কীভাবে মানসিক প্রাণোচ্ছ্বলতা বাড়াতে পারেন আপনি?
মানসিক চাপের পরে কোনও মানুষের মধ্যে কি মানসিক স্থিতিস্থাপকতা বজায় রাখা সম্ভব হয়? যখন আমি গ্র্যাজুয়েট স্তরে পড়াশোনা সম্পূর্ণ করেছিলাম, তখন মানসিক চাপের মোকাবিলা সংক্রান্ত একটি অ্যাসাইনমেন্ট-এর সময়ে এই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছিল আমায়। তারপর বহু বছর ধরে নিজের লেখাপড়া ও চিকিৎসার কাজে যুক্ত থাকার পর আমি বুঝেছি যে মানসিক স্থিতিস্থাপকতা কেমনভাবে ধরে রাখতে হবে, তা একজন মানুষকে শিখতে হয়। অর্থাৎ, জীবদ্দশায় সেই দক্ষতা আমাদের অর্জন করতে হয় এবং জীবনের বিভিন্ন জটিলতা সত্ত্বেও মানুষকে স্থিতিস্থাপক বা প্রাণোচ্ছ্বল থাকার জন্য নিজস্ব ক্ষমতা গড়ে তুলতে হয়।
এখন প্রশ্ন হল, মানসিক স্থিতিস্থাপকতা বলতে কী বোঝায়? মনস্তত্ত্বের পরিভাষায় মানসিক স্থিতিস্থাপকতা হল কোনও বিপর্যয় বা মানসিক চাপ অতিক্রম করে একজন মানুষের আবার আগের জায়গায় ফিরে আসা অর্থাৎ পূর্বাবস্থায় ফিরে আসার দক্ষতা পরিমাপক একটি বিষয়। যদিও এখন মানসিক স্থিতিস্থাপকতাকে আরও বৃহত্তর অর্থে বিচার করা হয় এবং এর সঙ্গে অনেক উপাদান যুক্ত থাকে, যেমন- ব্যক্তিগত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, কোনও ঘটনার বিরুদ্ধে মোকাবিলা করার উপায় ও প্রক্রিয়া, মানুষের জীবনের ঝুঁকি ও আত্মরক্ষামূলক উপাদান এমনকী, যে মানুষের উপর চাপের প্রভাব পড়ে তার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল প্রভৃতি। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, মানসিক আতঙ্ক বা মৃত্যুভয় কাটিয়ে সৈন্যরা কীভাবে আবার নিজেদের কর্মজীবনে ও ব্যক্তিগত জীবনে ফিরে আসে? বা নিজের চোখে কোনও হিংসাত্মক ঘটনা দেখার পরে কীভাবে পুলিশ অফিসাররা আবার নিজেদের কর্ম-দায়িত্ব পালন করেন? এবং কীভাবেই বা আমরা অধিকাংশ মানুষ দৈনন্দিন ব্যস্ত জীবনের চাপ সামাল দিই, কর্মজগতের চাপ ও বাড়ির মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে চলতে পারি? এগুলো সবই করা সম্ভব হয় আমাদের চরিত্রের নানাবিধ উপাদানের মিশ্রণে গড়ে ওঠা মানসিক স্থিতিস্থাপকতার সাহায্যে, যা আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে সব প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে সাহায্য করে।
কিন্তু কখনও যদি আমাদের সেই মানসিক স্থিতিস্থাপকতা দুর্বল হয়ে পড়ে? দৈনন্দিন জীবনে নিজেকে একজন অফিসের কর্মী বলে মনে করলে, অর্থাৎ যার উপর অত্যধিক কাজের বোঝা রয়েছে, সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়, কাজের খুব চাপ রয়েছে এবং কীভাবে সে তার উচ্চতর কর্তৃপক্ষের প্রত্যাশা পূরণ করবে প্রভৃতি বিষয় যদি মাথায় রাখা হয় তাহলে সেইসব ঘটনার অবশ্যম্ভাবী ফল হবে ওই কর্মী একটা বড় কোনও ভুল-ভ্রান্তি করে বসবে। তারপর প্রশ্ন উঠবে যে কীভাবে সে সেই ভুলের মোকাবিলা করতে সক্ষম হবে?
এছাড়াও মানসিক স্থিতিস্থাপকতা নষ্ট হওয়ার পিছনে থাকে গুরুতর মানসিক আতঙ্ক, প্রিয়জনের মৃত্যুর ঘটনা, উগ্রপন্থীদের আক্রমণ বা অন্যান্য অনভিপ্রেত ঘটনা। এসব ঘটনা ঘটার পর একজন মানুষের মানসিক ও অনুভুতিগত স্থিতিশীলতা বজায় থাকা রীতিমতো চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। এক্ষেত্রে গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে একজন মানুষের মধ্যে নানাভাবে মানসিক স্থিতিস্থাপকতা নিজে থেকেই বর্তমান থাকে। এটা নির্ভর করে মানুষের জীবনের পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি কীভাবে তাকে সাহায্য করছে, তার সর্বাঙ্গীণ শরীর-স্বাস্থ্য এবং দুর্ঘটনার পর একজন মানুষ কতটা নমনীয়ভাবে তার মোকাবিলা করতে সক্ষম হচ্ছে তার উপর। একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের মানসিক স্থিতিস্থাপকতা বজায় রয়েছে কিনা তা নির্ভর করে সে কোন ঘটনার মোকাবিলা কীভাবে করছে, তার উপর। তাই শুধুমাত্র ভয় পেয়ে, অসহায়তা দেখিয়ে, মতামত দিয়ে এবং আত্ম-সমালোচনা করে মানসিক চাপের বিরুদ্ধে উপযুক্ত জবাব দেওয়া যায় না।
তাহলে কীভাবে আমরা ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করতে শিখব? এর উত্তরে প্রথমেই আমি বলব সচেতনভাবে, মন দিয়ে পরিস্থিতি বিচার বিবেচনা করে আমরা এক্ষেত্রে এগোতে পারি। অর্থাৎ আমাদের মধ্যে আত্ম-সচেতনতার দক্ষতা বাড়ানো জরুরি। এছাড়া প্রয়োজন নিজেদের ভাবনাচিন্তাগুলোর প্রতি মনোযোগ দেওয়া, নিজের দৈহিক বোধ ও উত্তেজনাগুলোকে নিরপেক্ষভাবে বিশ্লেষণ করা। আর এভাবেই কোন চিন্তাভাবনা এবং বোধগুলো আমাদের অস্বস্তি এবং বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে তা লক্ষ ও পর্যবেক্ষণ করার ক্ষমতা আমাদের মধ্যে বৃদ্ধি পায়। এরপরে আসতে পারে দুঃখের বা বিপর্যয়ের ঘটনাকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ফিরে দেখার ক্ষমতা। এমন হতেই পারে তার নেতিবাচক প্রভাব থাকতে পারে। কিন্তু সেই ঘটনার মোকাবিলা করার দক্ষতা থাকাও একজন মানুষের ক্ষেত্রে অত্যাবশ্যক। এর ফলে জটিল অনুভূতি এবং অভিজ্ঞতাগুলো মন থেকে সরে গিয়ে আমাদের মধ্যে সম্পূর্ণভাবে কাজের নমনীয়তা গড়ে ওঠে। আর সেই সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্যজনিত সমস্যার আশানুরূপ সমাধান খুঁজে পাওয়া সম্ভবপর হয়।
একজন অফিসের কর্মীর পক্ষে আশানুরূপ ফলাফল পাওয়ার জন্য শেখা উচিত কীভাবে তার কাজের ক্ষেত্রে ভুল হচ্ছে তা ধরতে শেখা এবং এক্ষেত্রে নিজের ভূমিকাটাও বোঝা দরকার। তাহলে তাদের এই শেখাটা ভবিষ্যতের ভুল-ভ্রান্তির উপর প্রয়োগ করে তা শুধরে নেওয়ার ক্ষেত্রে সাহায্যদায়ক হবে। মানসিক আতঙ্কের ক্ষেত্রে মানুষের অর্ন্তনিহিত শক্তিগুলোকে জাগিয়ে তোলা দরকার আর আতঙ্কজনিত ঘটনার মোকাবিলা করার জন্য পারিপার্শ্বিক মানুষের সক্রিয় সহযোগিতা, যেমন- পরিবারের সদস্য, বন্ধুদের সাহায্য একান্ত জরুরি। এছাড়াও যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পেশাদারি হস্তক্ষেপ যেমন- থেরাপি, জটিল অনুভূতিগুলোকে চাপা দেওয়ার জন্য প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা এবং শরীরের অবস্থা অনুযায়ী বিশ্রাম নেওয়া, স্বাস্থ্যকর অভ্যাসের অনুশীলন প্রভৃতি জরুরি। অতি তৎপরতার সঙ্গে নিখুঁত সমাধানের জন্য উদ্যোগী হওয়া সবসময়ে ভালো ফল দেয় না।
এছাড়া কোনও আতঙ্কের ঘটনা ঘটার পর বা গভীর মানসিক চাপের শিকার হওয়ার পরে আমরা নিজেদের দক্ষতা, যোগ্যতা, আত্মপ্রত্যয় এবং বিচার-বিবেচনা নিয়ে নানারকম প্রশ্ন করতে শুরু করি। আমাদের কাছের মানুষজন আমাদের সম্পর্কে কী ভাবছে তা নিয়ে আমরা সংবেদনশীল হয়ে যাই। সেই সঙ্গে সঠিক তথ্য জানার আগেই আমরা নিজেদের মনে একটা সন্দেহের বাতাবরণ গড়ে তুলি, সমালোচনা করি এবং কঠোর মনোভাব পোষণ করি। এসবের ফলে আমাদের অনুভূতিগুলো আরও জটিল হয়ে ওঠে এবং তা আমাদের মনে গেঁথে যায়। অন্যদিকে, বিভিন্ন অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ নিয়ন্ত্রণ করার সক্ষমতা থেকেই আমাদের মধ্যে মানসিক স্থিতিস্থাপকতা-নির্ভর লড়াই করার শক্তি তৈরি হয়। এক্ষেত্রে শত ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও সমস্যা সমাধানের জন্য অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তোলা একান্ত প্রয়োজন। কারণ দুঃসময় কাটিয়ে আমাদের মধ্যে আশার আলো জ্বালানোর জন্য পারিপার্শ্বিক বন্ধুবান্ধব, থেরাপিস্ট বা অন্যান্য সহযোগী ব্যবস্থাগুলোর ভূমিকা অনস্বীকার্য। এসব সাহায্যের ফলেই আমরা প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে সক্রিয় ও অর্থবহ মোকাবিলা করার ক্ষমতা অর্জন করতে সক্ষম হই।
যদি এই প্রবন্ধ থেকে কোনও একটি ধারণা গ্রহণ করতে হয় তাহলে বোঝা যাবে যে মানসিক স্থিতিস্থাপকতা মানুষের একপ্রকার অর্জিত দক্ষতা ও যোগ্যতা, যা কারও মধ্যে থাকতেও পারে আবার না-ও থাকতে পারে। মানসিক স্থিতিস্থাপকতার মাত্রা বাড়ানোর জন্য আমাদের উচিত অন্যান্য মানুষের সঙ্গে মিলে নিজেদের সৃষ্টিশীল কাজে যুক্ত করা। জীবনে মানসিক চাপ বা বিপর্যয় ঘটার পরে তা মোকাবিলা করার জন্য নিজে থেকে সক্রিয় পদক্ষেপ নেওয়াও একান্ত প্রয়োজন। এক্ষেত্রে প্রতিকূল পরিস্থিতি এড়িয়ে যাওয়া বা বিপর্যয় মোকাবিলার ক্ষেত্রে পিছু হঠা একেবারেই বাঞ্ছনীয় নয়।
প্রবন্ধটি লিখেছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাসভিল্লির ভ্যান্ডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি ডিগ্রিধারী ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট দিব্যা খান্না। বিগত কয়েকবছর ধরে তিনি বিভিন্ন হিংসার শিকার হওয়া পূর্ণবয়স্ক মানুষের সাহায্যার্থে কাজ করছেন। সম্প্রতি তিনি ব্যাঙ্গালোরে একজন ক্লিনিশিয়ান হিসেবে অনুশীলন শুরু করেছেন।