আপনার সন্তানের যদি কাউন্সেলিং প্রয়োজন হয়
ভারতে এক দশক আগেও বাচ্চাদের বা বয়ঃসন্ধির ছেলে-মেয়েদের কাউন্সেলিং করানোর কথা বলা হলে তাদের অভিভাবক উদ্বিগ্ন হয়ে পড়তেন এবং বিব্রত বোধ করতেন। ইদানীংকালে থেরাপিস্টদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করাকে স্বাভাবিক বলে গন্য করা হলেও, অধিকাংশ অভিভাবক বুঝতে পারেন না যে এর মানে কী এবং এই পরিস্থিতিতে কী করা উচিত।
অভিভাবক, শিক্ষক এবং গুরুজন হিসেবে আমরা অনুভব করি যে আমাদের সামাজিক এবং পারিবারিক পরিবেশ ক্রমশ আমাদের সন্তানদের কাছে জটিল ও চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠছে। এবং সেই কারণে আমাদের বাচ্চাদের সুরক্ষা ও সঠিক পথে চালনা করা জরুরি। সেই সঙ্গে তাদের চাই অনুসন্ধান বা বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা ও স্বাধীনতা। তাদের শক্তি বা ক্ষমতাকে কেড়ে না নিয়ে কীভাবে আমরা তাদের পাশে দাঁড়াতে পারি? কীভাবে আমরা তাদের উৎসাহ দিতে পারি? কীভাবে তাদের মনের ভয়গুলোকে তারা গুরুত্ব দিয়ে বিচার করবে সেই শিক্ষা দিতে পারি? কীভাবে তাদের মধ্যে সমানুভূতি এবং সংবেদনশীলতার বোধ জাগিয়ে তুলে তাদেরকে নেতৃত্বদান করতে ও উদ্যোগী হয়ে উঠতে সমর্থন করতে পারি? কীভাবে আমরা তাদের এই পৃথিবীর নানারকম বাধা-বিঘ্ন, অস্পষ্টতা, সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও নিজেকে প্রকাশ করতে এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে সাহায্য করতে পারি?
আমাদের বেশ কয়েকটি চাহিদার মধ্যেকার দ্বন্দ্ব নিয়ন্ত্রণ করতে না পারার জন্য অভিভাবক ও সন্তান- দুজনেই হতবুদ্ধিসম্পন্ন ও হতাশ হয়ে পড়ে। এর ফলে দু'পক্ষের আচরণেই অকেজো ভাবভঙ্গীর মাত্রা বেড়ে যায়, যা অভিভাবক এবং তাদের সন্তানদের রাগি, অধীর করে তোলে ও তারা ক্লান্ত এবং বিষণ্ণ হয়ে পড়ে।
এই অবস্থায় কাউন্সেলিং-ই দু'পক্ষকে নিরাপত্তা দিতে পারে, তারা মানসিক দিক থেকে শান্ত হতে পারে, প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারে। এছাড়া তারা এমন একটি পথ বেছে নিতে পারে যা তাদের দু'জনের জীবনের গতি-প্রকৃতিকে পুনরায় গঠন করতে সাহায্য করতে পারে এবং সেদিকে তারা একসঙ্গে এগিয়ে যেতে পারে।
নীচে এমন কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া হল যেখানে একটি নতুন একক পরিবার কীভাবে আধুনিক জীবনযাত্রার ওঠা-পড়া সত্ত্বেও নিজেদেরকে সঠিক পথে চালিত করছে তা দেখানো হয়েছে-
ছ'বছরের শান্তিকে কাউন্সেলিং করানোর জন্য সুপারিশ করা হয়েছিল কারণ তার মা তাকে নিয়ে সবসময়ে খুব দুশ্চিন্তা করতেন। শান্তির মা তার মেয়েকে অন্যান্য দাদা-দিদিদের সঙ্গে যৌনধর্মী কিছু ভিডিও দেখতে দেখে ফেলেছিলেন। তিনি তার মেয়ের আচার-আচরণ নিয়ে খুব বেশি মাত্রায় অধীর হয়ে থাকতেন। এভাবে মাস দু'য়েক কাটার পর তিনি ভীষণ ভয় পেতে শুরু করেন এবং মেয়ের স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেন। বাড়িতে মা তার মেয়ের সঙ্গে একেবারে আঠার মতো সেঁটে থাকেন। তাদের অধিকাংশ কথাবার্তাই শেষ হত সেই যৌনধর্মী ভিডিও দেখার প্রসঙ্গ দিয়ে। এর ফলে মায়ের মনে অপরাধ বোধ এবং মেয়েকে নিয়ে চিন্তা সারাক্ষণ ঘুরপাক খেত। অন্যদিকে, শান্তির মনে হত যে সে খুব 'খারাপ মেয়ে।'
কাউন্সেলিং-এর প্রথম পর্যায়ে শুধুমাত্র শান্তির অভিভাবকরা কাউন্সেলরের কাছে এসে তার সম্পর্কে নানারকম তথ্য এবং মেয়ের জীবনের ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করেন। এছাড়া শান্তির সদ্যোজাত বোন বাড়িতে আসার পরবর্তী সময়ে ঘটা কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তাঁরা তুলে ধরেন, এমনকী দু'টি সন্তানের জীবনের সঙ্গে বাবা- মায়ের ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকার কথাও এই পর্বে আলোচনা করা হয়। কাউন্সেলর হিসেবে আমরা একটা কথা জানি যে ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের কাউন্সেলিং চলাকালীন তাদের অভিভাবক বা বাবা-মায়েরা যদি সরাসরি থেরাপির প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত থাকেন তখন তার ফলাফল ইতিবাচক হওয়ার সম্ভাবনা সহজ থেকে সহজতর হয়। এর ফলে গোপনীয়তাও যেমন বজায় রাখা যায়, তেমন কীভাবে রুগির চিকিৎসা করা হচ্ছে তা তার বাড়ির লোকদের কাছেও স্পষ্ট হয়ে যায়। এক্ষেত্রে যেমন শান্তিই ছিল প্রাথমিক রুগি এবং সে যা কিছু বলত তা তার বাবা-মায়ের সঙ্গে আলোচনা করার সুযোগ পেতেন কাউন্সেলররা। তাই শুধুমাত্র যে বিষয়গুলো সরাসরি শান্তির শারীরিক এবং মানসিক নিরাপত্তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল সেগুলোই মূলত চিন্তার বিষয় হয়ে উঠত।
শান্তিকে সপ্তাহে একবার ৩০-৪৫ মিনিটের জন্য কাউন্সেলিং করানোর জন্য নিয়ে যাওয়া হত। প্লে থেরাপি এবং অন্যান্য প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কাউন্সেলিং করা হত। কাউন্সেলিং-এর ফলে বোনের জন্মের পর শান্তির প্রতি তার মায়ের মনোযোগের অভাব ও সময় না দেওয়ার জন্য যে সমস্যা দেখা দিয়েছিল তার মোকাবিলা করার চেষ্টা করতে শুরু করেছিল শান্তি। সেই সঙ্গে সদ্যোজাত বোনের প্রতি তার মনের হিংসা ও ভালোবাসা- এই দুই বোধের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব চলত, তাকেও নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা দেখা গিয়েছিল শান্তির মধ্যে। এছাড়া যৌনধর্মী ভিডিও দেখার ফলে শান্তি যে নিজেকে 'খারাপ মেয়ে' বলে মনে করত, সেক্ষেত্রেও সে তার ভাবনার বদল ঘটতে শুরু করেছিল। এভাবে শান্তির পক্ষে এই বদলগুলো কতটা সাহায্যদায়ক হচ্ছে, তা ভালোভাবে বোঝার জন্য তার বাবা-মায়ের সঙ্গে আরও একবার আরেকটা কাউন্সেলিং পর্বের ব্যবস্থা করেছিলেন কাউন্সেলর।
কাউন্সেলরের পর্যবেক্ষণ ও পরামর্শ শোনার পরে শান্তির বাবা-মা তাদের দৈনন্দিন রুটিন এবং কথপোকথনের ক্ষেত্রে কিছু রদবদল করার জন্য রাজি হয়ে যান। এইসময় শান্তির বাবা ছোট বোনের সঙ্গে অনেক বেশি করে সময় কাটাতে শুরু করেন (তখন মা সেখানে মোটেই থাকতেন না) এবং মা শুধুমাত্র হোমওয়ার্ক বা পড়াশোনা দেখানোর জন্য শান্তির সঙ্গে বেশি সময় না কাটিয়ে তার সঙ্গে নানারকম খেলাধুলো করে সময় কাটাতে থাকেন। এভাবে কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই শান্তির আচরণের ক্ষেত্রে চোখে পড়ার মতো পরিবর্তন দেখা যায়।
আপাতদৃষ্টিতে এটি সাধারণ বোধ জেগে ওঠার ঘটনা মনে হলেও পরিবারের প্রতিটি সদস্যদের প্রয়োজন-অপ্রয়োজনের বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা করা এবং তাদের মনের অনুভূতিগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে শোনার জায়গায় তৈরি করে দেওয়ার ফলে তাদের আচরণে নানারকম ইতিবাচক পরিবর্তন আনা সম্ভব হয়েছিল।
বাচ্চাদের সঙ্গে কাজ করার সময় তাদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে চলার উপকারিতা আমরা এই উদাহরণ থেকে বুঝতে পারি। তবে বয়ঃসন্ধিকালের ছেলে-মেয়েদের ক্ষেত্রে এই সমস্যার সমাধানের জন্য কিছুটা ভিন্ন পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়।
১৫ বছরের অভিষেক যখন কাউন্সেলিং-এর জন্য এসেছিল তখন আমি প্রথমে তার সঙ্গে দেখা করেছিলাম এবং তার প্রয়োজনীয়তা ও সমস্যাটি বোঝার চেষ্টা করেছিলাম। টিনেজার অভিষেক বিকাশগত দিক থেকে এমন একটি জায়গায় ছিল যেখানে তার ব্যক্তিসত্ত্বাকে আলোচনার মাধ্যমে স্বীকার করলে ইতিবাচক উত্তর পাওয়া সম্ভব ছিল। এর পরে তার বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা করে ছেলের সম্পর্কে তাঁদের মতামত ও চিন্তার কথা জেনেছিলাম। এক্ষেত্রে গোপনীয়তা রক্ষার দিকটিকে বিশেষভাবে জোর দেওয়ার হয়েছিল। এবং অভিষেককে তার সম্মান বজায় রাখার বিষয়টি নিয়ে আশ্বস্ত করা হয়েছিল।
অভিষেকের ক্ষেত্রে তার বাবা-মায়ের মনে ছেলের পরীক্ষার নম্বর কমে যাওয়া, পড়াশোনায় মনোযোগের অভাব ও স্কুল যেতে না চাওয়ার জন্য দুশ্চিন্তা দেখা দিয়েছিল। মানসিক দিক থেকে অভিষেক একেবারে ভেঙে পড়েছিল, কারণ তার জীবনের প্রথম প্রেমের সম্পর্কটি ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। এমন একটি জায়গা পেয়ে - যেখানে ও নিজের মনের নতুন এবং কোমল অনুভূতিগুলোর কথা নির্দ্বিধায় আলোচনা করতে পারছে, এবং একই সাথে নিজের ভেতর জমে থাকা রাগ এবং হতাশা প্রকাশ করতে পারছে – ক্রমশ ওকে এমন একটা জায়গায় নিয়ে গিয়েছিল যেখানে সমস্যা সমাধানের উপায় খুঁজে বার করার পন্থা নিয়ে কাজ করা সম্ভব হয়েছিল। একইসাথে যোগাযোগের দক্ষতা, মনকে নিয়ন্ত্রণ করা এবং নিজেকে আরাম দেওয়ার কৌশল তাকে শেখানো সম্ভব হয়েছিল।
এক্ষেত্রে ক্লায়েন্ট বয়ঃসন্ধিকালের হওয়ার কারণে তার বাবা-মাকে থেরাপির প্রক্রিয়ায় যথাসম্ভব কম জড়িয়ে অভিষেকের সঙ্গে সরাসরি আলোচনা করার ফলে তার নিজেকে অনেক বেশি আত্মনির্ভরশীল ও স্বাবলম্বী মনে হয়েছিল। এগুলো বয়ঃসন্ধিকালীন ছেলে-মেয়েদের ক্ষেত্রে বিকাশগতভাবে সঠিক লক্ষ্য হিসেবে বিবেচিত হয়।
আজকের পৃথিবীতে আমাদের জীবনযাত্রা সব দিকে থেকেই দ্রুত গতিতে বদলে যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে কাউন্সেলিং-এর সময় কোনওরকম মতামত না দেওয়া এবং প্রতিকূল পরিস্থিতিকে সাদরে গ্রহণ করাই কাউন্সেলিং প্রক্রিয়ার প্রকৃত উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। এবং এই ধরনের কাউন্সেলিং-ই অভিভাবক ও তাদের সন্তানদের কাছে অমূল্য বলে গন্য হয়। তাই কোনও বাবা-মা যখন এমন বিপদের মুখোমুখি দাঁড়ায়, তখন নিজের পারিবারিক পরিবেশকে সুরক্ষিত রাখার জন্য প্রত্যেক বাবা-মায়ের উচিত কোনওরকম দ্বিধা না করে এই অমূল্য সম্পদকে যথাযথভাবে ব্যবহার করা।
(এই প্রবন্ধটির মুখ্য বিষয় তুলে ধরার জন্য কয়েকটি চরিত্রকে উদাহরণ হিসেবে আলোচনা করা হয়েছে এবং এই চরিত্রগুলোর সঙ্গে প্রকৃত রুগিদের কোনও মিল নেই।)
মঞ্জু সাপ্রু ব্যাঙ্গালোরের 'পরিবর্তন' কাউন্সেলিং, ট্রেনিং এবং রিসার্চ সেন্টারের কাউন্সেলর।