বয়স্কদের মধ্যে কেন ঘুমের সমস্যা দেখা দেয়?
বয়স্ক মানুষের ক্ষেত্রে ঘুমের সমস্যা দেখা দেওয়া কোনও অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। প্রকৃতপক্ষে ৬০ বছর বয়স্ক অধিকাংশ মানুষের মধ্যে কম-বেশি ঘুমের সমস্যা লেগেই থাকে। এই সমস্যাকে যদিও বয়স্ক মানুষের জীবনে একপ্রকার প্রাকৃতিক নিয়ম হিসেবে মনে করা হয়, তবু পর্যাপ্ত ও পরিমাণগত ঘুমের অভাব তাদের মানসিক স্বাস্থ্য ও সুস্থতার ক্ষেত্রে একটা গুরুতর বিষয় বলে বিবেচিত হয়ে থাকে। তাই একজন মানুষের সুস্থ থাকার ক্ষেত্রে ঘুমের ভূমিকা আসলে কী তা ভালোভাবে বোঝা দরকার। তাই ঘুম বলতে কী বোঝায় তা দিয়েই এই আলোচনা শুরু করা যাক।
ঘুম বলতে কী বোঝায়?
ঘুম হল আমাদের আচরণগত ও শারীরবৃত্তীয় একধরনের প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে আমাদের শরীরের ভিতরে অবস্থিত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সঠিক কার্যকলাপ সম্ভব হয়। কারণ এগুলোর সঙ্গে পারিপার্শ্বিক পরিবেশের সক্রিয় যোগাযোগ থাকে না। ঘুমের সময়ে আমাদের শরীরে প্রোটিনের সমন্বয় ঘটে, টক্সিন উৎপন্ন বন্ধ হয়। ঘুম থেকে ওঠার সময়ে নিউরোট্রান্সমিটারের সমন্বয়ের ফলে নিউরালের ক্রিয়াকলাপ ও মেরামতির প্রক্রিয়া গড়ে ওঠে। পর্যাপ্ত ও পরিমাণগত ঘুম আমাদের জেগে থাকা অবস্থায় পারিপার্শ্বিক পরিবেশের সঙ্গে লাগাতার ও শক্তিশালী যোগাযোগ স্থাপনের ক্ষেত্রে গুরুতর ভূমিকা নেয়।
সতেজ থাকা ও পরের দিনে সক্রিয়ভাবে কাজ করার ক্ষমতা অর্জনের জন্য একজন মানুষের গড়ে দিনে ৬ থেকে ৮ ঘণ্টা ঘুম জরুরি। যেখানে ঘুমের এই সময়টা অধিকাংশ পূর্ণবয়স্ক মানুষের ক্ষেত্রে মেনে চলা একান্ত জরুরি সেখানে মানুষের জীবনযাত্রার কারণে ঘুমের পরিমাণগত ও গুণগত মান দুটোই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আর বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘুম-সংক্রান্ত সমস্যা দেখা দিতে শুরু করে।
বয়স হলে ঘুমের ক্ষেত্রে কী ঘটনা ঘটে?
আমাদের অন্যান্য শারীরবৃত্তীয় কাজকর্মের মতো ঘুমের গুণগত ও পরিমাণগত মান বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দুর্বল হতে শুরু করে। যদি আমরা ঘুমের বিজ্ঞানকে বুঝতে চাই তাহলে জানা জরুরি যে আমাদের ঘুম আসলে দু'ধরনের হয়ে থাকে-
প্রথম প্রকার হল আরইএম (র্যাপিড আই মুভমেন্ট) এবং দ্বিতীয় প্রকার হল এনআরইএম (নন-র্যাপিড আই মুভমেন্ট) ঘুম। এনআরইএম হল সেই বলবৃদ্ধিকারক পর্যায় যখন আমাদের শরীরের নানারকম অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মেরামতি ঘটতে থাকে। এর সঙ্গে বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় কার্যকলাপও যুক্ত থাকে, যেমন- হরমোন উৎপন্ন এবং নিঃসরণ বা ক্ষরণ।
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রথমে মানুষের এনআরইএম ঘুমের ধরনেই পরিবর্তন আসে, বিশেষত পুরুষের ক্ষেত্রে এমনটা ঘটে। এই প্রসঙ্গে নিমহানস্-এর নিউরোফিজিওলজি বিভাগের অধ্যাপক ডাক্তার বিন্দু কুট্টি বলেছেন, ''বিশেষ করে ৬০ বছর বয়স্ক পুরুষদের ক্ষেত্রে এনআরইএম ধরনের ঘুম, যা মোট ঘুমের ১৫ শতাংশ জুড়ে থাকে, সেই ঘুমের পরিমাণ ৩ থেকে ৪ শতাংশ কমে যায়। মহিলাদের শরীরে ইস্ট্রোজেন নামক হরমোনের মাত্রা বেশি থাকার জন্য ঘুমের প্রক্রিয়া আস্তে আস্তে কমতে থাকে।''
এনআরইএম ঘুমকে বলা হয় ধীর ঢেউ খেলানো বা গভীর ঘুম, যা বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাৎপর্যপূর্ণভাবে কমে যায়। এর প্রভাব একনাগাড়ে মানুষের ঘুমের ক্ষমতার উপর পড়ে। এই পর্যায়ের সঙ্গে আমাদের স্মৃতিশক্তিও জড়িত থাকে এবং কম পরিমাণ এনআরইএম ধরনের ঘুমের প্রভাব মানুষের স্মৃতিশক্তির উপরেও পড়ে। বয়স বাড়লে পর্যায়ক্রমিক হারে মানুষের শরীরে সর্বাঙ্গীণ পরিবর্তন দেখা দেয়। সেই সঙ্গে ঘুমের জন্য ব্যয় করা মোট সময় কমে যায় ও ঘুমাতে ঘুমাতে মাঝে মাঝেই ঘুম ভেঙে যায়। বয়সজনিত হরমোনের ক্রিয়াকলাপের বদল, বিশেষ করে বৃদ্ধি সহায়ক হরমোন, মেলাটোনিন এবং কর্টিসলের পরিবর্তন আমাদের ঘুমের গুণগত মান এবং তার কার্যকলাপের উপর ক্ষতিকারক প্রভাব ফেলে।
আট ঘণ্টা ঘুমের মধ্যে দু'ঘণ্টা ঘুম আরইএম (র্যাপিড আই মুভমেন্ট) ধরনের হয়। এইধরনের ঘুম মানুষের ৭০ বছর বয়স পর্যন্ত তেমনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। ৭০ বছরের পরে অধিকাংশ মানুষের মধ্যে আরইএম ধরনের ঘুমেরও ভগ্নদশা শুরু হতে থাকে।
ঘুমের ঝঞ্ঝাট কীভাবে মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যা ডেকে আনে?
ডাক্তার বিন্দু কুট্টির মতে, ''বয়স্ক মানুষের মধ্যে প্রায় ১৫ শতাংশ মানুষ ইনসমনিয়ার শিকার হয়''। তিনি তাঁর এই বক্তব্যের ব্যাখ্যা করে জানান যে ইনসমনিয়া বা নিদ্রাহীনতার মধ্যে ঘুমানোর উদ্যোগ এবং ঘুম বজায় রাখা দু'ধরনের সমস্যাই থাকে। সাধারণভাবে বিছানায় শোওয়ার পরে একজন মানুষের ঘুম আসতে ১৫ মিনিট মতো সময় লাগে। কিন্তু ইনসমনিয়ায় আক্রান্ত মানুষের ক্ষেত্রে দীর্ঘ সময় কেটে গেলেও ঘুম আসতে চায় না। এর ফলে মানুষের ঘন ঘন মেজাজ-মর্জির বদল ঘটে, আর যার প্রভাব মানুষের পরিবারের বিভিন্ন সদস্যের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর পড়ে।
প্রায়শই ইনসমনিয়ার রুগিরা তাদের অনিদ্রাজনিত সমস্যার কারণে খুবই চিন্তিত হয় পড়ে। তার ফলে তাদের অবস্থার ক্রমশ অবনতি ঘটতে থাকে। লাগাতার ইনসমনিয়ার ফলে মানুষের মধ্যে মানসিক অবসাদ, চিন্তা, উদ্বেগ, ভয় এবং মেজাজ খারাপের মতো সমস্যা দেখা দেয়।
এক্ষেত্রে মনে রাখার মতো বিষয় হল ঘুমের সমস্যা অল্পবয়সিদের মধ্যেও ক্ষতি ডেকে আনতে পারে। কারণ তাদের জীবনযাত্রায় তারা ৭দিন, ২৪ ঘণ্টাই একনাগাড়ে সক্রিয় থাকে। নন-কমিউনিকেবল অসুখ, যা লাগাতার বাড়ে, তাও ঘুমের সমস্যাকে তরান্বিত করতে পারে। প্রকৃতপক্ষে পৃথিবীর জনসংখ্যার ১০ থেকে ৩০ শতাংশ মানুষের মধ্যে পর্যাপ্ত ঘুম না হওয়ার সমস্যা দেখা দেয়।
এই সমস্যার সমাধান কী?
যখন বয়স্কদের মধ্যে ঘুম না হওয়ার সমস্যা দেখা দেয় এবং যার পিছনে থাকে জৈবিক কারণ সেখানে কয়েকটি ব্যবস্থা অবলম্বন করলে ঘুমের গুণগত মান বৃদ্ধি পাওয়া সম্ভব হয়।
শরীরচর্চা এবং যোগ ব্যায়াম- বয়সকালে কর্টিসল হরমোনের মাত্রা বৃদ্ধি এবং মেলাটোনিন হরমোনের মাত্রা কমে যাওয়া নিয়ন্ত্রণ করতে যোগব্যায়াম, শরীরচর্চা এবং ধ্যান করা একান্তই জরুরি। ধ্যান মানুষের ঘুমের গুণগত মান বাড়াতে সহায়তা করে ও সেই সঙ্গে ঘুম নামক শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ার সুরক্ষায় সাহায্য করে।
স্বাস্থ্যকর ঘুম-
মানুষের উচিত সাধারণভাবে রাতের বেলায় ঘুমানো এবং দিনের বেলায় জেগে থাকা।
দিনেরবেলায় ঘুম বা ঝিমনো এড়িয়ে রাতেরবেলায় পর্যাপ্ত ঘুমানো একান্ত জরুরি। নিজের মস্তিষ্কের বোধগম্যতার সাহায্যে মানুষের বোঝা জরুরি যে বিছানা রাতের ঘুমের জন্যই একান্ত অত্যাবশ্যক একটি বিষয়। তাই আমাদের উচিত শোওয়ার ঘর থেকে সবরকম যন্ত্রপাতি সরিয়ে রাখা। ঘুমানোর সময় এবং ঘুম থেকে ওঠার সময় নির্দিষ্ট থাকলে তা মানুষের প্রাত্যহিক কাজকর্মকে যথাযথভাবে করতে সাহায্য করে।
বিকেলের দিকে অ্যালকোহল এবং উদ্দীপক জাতীয় পানীয় এড়িয়ে চলা দরকার। কারণ এগুলো ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়।
বিকেলের দিক থেকে নিজেকে অস্থিরতার বাইরে ধীর-স্থির রাখার চেষ্টা করা জরুরি এবং দিনের শেষে নিজেকে শান্ত করার শিক্ষা গ্রহণ করা একান্ত আবশ্যক।
এই প্রবন্ধটি লেখার জন্য নিমহ্যান্সের নিউরোফিজিওলজি বিভাগের অধ্যাপক ডঃ বিন্দু কুট্টির সাহায্য নেওয়া হয়েছে।