বয়স্কদের যোগব্যায়াম অনুশীলন
বার্ধক্য একজন মানুষের জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং অবশ্যম্ভাবী পর্যায়। বার্ধক্যের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে নানারকম অসুখ এবং চিকিৎসা সংক্রান্ত বিষয়। এর মূলে থাকে প্রধানত মানুষের মানসিক সমস্যা এবং শারীরিক রোগ প্রতিরোধ করার অভাব। অল্পবয়সে অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন এবং অন্যান্য কারণের জন্য একজন মানুষের বৃদ্ধ বয়সে লাগাতার শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে, যেমন- কার্ডিওভাস্কুলার সমস্যা, টাইপ টু ডায়াবেটিস মেলিটাস (টিটুডিএম),ক্যান্সার বা কর্কট রোগ, ওবেসিটি বা স্থূলতা এবং আর্থারাইটিস বা বাতের সমস্যা প্রভৃতি দেখা দিতে পারে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় নানারকম মনোরোগ, যেমন- অবসাদ এবং ডিমেনশিয়া, অন্যান্য শারীরিক জটিলতা, যেমন- ব্যথা-বেদনা, ক্লান্ত বোধ করা, হাঁটাচলা করার সীমাবদ্ধতা ও ঘুমের সমস্যা প্রভৃতি একজন বয়স্ক মানুষের সর্বাঙ্গীন জীবনযাপনের অবনতি ঘটাতে পারে।
বৃদ্ধাশ্রমগুলোকে নিয়ে করা নিমহান্স-এর এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, ছ'মাসের যোগব্যায়াম অনুশীলনের ফলে একজন বয়স্ক মানুষের শারীরিক এবং মানসিক অবস্থার অবনতির বদলে উন্নতিই বেশি হয় এবং যোগচর্চার ভূমিকা একজন বেশি বয়সের মানুষের জীবনে খুবই কার্যকরী হয়ে ওঠে। বয়স্ক মানুষদের উপর যোগব্যায়াম অনুশীলনের সুফলগুলো হল-
সর্বাঙ্গীন জীবনযাপনে যোগব্যায়ামের কার্যকারিতা
যোগব্যায়াম অনুশীলনের মাধ্যমে স্বাস্থ্যকর বার্ধক্যের অধিকারী হওয়া যায়। একজন বয়স্ক মানুষের সর্বাঙ্গীন সুস্থতা এবং জীবনযাপনের মানোন্নয়ন তথা তার হাঁটাচলার শক্তি, শারীরিক ভারসাম্যতা, নমনীয়তা এবং মেজাজ-মর্জির উন্নতি ঘটাতে যোগব্যায়ামের অবদান অনস্বীকার্য। নিয়মিত যোগচর্চার ফলে বৃদ্ধ মানুষের গুরুতর মানসিক এবং শারীরিক সমস্যার সমাধান ও নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয়।
যোগব্যায়াম মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতিতে সাহায্য করে
অবসাদ- বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মত অনুযায়ী, ২০২০ সালের মধ্যে মানসিক অবসাদ দ্বিতীয় সর্বব্যাপক অসুখ হিসেবে দেখা দেবে। বার্ধক্যে যে অবসাদ দেখা দেয় তা সঠিকভাবে নির্ধারণ করা খুবই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। কারণ বার্ধক্যের লক্ষণগুলোর সঙ্গে অবসাদের লক্ষণগুলো মিলেমিশে যায়। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, বয়স্ক মানুষদের মধ্যে শতকরা ১৬.৫ শতাংশের ক্ষেত্রে মানসিক অবসাদের ঝুঁকি প্রবল। পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের মধ্যেই অবসাদের প্রবণতা বেশি থাকে। অবসাদগ্রস্ত মানুষের শরীরে স্ট্রেস হরমোন কর্টিসল-এর মাত্রা বেড়ে যায়। এই হরমোনের মাত্রা কমানোর জন্য একজন অবসাদগ্রস্ত বয়স্ক মানুষ যদি তিনমাস যোগব্যায়াম সঠিকভাবে অনুশীলন করতে পারে তাহলে তার সুফল মেলা সম্ভব। অবসাদগ্রস্ত মহিলারা যেমন শরীরচর্চার মাধ্যমে অবসাদ দূর করতে সচেষ্ট হয়, ঠিক তেমনভাবেই যোগ থেরাপি অবসাদের সঙ্গে সঙ্গে উদ্বেগ দূর করতে ও জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন করতেও সাহায্য করে।
বার্ধক্য সময়কালীন জীবনযাপনের ক্ষেত্রে যোগব্যায়াম নানাভাবে সুফল দেয়। আমাদের মস্তিষ্ক থেকে নিউরো-প্রোটেক্টিভ রাসায়নিক পদার্থ হিসেবে যে নিউরো ট্রপিক ফ্যাক্টর (বিডিএনএফ) নির্গত হয়, যা আমাদের মস্তিষ্কের হিপ্পোক্যাম্পাস অঞ্চলে সক্রিয় থাকে, সেই বিডিএনএফ-এর মাত্রা একজন অবসাদগ্রস্ত মানুষের ক্ষেত্রে অনেক কম পরিমাণে নির্গত হয়ে থাকে। গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, একজন অবসাদগ্রস্ত মানুষের ক্ষেত্রে তিনমাস যোগাসন ও প্রাণায়াম অনুশীলনের দ্বারা এই বিডিএনএফ-এর মাত্রা বৃদ্ধি করা সম্ভবপর হয়। বৃদ্ধ বয়সে মানুষের চেতনাগত ও বৌদ্ধিক দুর্বলতা দূর করার জন্য যোগচর্চা এবং মেডিটেশন অত্যন্ত উপকারী মাধ্যম। সেই সঙ্গে এর সাহায্যে বয়স্কদের স্মৃতিশক্তির দুর্বলতাও হ্রাস করা সম্ভবপর হয়।
শারীরিক সুস্থতায় যোগচর্চার ভূমিকা
অন্যান্য দেশের মতো ভারতেও টাইপ টু ডায়াবেটিস মেলিটাস (টিটুডিএম) এবং কার্ডিওভাস্কুলার সমস্যা ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। এই সমস্যা এড়ানোর জন্য হাঁটাহাঁটির তুলনায় বয়স্করা যদি আট সপ্তাহ যোগব্যায়াম অনুশীলন করে তাহলে তারা শারীরিক ওজন এবং কোমরের বেড় বা পরিধি কমার ক্ষেত্রে বড়সড় সুফল পাবে। অন্যদিকে, যোগচর্চার ফলে টাইপ টু ডায়াবেটিস মেলিটাস (টিটুডিএম)-এর মতো অসুখের ঝুঁকির মাত্রাও কম হতে পারে। আর সেই সঙ্গে মানুষের মানসিক ক্ষেত্রেরও উন্নতি ঘটার সম্ভাবনা দেখা দেওয়া স্বাভাবিক।
বয়স্কদের ক্ষেত্রে, বিশেষত বয়স্ক মহিলাদের অক্ষমতার একটা অন্যতম কারণ হল আর্থারাইটিস বা বাতের সমস্যায় আক্রান্ত হওয়া। এক্ষেত্রে যদি কয়েক বছর ধরে নিয়মিত যোগব্যায়াম অনুশীলন করা যায় তাহলে বাতের ব্যথা কমা, অতিরিক্ত শক্তি পাওয়া এবং অনিদ্রাজনিত সমস্যার উন্নতি সহজসাধ্য হয়ে দাঁড়ায়। এ থেকেই বোঝা যায় যে নিয়মিত যোগব্যায়াম অনুশীলন আর্থারাইটিস নিয়ন্ত্রণ করতে কার্যকরী ভূমিকা নেয়।
চল্লিশ বছর বা তার বেশি বয়সের মহিলাদের অক্ষমতার একটা বড় কারণ হল মূত্রের বেগ ধরে রাখার সমস্যা বা মূত্রথলির নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলা। চল্লিশ বছরের আশপাশে থাকা মহিলাদের প্রায় এক-তৃতীয়াংশের মধ্যে এই সমস্যা দেখা যায়। এই সমস্যা দূর করার জন্য ছ'সপ্তাহ ধরে যোগব্যায়াম অনুশীলনের মধ্য দিয়ে কার্যকরী ফলাফল মেলে।
যোগব্যায়াম অনুশীলনের আগে কয়েকটি বিষয় মনে রাখা জরুরি-
১. যদি কারোর শরীরের কোন অংশে কাটাছেঁড়া বা অপারেশন হয় তাহলে ছ'মাস পর্যন্ত যে কোনওরকম শারীরিক কসরত এড়িয়ে চলা উচিত। এইসময়ে তারা কোনও একজন যোগগুরুর তত্ত্বাবধানে অল্পস্বল্প প্রাণায়াম এবং সুকশ্মা ভায়ায়ামা নামক হালকা যোগব্যায়াম করতে পারে।
২. যাদের হাইপারটেনশন বা উচ্চরক্তচাপের সমস্যা রয়েছে তাদের দ্রুতহারে আসানাস এবং প্রাণায়াম এড়িয়ে যাওয়া জরুরি। এই দুটো আসন তাদের ক্ষেত্রে আস্তে আস্তে করা প্রয়োজন।
৩. নিজে নিজে যোগ অনুশীলন করা কোনও মানুষের ক্ষেত্রেই ঠিক নয়। যোগগুরু বা শিক্ষকের কাছ থেকে নির্দেশ মেনে শিখে নিয়ে তারপরে তা বাড়িতে চেষ্টা
করা উচিত।
৪. যোগ শিক্ষকের কাছে একজন শিক্ষার্থীর অস্থিসন্ধির ব্যথা, বাত বা আর্থারাইটিসের সমস্যা বা অন্য যে কোনও শারীরিক সমস্যা এবং দুর্বলতার বিষয়ে যথাযথ তথ্য থাকা দরকার। তাহলে কার ক্ষেত্রে কোন যোগব্যায়াম উপকারী হবে সে বিষয়ে তিনি ঠিকঠাক পরামর্শ দিতে পারবেন এবং শিক্ষার্থীর অহেতুক শারীরিক চাপ এড়িয়ে চলার ক্ষেত্রেও সহায়তা করতে পারবেন।
প্রবন্ধটি লিখেছেন ব্যাঙ্গালোরের নিমহানস্ ইন্টিগ্রেটেড সেন্টার ফর যোগা-র জুনিয়র সাইন্টিফিক অফিসার ডাক্তার পূজা মোরে।