আমাদের সচেতনতার অভাব আমার একমাত্র দুঃখের কারণ
দু'হাজার সাল নাগাদ শুরু হয় সেসব ঘটনা যখন আমরা রাজস্থানের যোধপুরে থাকতাম। তখন আমি সবে ১২ ক্লাস পাশ করে কলেজে পা দিয়েছি। সেই সঙ্গে আমি একটা চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেসি কোর্সেও ভর্তি হয়েছি। আমরা ছিলাম সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষ এবং খুব তাড়াতাড়ি বাবা মারা যাওয়াতে (১৯৮৯ সাল) আমাদের কঠিন জীবন-সংগ্রামের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। আমার মা আমায় ও বোনকে নিয়ে নিউ দিল্লীতে চলে গিয়েছিল। মা সেখানে একটা স্কুলের শিক্ষিকা ছিল। সেই সময়ে আত্মীয়-পরিজনদের কোনও সাহায্যই জোটেনি আমাদের কপালে।
আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন আমাদের মায়ের মধ্যে কোনরকম মানসিক অসুস্থতার লক্ষণ ছিল না। মায়ের তখন সমস্যা ছিল বারবার বাড়িঘর ঠিকঠাক তালাচাবি দেওয়া আছে কিনা, তা দেখা অথবা স্টোভটা ঠিকমতো বন্ধ রয়েছে কিনা, তা বারেবারে পরীক্ষা করা। পরে এগুলোই আমরা অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার (ওসিডি) বা সমস্যা বলে জানতে পেরেছিলাম।
দু'হাজার সালের ঘটনায় আসি, যখন মা আমাদের বলেছিল যে মা মাথায় একপ্রকার জোরালো আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে এবং মা অনুভব করছে যে কেউ যেন তার সঙ্গে কথা বলছে। প্রথম প্রথম বিষয়টা বুঝতে না পেরে আমরা খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। বাড়ির মধ্যে কোনও যন্ত্র লাগানো হয়েছে কিনা তা পরীক্ষা করার জন্য মা পুলিশকেও খবর দিয়েছিল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মায়ের কাছে এটা নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়। যে কণ্ঠস্বর মা শুনতে পেত তাতে সম্মতি এবং জবাব দিতেও শুরু করেছিল মা। ছোটবেলায় আমরা কখনও স্কিৎজোফ্রেনিয়া নামক অসুখের নামই শুনিনি। আর স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি যে এই অসুখে আমাদের মা আক্রান্ত হবে। তাই আমরা ভেবেছিলাম যে মায়ের এই অবস্থা আস্তে আস্তে কেটে যাবে। কিন্তু অবস্থাটা ক্রমে ভয়াবহ হয়ে ওঠে।
দিন যত এগোতে থাকে মা ওই কণ্ঠস্বরের নির্দেশ মেনে হাঁটাচলা ও কাজকর্ম করা শুরু করে। মা তাকে জিজ্ঞেস করত যে কোন কাজটা সে করবে বা করবে না। অনেকসময়ে ওই কণ্ঠস্বরের কথামতো মা খেত না, ঘুমাতো না বা আরও দুর্বিষহ ঘটনা ঘটেছিল যখন মা ভাবত যে কেউ তাকে মারতে চাইছে। অথবা ওই কণ্ঠস্বরকে মাঝে মাঝে ভারতীয় দেবদেবীদের মধ্যে অন্যতম হনুমান বলে তার মনে হত। এভাবে ক্রমশ ওই কণ্ঠস্বর মায়ের উপরে একেবারে সর্বশক্তি দিয়ে প্রভাব ফেলতে শুরু করেছিল। বাচ্চা ছিলাম বলে আমরা কী ঘটছে তা বুঝতেই পারতাম না। এই পরিস্থিতিতে আত্মীয়দের সঙ্গে পুরনো তিক্ত সম্পর্ক থাকায় তাদের কাছে থেকে কোনও সাহায্যই আমরা প্রত্যাশা করিনি। এমনকী পাড়া প্রতিবেশীদের সঙ্গেও এই বিষয়টা নিয়ে আমরা কখনও কথাবার্তা বলার আগ্রহ দেখায়নি। আমি স্বভাবের দিক থেকে অর্ন্তমুখী ছিলাম বলে আমার এমন কোনও বন্ধুবান্ধবও ছিল না, যাদের কাছে এই সমস্যার কথা আমি খুলে বলতে পারতাম।
অনেক সময়ে আমি চেষ্টা করতাম বাবা-মায়েরা যেমন বাচ্চাদের বকাবকি করে তেমনভাবে আমার মাকেও বকাঝকা করতে। আমি মাকে ওই সমস্যার হাত থেকে বের করে আনতে চেয়েছিলাম। কিন্তু বিষয়টা তখন হাতের বাইরে বেরিয়ে গিয়েছিল। মা ওই কণ্ঠস্বরটা সত্যি বলে বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল এবং আমার কোনও কথাই শুনত না। এখন আমার মনে হয় যে সেদিন আমার কথা বোঝা বা শোনার মতো অবস্থায় মা ছিল না। মা খাওয়াদাওয়া করা ছেড়ে দিয়েছিল। বা ততটুকুই খেত যতটুকু মাকে ওই কণ্ঠস্বর খেতে বলত, যার পরিমাণ সাধারণত অর্ধেক রুটির বেশি হত না; মা ক্রমশ দুর্বল হতে শুরু করেছিল এবং তার হাড়ের শক্তিও ক্ষয় হতে শুরু করে।
একদিন একের পর এক বাসনপত্র ঘরের বাইরে ছুড়তে শুরু করে মা। এটা দেখে আমাদের প্রতিবেশী এক কাকিমা নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে না। তিনি তখন তাঁর মেয়েকে মায়ের সঙ্গে কথা বলার জন্য পাঠান। তার কাছে সব কথা খুলে বলে আমরা আরও বেশি করে সমস্যা ডেকে এনেছিলাম (এটা আমি পরবর্তীকালে উপলব্ধি করেছিলাম)। ওই মেয়েটির একটা কীর্তনের দল ছিল। যেহেতু মায়ের অসুখ সম্পর্কে তাদের কোনও জ্ঞান বা ধারণাই ছিল না তাই তারা বলেছিল যে মায়ের শরীরে কোনও অশুভ শক্তি ভর করেছে। সেই মতো ওঝা ও অলৌকিক 'বাবা'দের কাছে যাতায়াত শুরু হয়েছিল আমাদের। প্রতি সপ্তাহে যখন 'বাবা'দের কাছে আমরা যেতাম তখন সেখানে প্রচুর লোকের ভিড় জমত এবং 'বাবা'রা ভভূতি বা আশীর্বাদ করত, আর মনে হত যে এভাবেই সব অসুখ সেরে যাবে।
কিন্তু তেমন কোনওকিছুই ঘটেনি। বরং দিনে-দিনে মায়ের অবস্থা ক্রমশ খারাপ হতে শুরু করে। একজনের কথামতো আমরা জ্যোতিষির সঙ্গে যোগাযোগ করি। তিনি আমাদের বলেন যে এসব হচ্ছে গ্রহের দোষের জন্য। সেই দোষ কাটাতে উনি আমাকে পুজো দিতে বলেন। তাঁর কথা শুনে আমিও আজমীঢ়ের পুষ্করে গিয়েছিলাম পুজো দিতে। সেখানে পবিত্র পুকুরে ডুব দিয়ে আমি পুজো দিই। যেহেতু আমি সাঁতার জানতাম না তাই পুকুরে নেমে আমি প্রায় ডুবেই যাচ্ছিলাম। মনে হয়েছিল যেম মরতে মরতে আমি কোনওক্রমে বেঁচে গেলাম!
সেই সময়ে এমন সব কাজকর্ম করেছিলাম যা করার পিছনে কোন যুক্তিই ছিল না। একদিন সকালে দেখলাম মা ফিনাইলের বোতল খুলে তা খাচ্ছে। দেখে আমি একেবারে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম। মাকে যখন জিজ্ঞেস করলাম যে মা এটা কী করছে তখন মা বলেছিল যে ওই কণ্ঠস্বরই মাকে এমন করতে বলেছে। আমি সঙ্গে সঙ্গে মাকে নিয়ে হাসপাতালে যাই এবং মায়ের শরীর থেকে পাম্প করে ফিনাইল বের করেন ডাক্তারবাবুরা। সেই যাত্রায় মা রক্ষা পেয়েছিল।
আর সহ্য করা যাচ্ছিল না। ডাক্তাররা বলেছিলেন যে সূর্যোদয়ের আগে যেমন আকাশ অন্ধকারে ছেয়ে যায় ঠিক তেমনভাবেই মায়ের জীবনে ঘন অন্ধকার নেমে এসেছে। আমাদের একজন আত্মীয় পরামর্শ দিয়েছিল যে মাকে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যেতে। ওই পরামর্শ আমাদের কাছে দৈববাণীর মতো ছিল। তাই দেরি না করে আমরা মাকে একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে গেলাম। প্রথম দিন প্রায় এক ঘণ্টা ধরে মা তার অভিজ্ঞতার কথা ডাক্তারকে বলেছিল; মায়ের মাথায় সেই শব্দ শোনার অনুভূতি, যার ফলে মায়ের মনে হত যে কেউ মায়ের সঙ্গে কথা বলছে এসব কথা সেদিন ডাক্তার খুব মন দিয়ে শুনেছিলেন। ডাক্তারকে দেখে মনে হয়েছিল তিনি ঈশ্বর-প্রেরিত কোনও মানুষ এবং তিনি আমাদের প্রতি খুবই সংবেদনশীল ছিলেন। তিনি আর দেরি না করে মাকে তাড়াতাড়ি ওষুধ দিতে শুরু করেন।
ওষুধের প্রত্যক্ষ ফল হিসেবে সমস্যা যেন এক ধাক্কায় অনেকটা কমে গেল। মায়ের মাথায় অনুভূত হওয়া সেই আওয়াজটা অনেকটাই দূর হয়ে যেতে শুরু করল। তার খিদে পেতে শুরু করল এবং আস্তে আস্তে মা স্বাভাবিক জীবনে প্রবেশ করতে থাকল। ঘর-গৃহস্থালীর কাজে মা আবার সক্রিয় হয়ে উঠতে থাকল। আমরা তখন সেইসব প্রতিবেশীদের সঙ্গে সময় কাটাতে শুরু করেছিলাম যারা একদিন সাহায্যের নাম করে আমাদের উদ্ধার করার জন্য এসেছিল।
১৫ বছর ধরে ওষুধ খেয়ে মায়ের অসুখ এখন নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এই এতগুলো বছরে আমাদের জীবনে অনেক ওঠা-পড়া এসেছে। কিন্তু তাদের কোনওটার সঙ্গেই ২০০০-২০০১ সালের অবস্থার তুলনা করা ঠিক নয়। আমার একমাত্র দুঃখ হল আমাদের অজ্ঞতা বা সচেতনতার অভাবের জন্যই আমার মায়ের অসুখের যথার্থ চিকিৎসা শুরু হতে দেরি হয়। অসুখের লক্ষণগুলো দেরি করে ধরা পড়ে। ফলে ওষুধ খাওয়ার ক্ষেত্রেও অহেতুক দেরি হয়। আর এসবের জন্যই আমার মায়ের জীবনটা একেবারে দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল।
মায়ের সঙ্গে সঙ্গে আমিও জীবনে খুব খারাপ সময়ের মধ্যে দিয়ে গিয়েছি। আমি উপলব্ধি করেছি রুগির সঙ্গে তার পরিবারের লোকেরাও একইরকম আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটায়। তাই পরিচর্যাকারীদের জন্য চাই এমন সাহায্য, যেখানে তারা তাদের সমস্যা, ব্যথা বা বেদনার কথা খুলে বলতে পারে এবং সমস্ত বাধা অতিক্রম করার জন্য ভিতরে ভিতরে তারা শক্তি অনুভব করতে পারে। প্রত্যেক মানুষের উচিত অন্যান্য যে কোনও অসুখ যেমন- হার্টের অসুখ বা পার্কিনসন্স-এর মতো মানসিক অসুখ সম্পর্কেও সঠিক ধারণা থাকা এবং যারা মানসিক অসুখে ভুগছে তাদের ব্যথা-যন্ত্রণা নিয়ে পরিবারের মধ্যে খোলাখুলি আলোচনা করা। আর এটা করতে পারলেই একমাত্র আমরা এর খারাপ প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারব।
শেষে আমি সবাইকে জানাতে চাই যে কলেজে পড়ার সময়ে আমার মাকে তার বন্ধুরা রানী লক্ষ্মীবাই বলে ডাকত। সেই নাম যে কত যথার্থ ছিল তা বোঝা যায় মায়ের জীবনযুদ্ধে সব বাধা-বিপত্তি কাটিয়ে একজন সৈনিকের মতো দিন যাপনের ঘটনায়। অসুস্থতার বিরুদ্ধে লড়াই করার সময়ে মা কখনও যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে পালায়নি। এবং সবচেয়ে বড় বিষয় হল মা তার জীবনদর্শনের যে শিক্ষা আমাকে দিয়েছিল তার সংক্ষিপ্ত অর্থ হল- ''হিম্মত সে'' মানে নিজের প্রতি সাহস রাখো বা ভরসা রাখো।