সাক্ষাৎকার: ভেদাভেদ মানসিকভাবে অসুস্থদের অক্ষম করে তোলে
আমাদের সামাজে সাধারণত মানসিক অসুস্থতা সম্পর্কে অনেক রকম ভুল ধারণা আছে এবং সেই জন্যই মানসিক অসুস্থ কোন মানুষের সম্পর্কে অনেক অপবাদও প্রচলিত আছে। সেই কারণেই হোয়াইট সোয়ান ফাউন্ডেশনের প্যাট্রিসিয়া প্রীতম মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে সামাজিক সচেতনতা বাড়ানোর বিষয়ে কথা বলেন মেলবোর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়ের অবৈতনিক প্রফেসর ও মেলবোর্ণের সেণ্ট ভিনসেণ্ট হাসপাতালের সাইকিয়াট্রিস্ট সিডনী ব্লচের সাথে।
একজন মনোবৈজ্ঞানিক হিসাবে দীর্ঘ ৪০ বছরের অভিজ্ঞতাতে আপনি মানসিক স্বাস্থ্যের সচেতনতার দিক দিয়ে কি ধরণের পরিবর্তন লক্ষ্য করেছেন?
এই প্রশ্নের উত্তর হল দুটোই - খুবই সামান্য আবার অনেকটাও; যদিও এটা পরস্পরবিরোধী উত্তর। বহু বছর আগে যখন আমি সাইকিয়াট্রিস্ট হিসাবে কাজ শুরু করি, তখন আমাদের কাছে হাতেগোনা কিছু ওষুধ ছিল যেগুলোর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও ছিল খুবই ভয়ানক – যেমন প্রচণ্ড কাঁপুনি, শিহরণ, মুখের ভিতরটা শুকিয়ে যাওয়া এবং আরও অনেক কিছু। যদি জানতে চাওয়া হয় বিগত পঞ্চাশ বছরের মধ্যে কবে মানসিক অসুস্থ হওয়া ভালো, উত্তরটা অবশ্যই হবে বর্তমান সময়ে। কারন, এখন অনেক বেশী সংখ্যক উন্নতমানের চিকিৎসা পদ্ধতি আছে – শুধুমাত্র ওষুধের ক্ষেত্রে নয়, সাইকোলজিক্যাল চিকিৎসা ও সামাজিক চিকিৎসা উভয়ই এখন অনেক বেশী উন্নত। আমরাও এখন মানসিক অসুস্থতার বিষয়ে অনেক বেশী জ্ঞানও অর্জন করেছি; কি ধরণের অসুস্থতা, মস্তিস্কের ভেতরে ঠিক কি ঘটছে ও আরও অনেক কিছুই আমরা এখন জানতে পারছি। কিন্তু, এখন অনেকটা পথ চলা বাকী।
সাধারণভাবে প্রচলিত অসুস্থতার কথা আলোচনা করতে গেলে অবশ্যই অটিজিম্এর কথা বলতে হয়; যেহেতু এটা বর্তমানে বাচ্চাদের মধ্যে সব থেকে বেশী দেখা যায়। কিন্তু বাচ্চা বড় হওয়ার সাথে সাথে তাদের যে পরিবর্তন দেখা যায় তার ফলস্বরূপ আমরা ঠিক মত ধরতেই পারিনা অটিজিমের লক্ষণগুলো। আমরা ভেবে নিই এটা জিনগত রোগ। কারণ, এই রোগের বিষয়ে আমাদের ধারণা খুবই কম এবং আমাদের আরও অনেক কিছু জানার আছে। সৌভাগ্যক্রমে, এই যুগে আমাদের হাতে বিভিন্ন মানসিক অসুস্থতার বিষয়ে জানার অনেক উপযুক্ত উপায় আছে। নিউরোইমেজিং-এর দ্বারা এক উন্নত ধরণের এক্স-রের মাধ্যমে মস্তিস্ক কি পদ্ধতিতে কাজ করে তা জানতে পারি। আমি খুব বিস্তারিতভাবে আলোচনা করতে চাই না, কিন্তু এটা সত্যিই খুবই বিস্ময়কর যখন আমরা মস্তিষ্কের একটা অংশ কম্পিউটারের মাধ্যমে দেখতে পাই। জেনেটিক্সের বিষয়েও আমাদের জানার পরিধিটা অনেকটা বেড়ে গেছে; এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা পদক্ষেপ। এখন আমরা সেই সব জিনগুলোকে চিহ্নিত করতে পেরেছি যেগুলো অটিজিমের জন্য দায়ী। এরপর আমরা এটাও জানতে পারি এই জিনগুলো ঠিক কি করে যার জন্য একটা বাচ্চা অটিস্টিক হয়। ২০০০ সালে হিউম্যান জিনোমের আবিস্কারের পর জেনেটিক্সের বিষয়ে অনেক উন্নতি ঘটেছে।
যদি আপনি ল্যাবরেটরীতে যান আর সেখানে মস্তিস্কের রসায়নিক, নিউরোট্রান্সমিটারস্ ও অন্যান্য বায়োকেমিক্যাল পদ্ধতির পরিমাপ করেন তাহলে আপনি কঠিন মানসিক অসুস্থতার বিষয়ে অনেক কিছুই জানতে পারবেন। আর সেটা অবশ্যই হবে সেই সব কঠিন রোগের চিকিৎসার চাবিকাঠি। আমরা যদিও সঠিক রাস্তাতেই চলছি কিন্তু এটা সময়সাপেক্ষ। আমাদের অবশ্যই ধৈর্য ধরতে হবে। সমস্ত বিষয়টাই আশানুরূপ চলছে; আর এটাই হল সকলের কাছে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ খবর।
সারা পৃথিবী জুড়ে মানসিক রোগীদের সমাজ আলাদা করে রেখেছে। সমাজের এই ভুল ধারণাকে দূর করতে আমাদের কি পদক্ষেপ নেওয়া দরকার?
এটাই হল সবথেকে কঠিন চ্যালেঞ্জ। প্রথম থেকেই মানসিক অসুস্থতায় ভুগছেন যাঁরা তাঁদেরকে আলাদাই রাখা হয়েছে। আর পাঁচজন সাধারণ মানুষের মত জীবনযাপন করার অধিকার তাঁদের নেই। এটা আংশিকভাবে সত্য, কারণ, আপনি যদি একজন ১৮ বছরের ছাত্র হন যিঁনি মানসিক ভাবে অনেকটাই অসুস্থ, ও আর পাঁচটা মানসিকভাবে সুস্থ সমবয়স্ক ছাত্রের সাথে থাকেন, স্বাভাবিকভাবেই সুস্থ ছাত্রের থেকে আপনার কেরিয়ার, বিবাহের সম্ভাবনা অনেকটা কম। কাজেই, মানুষের মনে এইসব রোগীদের খুবই অস্বাভাবিক ঠেকে এবং তাঁরা এই অসুস্থতাটা বুঝতেই পারেন না।
আমাদের আরও ধারণা হয় যে যাঁরা মানসিক অসুস্থতাতে ভুগছেন, তাঁরা কখনো আর পাঁচজনের মত সফলভাবে স্বাভাবিক জীবন ধারণ করতে পারবেন না। অন্যভাবে বলতে গেলে আমরাই তাঁদের মাথাতে অক্ষমতার লেবেল লাগিয়ে দিই এবং তারপর আমরা তাঁদেরকে সামাজিক দিক দিয়ে আলাদাও করে দিই। আমরা আরও বলি, ওঁরা কাজের উপযুক্ত নন, কাজেই আমারা তাঁদের কোন কাজও দিই না। তাঁরা অন্যান্য দায়িত্ব নিতেও অপারগ বলে আমরা তাঁদের কোনোরকম কাজের দায়িত্বও দিই না। কিন্তু, এটা হল এইসব রোগীদের থেকে ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া ছাড়া আর কিছু নয়। এই অবস্থার সাথে মোকাবিলা করার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে এবং এর একমাত্র রাস্তা হল শিক্ষা। আমাদের সবাইকে বোঝাতে হবে যে মানসিক অসুস্থদের দেখার এটা সঠিক পথ নয়। আর একটা উপায় যেটা আমি অবলম্বন করি সেটা হল, রোগী ও তাঁর পরিবারকে একজন মনোবইজ্ঞানিককে সাহায্য করতে বলি যাতে সমাজের এই কলঙ্ক ও বিভেদকে দূরে রাখা যায়। আমি রোগীদেরকে জানাই যে তিনি যেন তাঁর পরিবার ও আশেপাশের লকজনকে জানান যে তাঁরাও মানুষ, তাঁদের যেমন অসুস্থতা আছে তেমনি চাহিদা আছে, অনুভূতি আছে; কিন্তু সবার আগে তাঁরাও আর পাঁচজনের মত একজন মানুষ।
আমি মনে করি ভারতের তুলনায় অস্ট্রেলিয়াতে মানসিক অসুস্থদের উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থার সাথে সাথে সামাজিক স্বীকৃতিও পাওয়া যায়। কাজেই, ভারতের মত দেশগুলোতে যেখানে মানসিক অসুস্থতা সাম্প্রদায়িকতা ও সামাজিকতার গণ্ডি থেকে বেড়িয়ে আসতে পারেনি সেই সব দেশের জন্য আপনি কি উপদেশ দিতে চান?
এটা একটা সত্যিই বড় সমস্যা যদিও আমি নিশ্চিত নই আপনি যা বলছেন তা সত্যি কি না। হ্যাঁ, আমরা সামাজিক দিক থেকে অনেকটাই উন্নত এবং আমাদের কাছে মানসিক স্বাস্থ্য, সাইকিয়াট্রি সবেরই অনেক উপাদান আছে, কিন্তু মানসিক অসুস্থতা বিষয়টা সব সময়ই গরীব আত্মীয় সিন্ডারেলার মতই অবহেলিত। উদাহরণ স্বরূপ, এখন মেলবোর্ণে হার্ট ট্রান্সপ্লান্ট করতে আধ মিলিয়ন অসট্রেলিয়ান ডলার খরচ হয়। সমাজ সেটা দিতে রাজী। সমাজ সেখানে হার্ট ট্রান্সপ্লান্ট-এর জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে প্রস্তুত, কারণ এটা অনেক বেশী নাটকীয় ও উত্তেজক। কিন্তু, যখন মানসিক অসুস্থদের চিকিৎসার কথা আসে, যেটা এখানে অনেক সস্তা, সেখানে কেউ আর্থিক সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় না।
আমাদের এখানে অনেক রকম জীবিকা যেমন সাইকিয়াট্রি, সাইকোলজি, সাইকিয়াট্রিক সোশ্যাল ওয়ার্ক, মেন্টাল হেলথ নার্স এবং অক্যুপেশনল থেরাপিস্ট মানসিক স্বাস্থ্যের সাথে জড়িত আছেন। সব মিলিয়ে আমাদের সব শক্তিকে একত্রিত করে আমাদেরকে মানসিক অসুস্থদের চিকিৎসা ও তাঁদের দেখাশোনার মানের উন্নতির চেষ্টা করতে হবে। কিন্তু এটা একটা সুদীর্ঘ পদ্ধতি, যা রাতারাতি ঘটানো সম্ভব নয়।
আমার এখন মনে পরে সেই দিনগুলোর কথা, যখন আমি একজন কমবয়সী সাইকিয়াট্রিস্ট হিসাবে একটা তুলনামূলক অনুন্নত হাসপাতালে অনেক কম উপাদানের সাথে কাজ করতাম। এখন সমস্ত বিষয়টাই অনেক পরিবর্তিত এবং এখন আমাদের আউট পেশণ্ট ক্লিনিকও শুরু হয়ে গেছে। কাজেই সময়ের সাথে সাথে নতুন নতুন সম্ভাবনাও আসতে থাকে ও তার সাথে সাথে সরকারের সাহায্য বৃদ্ধিরও চেষ্টা করতে হবে কারণ সরকারই হল প্রধান অবলম্বন।
আমি বলতে পারি যে, ভারতের মত দেশগুলোকে এটা মাথায় রাখতে হবে যে কালকেই বা তারপর দিন বা তার পরের দিনই এই পরিবর্তন ঘটবে না। কিন্তু, সমাজে ক্রমবর্ধমান মানসিক অসুস্থতার উপযুক্ত চিকিৎসার প্রয়োজন ও সম্ভাবনার কথা মাথায় রেখে আমাদের আস্তে আস্তে উন্নতির দিকে এগিয়ে যেতে হবে। আমি সব সময় নিজেকে বোঝাই যে আমরাই উন্নতির রাস্তা তৈরী করব কিন্তু কোন আকাশকুসুম কল্পনার মাধ্যমে নয়। কারণ, সেটা কখনই ঘটবে না এবং আমাদের মনখারাপও হবে আর আমরা হতাশ হয়ে পড়ব। কিন্তু এতদিনের অভিজ্ঞতায় আমি যা দেখেছি তা হল, কিছু কিছু ক্ষেত্রে পুরো বিষয়টা যথেষ্ট সম্ভাবনাময় এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে এতটাই উন্নতি হয়েছে যে তা সত্যিই প্রশংসার যোগ্য। আমি কখনই এই ধারণা পোষণ করতে চাই না যে আমরা সব দিক দিয়েই আপনাদের থেকে অনেকটা এগিয়ে; আমি যেটা চাই তা হল মত বিনিময় বা ভাবনার আদান-প্রদান। আমি যেমন এখানে এসেছি, আপনারাও আমাদের কাছে আসুন; আমরা সবাই মিলে কিভাবে সমস্ত বিষয়টাকে উন্নত করা যায় তা আলোচনা করে তাকে কাজে পরিণত করার চেষ্টা করি।