনেকটা সময় কাটায়, নিজেদের মধ্যে খেলনাপাতি দেওয়া-নেওয়া করে, একসঙ্গে বসে টিভি দেখে এবং সেই সঙ্গে বাবা-মা বা অভিভাবকদের মনোযোগ এবং স্নেহ-ভালোবাসাও পায়। ভাইবোনদের মধ্যে হওয়া ছোটখাটো ঝগড়াঝাটি খুবই স্বাভাবিক ঘটনা এবং সেগুলোর গুরুত্বও তেমন নেই। কিন্তু ভাইবোনদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা বা প্রতিযোগিতা যদি লাগাতার বা ধারাবাহিকভাবে গড়ে ওঠে তাহলে তা যথেষ্ঠ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে বিবেচিত হয়। ভাইবোনের দ্বন্দ্ব শুধু যে একটা পরিবারের বাচ্চাদের পক্ষে ক্ষতিকারক তা-ই নয়, সেই সঙ্গে সমগ্র পারিবারিক পরিমণ্ডল ও পরিবারের ছন্দ বা চলমানতা অথবা গতিশীলতার ক্ষেত্রেও তা বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়ায়।
মানসির যখন সাত বছর বয়স ছিল তখন তার বোনের জন্ম হয়। ভাই বা বোন হবে বলে মানসির মনে খুব আনন্দ হয়েছিল এবং ছোট ভাই বা বোনের সঙ্গে কেমনভাবে সে খেলাধুলো করবে সেকথা সে তার পরিবারের লোকজন ও প্রতিবেশিদের কাছে বলেওছিল। কিন্তু সদ্যোজাত বোন বাড়িতে আসার পর শান্তশিষ্ট স্বভাবের মেয়ে মানসি ক্রমশ বদমেজাজি ও প্রায়শই রাগে ফেটে পড়তে শুরু করেছিল। সে তার বোনকে দেখতে পর্যন্ত চাইত না। মন দিয়ে পড়াশোনা না করা এবং অশিষ্ট আচরণের জন্য স্কুল থেকে তার বিরুদ্ধে ক্রমশ অভিযোগ আসতে শুরু করে। বাধ্য ও মিশুকে মেয়ে বলে স্কুলে তার খুবই সুনাম ছিল। কিন্তু বোন জন্মানোর পর থেকে মানসি স্কুলে গিয়ে অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে ঝগড়া-মারামারি করত। সে তার অভিভাবকদের সঙ্গেও অভদ্র আচার-আচরণ করা শুরু করেছিল। মানসির বাবা-মা তার এই আচরণের বদল ঘটার সঙ্গে তার বোনের জন্ম ও মানসির দিক থেকে তাদের মনোযোগ সরে যাওয়ার বিষয়টি যে যুক্ত সেকথা বুঝতেই পারছিল না।
ভাইবোনদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা বা রেষারেষির লক্ষণগুলো কী?
এর সাধারণ লক্ষণগুলো হল হঠাৎ করে বাচ্চাদের অর্থাৎ ভাইবোনদের মধ্যে, বাচ্চাদের সঙ্গে অভিভাবকদের, তাদের বন্ধুদের বা স্কুলের সঙ্গে তাদের আচরণের পরিবর্তন ঘটা। এই রেষারেষির ফলে বাচ্চাদের লেখাপড়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যেমন- আগের তুলনায় বাচ্চারা পরীক্ষায় কম নম্বর পেতে পারে বা তারা হোমওয়ার্ক করা বন্ধ করে দিতে পারে। আবার ক্লাসের বন্ধুবান্ধবের উপর জোরজবস্তি করে মারামারিও করতে পারে তারা। বাচ্চাদের চেহারা-ছবিতেও উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তন ঘটতে পারে। যেমন- অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য তারা খুব সাজগোজ করতে শুরু করতে পারে বা কখনও কখনও তাদের চেহারায় হীন বা জীর্ণভাব ফুটে ওঠে। এমনকী, নিজেদের পোশাকআশাক বা চেহারা-ছবির যত্নের বিষয়টিকে তারা সম্পূর্ণ অবহেলা বা অগ্রাহ্যও করতে পারে।
কেন ভাইবোনরা একে অপরের সঙ্গে ঝগড়া-মারামারি করে?
যখন বাবা-মায়েরা তাদের সব সন্তানদের প্রতি সমানভাবে মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করে তখনও কিন্তু ভাইবোনদের মধ্যে পারস্পরিক রেষারেষি লক্ষ করা যায়।
গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, জৈবিকভাবে মানুষ সীমিত সম্পদ নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য একে অপরের সঙ্গে লড়াই করে। এমনকী, আজকের দিনে যখন বাচ্চাদের সম্পদকে ঘিরে বেঁচে থাকার প্রশ্নে অন্যদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করার প্রয়োজন নেই তখনও কিন্তু এই প্রবণতা বাচ্চাদের পারস্পরিক লড়াইয়ের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
এক্ষেত্রে অভিভাবকদের কী করণীয় থাকে?
অভিভাবক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ হল বাচ্চাদের চাহিদার প্রতি সংবেদনশীল থাকা এবং তারা কি বলতে চাইছে সেগুলো ভালোভাবে বুঝতে পারা। সবচাইতে গুরুতর যে বিষয়টা ভাইবোনের রেষারেষিকে প্রভাবিত করে সেটা হল বাচ্চাদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখে অভিভাবকরা কীভাবে তার প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে। এই দ্বন্দ্বের মোকাবিলা করার জন্য কয়েকটি উপায় হল-
বড় সন্তানকে প্রস্তুত করা- ভাই বা বোনের জন্মের আগে তার দাদা বা দিদিকে অর্থাৎ বাবা-মায়েদের উচিত তাদের ছোট সন্তানের জন্মের আগে বড় সন্তানকে প্রস্তুত করা। প্রাথমিকভাবে একটা ভাই বা বোনের জন্মের আগে বাচ্চারা খুব অধীর হয়ে যায় এবং আনন্দে করে। কিন্তু ২-৩ দিন যেতে না যেতেই তাদের সেই আনন্দ ক্রমশ মিলিয়ে বা ক্ষীণ হতে শুরু করে এবং বাচ্চাটি উপলব্ধি করতে শুরু করে যে এবার তার প্রতি বাবা-মায়ের ভালোবাসা ও মনোযোগে ভাগ বসাতে আরেকজন বাচ্চা আসছে অর্থাৎ এবার থেকে অভিভাবকদের ভালোবাসা ও মনোযোগের সময় তাদের ভাই বা বোনের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিতে হবে। সেক্ষেত্রে বাবা-মাকে তাদের বড় সন্তানকে জানাতে ও বোঝাতে হবে যে ছোট ভাই বা বোন বাড়িতে আসার পরে পরিস্থিতি আগের থেকে সামান্য বদলে যেতে পারে এবং সদ্যোজাত বাচ্চাটির দেখভালের জন্য বাবা-মাকে যতদূর সম্ভব সময় দিতে হবে। আর এই পরিস্থিতির জন্যই বড় সন্তানকে আগে থেকে প্রস্তুত করে নেওয়া জরুরি।
লিঙ্গ বৈষম্য এড়িয়ে চলা- যখন বাচ্চারা বিপরীত লিঙ্গের হবে তখন অভিভাবক বা বাবা-মাকে কোনও একটা লিঙ্গের প্রতি কোনওরকম পক্ষপাতিত্ব না রেখে যাতে স্বচ্ছ সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় তার চেষ্টা করতে হবে। সেই সঙ্গে সজাগ থাকতে হবে যে তাদের নেওয়া সিদ্ধান্ত বাচ্চাদের মধ্যে কোনও একজনের পক্ষে যেন অন্যায্য বা অন্যায়জনক না হয়। কোনও বাবা-মায়ের যদি ছেলে ছোট ও মেয়ে বড় হয় তাহলে তাদের অনেক বেশি করে এই বিষয়টিকে মাথায় রাখতে হবে। সমাজে বাবা-মা বা অভিভাবকরা মনে করে যে বেশি রাত পর্যন্ত ছেলেদের বাইরে থাকাটা মোটেই বিপজ্জনক বা ঝুঁকিপূর্ণ নয়। তাই বাবা-মায়েরা ছেলেদের অনেক বেশি স্বাধীনতা দেয়। সেক্ষেত্রে বাবা-মায়ের এই সিদ্ধান্তের ফলে তাদের বড় মেয়ে অর্থাৎ বাচ্চা ছেলেটির দিদির মনে একটা ক্ষোভ বা বিদ্বেষ জন্মাতে পারে এবং তার কাছে এই বার্তাই পৌঁছয় যে বাবা-মা আর চাইতে তার ছোট ভাইকেই বেশি বিশ্বাস করে।
বাচ্চাদের নিজেদের ঝগড়া তাদের নিজেদেরকেই মিটিয়ে নিতে দিন- বাচ্চাদের প্রতিটি ঝগড়াঝাটির মধ্যে বাবা-মায়ের হস্তক্ষেপ করার কোনও প্রয়োজন নেই। সঠিক উপায়ে বাচ্চাদের নিজেদের সমস্যা নিজেদেরকেই মীমাংসা করতে দেওয়া জরুরি। অন্যদিকে, যদি একজন বাচ্চা অন্য একটি বাচ্চার থেকে বেশি শক্তিশালী ও আকার-আয়তনে বড় বা বিরাট হয় তাহলে সবসময়ে লড়াইয়ে সেই জেতে। এর ফলে সবল বাচ্চারা দুর্বল বাচ্চাকে নিজেদের সর্বশক্তি দিয়ে মারধর করে এবং তাদের মধ্যে আরও বেশি করে রেষারেষি শুরু হয়। তাই সাধারণভাবে বাচ্চাদের মধ্যে যদি এইধরনের আচরণ লক্ষ করা যায় তাহলেই সেখানে অভিভাবকদের হস্তক্ষেপ করা উচিত এবং তাদের শেখানো উচিত যে মারামারি না করে আলোচনার মধ্য দিয়ে কীভাবে ঝগড়াঝাটির মীমাংসা করা যায়।