মানসিক অসুস্থতা এবং হিংসার খবরের ক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যমের উচিৎ সংবেদনশীল হওয়া

মানসিক অসুস্থতা এবং হিংসার খবরের ক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যমের উচিৎ সংবেদনশীল হওয়া

কোনও হিংসার ঘটনা, বিশেষত সেই ঘটনার সঙ্গে যদি কোনও মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যা জড়িয়ে থাকে, তাহলে তা নিয়ে খবর করা খুবই নজর কাড়া একটি বিষয়। গত সপ্তাহে দেশের নামকরা সংবাদপত্র এবং টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে মানসিক রোগের হাসপাতালে চিকিৎসাধীন এক ব্যক্তির গুলি ছোড়ার ঘটনা নিয়ে বড় করে একটা খবর পরিবেশন করা হয়েছিল। কিছু কিছু মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্যার খবর করা হয় সেই সমস্যার চরিত্র সম্পর্কে ধারণার উপর ভিত্তি করে। আবার কয়েকটি ক্ষেত্রে চোখে দেখা যায়নি এমন দৃশ্যের বর্ণনায় উত্তেজনাময় বিশেষণ ব্যবহার করাও হয়। মানসিক স্বাস্থ্য ও হিংসা সম্পর্কে মানুষের মনে ভুল ধারণা গড়ে তুলতে বেঠিক খবর বা প্রতিবেদন একটা বড় ভূমিকা পালন করে। আর এই কারণেই মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যাজনিত কলঙ্কের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধভাবে লড়াই গড়ে তোলা সম্ভব হয় না। মানসিক অসুস্থতা বিষয়ক খবর বা প্রতিবেদনের জন্য কিছু নির্দেশিকা মেনে চলার জন্য হোয়াইট সোয়ান ফাউন্ডেশন এবং নিমহানসের সাইকিয়াট্রি বিভাগের অধ্যাপক ডাক্তার ভি সেন্থিল কুমার রেড্ডির কথপোকথন তুলে ধরা হল।

একজন মানসিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তি, যে একটা হিংসার ঘটনার সঙ্গে যুক্ত, সেই খবর কীভাবে সংবেদনশীলতার সঙ্গে তুলে ধরা যায়?

মানসিক রোগে ভুগছে এমন মানুষের জীবনে যদি কোনও দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটে তাহলে সেই খবর পরিবেশনের সময়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রকৃত তথ্যের বদলে বেঠিক খবর প্রকাশিত হয়। এই ঘটনা একজন মানসিক রুগিকে হিংসা অথবা আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেয়। এক্ষেত্রে একমাত্র পরামর্শ হল প্রকৃত তথ্য তুলে ধরে ঘটনার সত্যাসত্য বিচার করা। এক্ষেত্রে প্রয়োজন হয় ঘটনার নির্দিষ্ট তথ্য বা সূত্র খুঁজে বের করা।

মানসিক সমস্যাজনিত খবরের ক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যম বা মিডিয়া কীভাবে সামাজিক কলঙ্ক দূর করে আরও বেশি সংবেদনশীল হয়ে উঠবে?

একটা ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ না দেওয়াটাই সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। একের পর এক ঘটনার বর্ণনা দিতে শুরু করলে তা অনেকসময়ে প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে ফেলে এবং যথাযথ হয় না। কারণ বাস্তব অবস্থাটা আমাদের কাছে স্বচ্ছ ও সহজলভ্য নাও থাকতে পারে। এক্ষেত্রে লক্ষ্যভিত্তিক খবর পরিবেশন করাই দরকার। যেমন- যে ঘটনা ঘটেছে তাতে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কি হয়নি সে কথা  উল্লেখ করা একান্ত জরুরি। এভাবে একটা বৃহত্তর সমাজকে শিক্ষিত করার চেষ্টা করা যেতে পারে এই কথা বলে যে, মানসিক অসুস্থতাই শুধু হিংসার জন্ম দেয় না। বরং এর পিছনে থাকতে পারে আরও অনেক কারণ। এছাড়াও সাহিত্যে বর্ণিত হয়েছে এমন একজন মানসিকভাবে অসুস্থ মানুষের মধ্যেকার হিংসা সম্পর্কিত ভুল ধারণাকেও তুলে ধরা যায় এবং এই সমস্যা থেকে যে সমাজে আরও বেশি করে হিংসা ছড়ায় সেই বিষয়টাও তুলে ধরা জরুরি।

মানসিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তির উপর একটা বেঠিক প্রতিবেদনের কী প্রভাব পড়তে পারে?

প্রায়শই দেখা যায় যে, একটা ঘটনাকে কেন্দ্র করে যদি ভুল খবর বা শিরোনাম প্রকাশিত হয় তাহলে মানসিক অসুস্থতাজনিত সামাজিক কলঙ্ক যেমন বাড়তে পারে তেমনই মানুষের মনে মানসিক অসুখ বিষয়ক ভুল ধারণা গড়ে ওঠে, যা একসময়ে হিংসায় পরিণত হয়। সমাজে মানসিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তিদের বেশিরভাগই পরিস্থিতির শিকার ও কোণঠাসা হয়ে পড়ে। সমাজের দ্বারা তারা একদিকে নিগৃহীত হয় আবার অন্যদিকে হিংসার বলিও হয়ে যায়। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে এই ঘটনার ফলাফলই উঠে আসা জরুরি।

সাধারণভাবে একটা ধারণা প্রচলিত রয়েছে যে, মানসিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তিরা একজন মানসিক রোগের শিকার নয় এমন মানুষের তুলনায় অধিক হিংসাত্মক বা ভয়ংকর হয়। এই ধারণাটি কি সত্যি?

ধারণার সঙ্গে বাস্তবের মিল থাকে না। এই বিষয়টি নিয়ে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং পৃথিবী ব্যাপী গবেষণাও হয়েছে। যে সব মানুষ মানসিক রোগের শিকার হয় তাদের খুব কম শতাংশের মধ্যেই হিংসাত্মক মনোভাব বা মারমুখী হয়ে ওঠার প্রবণতা দেখা যায়। সংখ্যাটা ৫ থেকে ১৫ শতাংশের মধ্যেই ঘোরাফেরা করে। অর্থাৎ, ১০০ জন মানসিক রুগির মধ্যে ৫ থেকে ১৫ জনের আচরণে হিংসার ভাব ফুটে ওঠে। আর সমাজে এই হিংসার শিকার মানসিক রুগির অপরিচিত কোনও  ব্যক্তি হয় না। হয় তার পরিবারের সদস্যরাই। এই হিংসার পিছনে মানসিক অসুখের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ থাকে না। এর সঙ্গে যুক্ত থাকে মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কজনিত সমস্যা। অন্যদিকে, সমাজের অন্যান্য মানুষ যারা এই হিংসার অপরাধের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তা নিয়েও অনেক গবেষণা হয়েছে। এক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে যে, সমাজে মাত্র ৪ শতাংশ এমন অপরাধ থাকে যা একজন মানসিকভাবে অসুস্থ মানুষের জন্য ঘটেছে। আর বাকি ৯৬ শতাংশ অপরাধ ঘটানোর পিছনে দায়ী থাকে সেই সব মানুষ যারা কোনও মানসিক রোগের শিকার নয়। সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ, যারা বিভিন্ন হিংসাত্মক কাজকর্ম বা অপরাধের সঙ্গে যুক্ত থাকে,  তারা কিন্তু আদৌ মানসিকভাবে অসুস্থ হয় না। মানসিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তিরা যে অন্যান্য বাকি সব মানুষের চাইতে বেশি ভয়ংকর বা মারমুখী হয় তা কিন্তু নয়। আর মানসিক অসুখের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে হিংসাত্মক কাজকর্ম এবং এর দ্বারা অন্যান্যদের ক্ষতি করার ঝুঁকি থাকে না।

আপনি বলছেন যে, মানসিক রোগ কোনও মানুষের মধ্যে হিংসার উদ্রেগ ঘটায় না। তাহলে ঠিক কী কারণে মানসিকভাবে অসুস্থ মানুষজন হিংসামূলক অপরাধ ঘটিয়ে ফেলে?

গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, একই অসুখে আক্রান্ত হয়ে কিছু মানুষ মারমুখী আচরণ করছে, আবার কেউ কেউ তা করছে না। কয়েকজন মানুষ হিংসাত্মক অপরাধের সঙ্গে যুক্ত থাকে না আবার কয়েকজনের আচরণে হিংসার ভাব ফুটে ওঠে। যারা হিংসাত্মক কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত থাকে তাদের আচরণের মধ্যে আগে থেকেই এমন কয়েকটি উপাদানের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়, যা তাদেরকে অপরাধমূলক কাজ করতে এগিয়ে দেয়। এবং এহেন গোষ্ঠীভুক্ত সবার মধ্যেই এমন আচরণের বহিঃপ্রকাশ দেখা যায়-

১. অ্যালকোহল, ড্রাগ এবং মাদকের প্রতি আসক্তি- বৃহত্তর সমাজের অধিকাংশ মানুষ, যাদের জীবনে ড্রাগ বা যে কোনও নেশার বস্তুর প্রতি আসক্তির ইতিহাস থাকে, তারা অনেক বেশি মারমুখী হয়ে থাকে।

২. মানুষের চরিত্রে এমন কতগুলি বৈশিষ্ট্য থাকে, যার ফলে তারা উগ্র মনোভাবাপন্ন হয়। যেমন- হঠকারিতা, অন্যকে দমন করার প্রবণতা, প্রকৃত শিক্ষার অভাব, দারিদ্র্য এবং নিম্ন আর্থ-সামাজিক অবস্থান।

এই সমস্ত উপাদানগুলি একজন মানুষকে হিংসার আশ্রয় নিতে বাধ্য করে। এক্ষেত্রে তার মধ্যে মানসিক অসুস্থতা থাকুক বা না থাকুক, তা কখনোই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়ায় না। তাই স্বভাবতই একজন মানসিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তির চরিত্রে যদি এসব উপাদানগুলি বর্তমান থাকে তাহলে সে অন্য একজন মানুষ, যে মানসিক রোগে আক্রান্ত হলেও চরিত্রে উপরোক্ত উপাদানগুলির উপস্থিতি নেই, তার চাইতে অনেক বেশি মারমুখী হবে।

সংবাদমাধ্যমে যখন মানসিক অসুস্থতার খবর পরিবেশন করা হবে তখন ঠিক কী ধরনের ভাষা ব্যবহারের পক্ষপাতী আপনি?

'মানসিকভাবে অসুস্থ'- এই কথার পরিবর্তে মানসিক সমস্যা বা অব্যবস্থার শিকার এভাবে ব্যাখ্যা করাই যুক্তিযুক্ত। আসলে 'মানসিকভাবে অসুস্থ' বললে সমস্ত মানসিক অসুখকেই এক আসনে বসানো হয়। প্রকৃতপক্ষে, কয়েকটি নির্দিষ্ট অসুখের ক্ষেত্রেই একজন মনোরুগির মারমুখী হয়ে ওঠার ঝুঁকি থাকে। যে ব্যক্তি গুরুতর মানসিক অবসাদ বা উদ্বেগে আক্রান্ত হয়, তার মধ্যে কিন্তু হিংসাত্মক মনোভাব তত চোখে পড়ে না। এমনকী, স্কিৎজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্তরাও হিংসার শিকার হয়ে পড়ে, কিন্তু তাদের কখনোই হত্যাকারী হিসেবে বিচার করা ঠিক নয়। স্কিৎজোফ্রেনিয়ার রুগিরা সামাজিকভাবে নিগৃহীতও হয়ে থাকে।

আমাদের চারপাশে প্রতিনিয়ত প্রচুর হিংসার ঘটনা ঘটছে। সংবাদমাধ্যমের পক্ষে মানসিক অসুখের সঙ্গে জড়িত নয় এমন সমস্ত হিংসার ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ খবর রাখা সম্ভব নাও হতে পারে। যে সমস্ত ঘটনার দ্বারা সমাজে উত্তেজনা ছড়ায় এবং মানুষ সেই পরিস্থিতির শিকার হয়ে পড়ে, সেই সব খবর সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ পাওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি থাকে। এই ধরনের পরিস্থিতির শিকার হওয়াটা যে একজন মানসিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে, তা নয়। ওই ব্যক্তির পরিবারের সদস্য এবং বন্ধুবান্ধবরাও এই ঘটনার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত বা কলঙ্কিত হতে পারে।

মানসিক অসুস্থতা এবং হিংসার প্রতিবেদনের ক্ষেত্রে প্রচলিত নির্দেশিকা

মানসিক অসুস্থতা বিষয়ক সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনের ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের সুপারিশগুলি হল-

Related Stories

No stories found.
logo
হোয়াইট সোয়ান ফাউন্ডেশন
bengali.whiteswanfoundation.org