অক্ষমতার ঊর্দ্ধে নিজেকে ভালোবাসুন
আমরা যখন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেদের দেখি তখন আমরা মনে মনে নিজেদের অন্যরকম দেখতে লাগার কথা ভাবি। এইসময় আমাদের ভাবতে ইচ্ছে করে যে যদি আমি লম্বা হতাম, ছিপছিপে হতাম, ফর্সা হতাম, আমার মাথার চুল যদি ঘন হত, আমার চোখ দুটো যদি বড় বড় হত প্রভৃতি। আমাদের জীবনে বেড়ে ওঠার সময়ে এই ধরনের অনুভূতিগুলো প্রায়শই আমাদের মধ্যে জাগে। কোনও মানুষের মধ্যে যদি কোনওরকম অক্ষমতা বা দুর্বলতা থাকে তাহলে সেই অক্ষমতার জন্য তার মনে একপ্রকার মিশ্র অনুভূতি দেখা দেয়। নিজেকে নিখুঁত না ভাবার বোধ, নিজেকে অসম্পূর্ণ বা ভঙ্গুর বলে ভাবা এবং কিছু ক্ষেত্রে নিজেকে 'সমাজ-স্বীকৃত সুন্দর'-দের থেকে দলছুট বলে মনে করার কারণে আমাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি জন্মায় ও মানুষ তখন তার নিজেদের দৈহিক ভাবমূর্তি নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে।
অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগতভাবে অক্ষম বা পঙ্গু একটা বাচ্চাকে তাদের অভিভাবকরা শিক্ষা দেয় যে সে কত মূল্যবান, সে খুব অসাধারণ এবং নিজের প্রতি যত্ন নিতে সে যেন ভুলে না যায়। এর সঙ্গে একটা শিশুকে এটাও বলা হয় যে, যদি সে অক্ষম না হত তাহলে সবকিছু একদম ঠিকঠাক থাকত, তা নিয়ে সে গর্বও করতে পারত। কিন্তু একজন শিশুর অনুভূতিগুলোর বদল ঘটতে শুরু করে যখন সে বয়ঃসন্ধি কালে পৌঁছয়। তখন তার মনে ধীরে ধীরে ভিন্ন উপলব্ধি গড়ে ওঠে। তখন তার মনে হয় সে খেলাধুলোয় অংশ নিতে পারবে না। ফলে শরীরের ওজন বেড়ে যাবে, লম্বা হওয়ার পরিবর্তে সে বেঁটে হয়ে যাবে এবং নিশ্চিতভাবে সে নিজেকে কখনোই সুন্দরদের দলে ফেলবে না। অন্যের মুখে নিজের সৌন্দর্য নিয়ে প্রশংসা শুনলে আমরা খুবই তৃপ্তি পাই। তখন আমরা মনে করি আমার মতো আর কেউ এত সুন্দর দেখতে নয়। এই অবস্থায় যখন আমরা জীবনের অন্যান্য প্রত্যেকটা বিষয় নিয়ে আত্মবিশ্বাসী হতে থাকি তখন নিজের ভাবমূর্তি নিয়ে আমরা একটা জায়গায়তেই আটকে যাই এবং সেই ধারণা থেকে কিছুতেই বেরোতে পারি না। এই ঘটনা থেকে আমাদের মধ্যে নিজেদের প্রতি অতিরিক্ত যত্নশীলতা অথবা একেবারেই যত্ন না নেওয়ার মানসিকতা গড়ে ওঠে। এর ফলে আমাদের কৈশোরকালে আমরা সবসময়ে খাওয়াদাওয়া নিয়ন্ত্রণ করি, নিয়মিত শরীরচর্চা করতে শুরু করি এবং অনবরত উপোস করি। হঠাৎ করে যখন খিদের উদ্রেক হয় তখন গোগ্রাসে খেয়ে ফেলি। এই অবস্থায় আমাদের শারীরিক ওজন ক্রমশ বাড়তে থাকে এবং আমরা অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়তে থাকি। কীভাবে আমাদের সঙ্গে এসব ঘটনা ঘটছে তা ভেবে নিজেদের বিব্রত করে তুলি। আসলে বিগত কয়েক বছরে আমরা নিজেরা কতটা ঠিকঠাক আছি সেই চিন্তাই করতে শিখেছি। আরও ভেবেছি যে আমাকে যেমন দেখতে ঠিক তেমনটাই সঠিক। কিন্তু কখনও ভাবিনি যে নিজেকে নিয়ে আমরা এমনসব অতিরিক্ত চিন্তাভাবনা করেছি যার ফলে উন্নতির বদলে অবনতিই বেশি হয়েছে। যদি এরকম ভাবনা না ভাবতাম তাহলে নিশ্চিতভাবে আমরা অনেক শান্তিতে এবং আত্মবিশ্বাসী হয়ে জীবনযাপন করতে পারতাম। আসলে নিজের অক্ষমতাগুলোকে মেনে নিয়ে বা গ্রহণ করে জীবনযাপন করাটা সত্যিই খুব কঠিন ও কষ্টের। যদি কেউ চায় যে সে তার শারীরিক ওজন কমাবে কিন্তু দৈহিক অক্ষমতার কারণে সেটা সম্ভব নয়, তাহলে তার মধ্যে নড়াচড়া করতে না পারার দুঃখ থেকেও ওজন না কমার অনুভূতি অনেক বেশি কষ্টকর বলে মনে হবে। এবং কারোর পক্ষে এই যন্ত্রণা ভোগ করাতে চাওয়া খুব সহজ নয়। তখন তার মনে প্রশ্ন জাগে কে আমাকে এভাবে গড়ে তুলেছে?
যাদের মধ্যে নেতিবাচক দৈহিক ভাবমূর্তির সমস্যা থাকে তাদের সৌন্দর্য ভাবনার মধ্যে নানারকম ত্রুটি লক্ষ করা যায়। এদের মনে ইতিবাচকতার চাইতে নেতিবাচকতার প্রভাবই বেশি থাকে। যদি মানুষের মধ্যে কোনও অক্ষমতা থেকে থাকে তাহলে তাদের ভিতরকার ইতিবাচক ক্ষেত্রগুলোকে বারবার মেলে ধরা জরুরি। বিশেষ করে নিজেদের রূপ-সৌন্দর্যের ক্ষেত্রে এই নিয়ম খুবই প্রযোজ্য। এক্ষেত্রে ইচ্ছাশক্তির প্রয়োজনীয়তা একান্ত কাম্য এবং এর মাধ্যমেই আমাদের মধ্যে হারানোর বোধকে অতিক্রম করতে হবে। মিডিয়ায় সৌন্দর্য এবং অক্ষমতা নিয়ে যে ছবি ফুটে ওঠে তার ফলেও অনেক সমস্যা দেখা দেয়। মিডিয়ায় এমন অভিনেতা-অভিনেত্রী প্রায় দেখাই যায় না যারা কোনও না কোনও অক্ষমতার শিকার। রুপোলি পর্দায় অক্ষমতা এবং সৌন্দর্যের সহাবস্থানের ধারণা কদাচিৎ দেখা যায়। লিঙ্গ বৈষম্য এই সমস্যা আরও বাড়ায়। যদি অক্ষমতা কোনও মহিলার মধ্যে দেখা যায় তাহলে সমাজে যারা (মহিলারা) এমনিতেই নিজেদের দৈহিক ভাবমূর্তির জন্য ভীষণভাবে আলোচিত হয়, সেক্ষেত্রে তাদের মধ্যে সৌন্দর্যের ভাবনার সঙ্গে অক্ষমতার বিরোধ আরও জোরদার হবে। এই সমস্যার সঙ্গে যৌনতাও জড়িত। কারণ অক্ষম মানুষের একটা বড় অংশ বিশ্বাস করে যে তারা অযৌন বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। তাই তারা অন্যদের চেয়ে বেশি করে নিজেদের শরীর খোলামেলা রাখে। এদের ক্ষেত্রে দৈহিক ভাবমূর্তি শুধুই বাহ্যিক একটা আবরণের মতো কাজ করে। সেই ভাবমূর্তি নিয়ে তারা কোনওদিন খুশি হয় না বা সুখে জীবনযাপন করতে পারে না।
অর্জিত বা সহজাত নয় এমন অক্ষমতার ক্ষেত্রে একজন মানুষের মধ্যে হঠাৎ করে না-পাওয়া বা হারানোর বোধ জেগে ওঠে এবং এর থেকেই তার মধ্যে নিজের দৈহিক ভাবমূর্তি নিয়ে গভীর অসন্তোষ দেখা দেয়। মানুষের মধ্যে গড়ে ওঠা এই অসহজাত অক্ষমতা কালক্রমে বিপজ্জনক হয়ে পড়ে। এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য মানুষের উচিত নিজের দুঃখ-কষ্টগুলো মেনে নিয়ে অথবা স্বীকার করে নিয়ে ভালো বা ঠিক থাকা।
প্রায়শই দৈহিক অক্ষম মানুষের প্রতি সক্ষম ব্যক্তির প্রশংসা অক্ষমের দৈহিক ত্রুটির প্রতি সম্মান করার বদলে 'ক্ষতিপূরণ' দেওয়ার মতো একটা বিষয় হয়ে ওঠে। যেমন- অনেকসময়ে বলা হয় ''যদি তোমার হাত অকেজো হয় তাহলে তাতে কী এমন হবে, তোমার হাসিটা তো কত সুন্দর''। এই ধরনের মন্তব্যে একজন অক্ষম মানুষের আত্মবিশ্বাস তলানিতে এসে ঠেকে এবং নিজের অক্ষমতার জন্য তার মনে তীব্র যন্ত্রণা হয়।
দৃষ্টিশক্তির দুর্বলতার কারণে মানুষের দৈহিক ভাবমূর্তিকে ঘিরে নানারকম প্রশ্ন গড়ে ওঠে। যেমন- নিজেদের দৈহিক ভাবমূর্তি তারা কি উপলব্ধি করতে পারছে, তারা কি আদৌ এ বিষয়ে কিছু জানে- এসব নানা প্রশ্ন জেগে ওঠে। এসব ক্ষেত্রে মানুষের উচিত এটা বোঝা যে দৈহিক ভাবমূর্তি শুধু দৃষ্টিগ্রাহ্য বাহ্যিক সত্ত্বা নয়। দৈহিক ভাবমূর্তির অনেক দিক রয়েছে। যেমন- কীভাবে মানুষে-মানুষে দৈহিক ভাবমূর্তির বোধ অনুভূত হবে- স্পর্শ করে, শব্দ শুনে, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বিভিন্ন সঞ্চালন পদ্ধতি উপলব্ধি করে। এগুলোর মিলিত সাহায্যেই আমাদের মধ্যে দৈহিক ভাবমূর্তির উপলব্ধি হয়।
তবে এর সাহায্যে একজন অক্ষম মানুষের মধ্যে নিজের দৈহিক ভাবমূর্তির ইতিবাচক বিকাশ ঘটানো খুবই কষ্টকর। কয়েকটি বিষয়ের উপর এই বিষয়টা নির্ভরশীল। এর অন্যতম চাবিকাঠি হল একজন মানুষের প্রতি তার পারিপার্শ্বিক সাহায্য। পারিবারিক এবং বন্ধুদের সাহায্যে একজন অক্ষম মানুষের ইচ্ছাশক্তিকে জাগিয়ে তোলা জরুরি। এক্ষেত্রে সহানুভূতি দেখানো ও পৃষ্ঠপোষকতা করা একেবারেই অপ্রয়োজনীয় বিষয়। অক্ষম শিশুদের মধ্যে যৌনতার ধারণা গড়ে তোলা বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত। প্রায়শই সক্ষম শিশুদের মতো অক্ষম বাচ্চাদের মধ্যে যৌনতা সম্পর্কে সঠিক শিক্ষা বা জ্ঞান থাকে না। কারণ আমাদের সমাজে এই বিশ্বাসই চালু রয়েছে যে অক্ষম বাচ্চাদের পক্ষে সক্রিয় যৌনজীবন যাপন করা সম্ভব নয়। এর ফলে নিজেদের সঙ্গী এবং দৈহিক ভাবমূর্তির প্রতি এদের নেতিবাচক মনোভাব জন্মায়। সর্বোপরি, নিজের দায়িত্বভার বহন করার গর্ব কম সংখ্যক অক্ষম মানুষকে ইতিবাচক হয়ে উঠতে সাহায্য করলেও সবার ক্ষেত্রেই এই বিষয়টা ততটা ফলপ্রসূ হয় না। কিন্তু প্রশ্ন হল এমন কোনও সুদৃঢ় ব্যবস্থা গড়ে তোলা যায় না যার সাহায্যে ইতিবাচক দৈহিক ভাবমূর্তি জন্মানো সম্ভবপর হয়? মুম্বইয়ের মনস্তত্ত্ববিদ শ্রেয়া শ্রীধরন-মহাত্রে দৈহিক ভাবমূর্তিগত সমস্যা নিয়ে অনেক আলোচনা করেছেন এবং কীভাবে আমরা শান্তিপূর্ণভাবে ইতিবাচক দৈহিক ভাবমূর্তি গড়ে তোলার দিকে পা বাড়াতে পারি তা নিয়ে আমাদের কয়েকটি দিশা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।
প্রবন্ধটি লিখেছেন মানবসম্পদ বিভাগের পেশাদার এবং বৈচিত্র্য ও ঐক্যের প্রচারক মধুমিতা ভেঙ্কটরমন।