শোক কি শুধুই এক নেতিবাচক আবেগ?
মেগান ডিভাইন তাঁর ইট’স ওকে দ্যাট ইউ আর নট ওকে বইটিতে শোকের প্রতি আমাদের সম্পূর্ণ নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি লিখেছেন, “শোককে এক ব্যতিক্রমি, স্বাভাবিক আনন্দময় জীবনের বহির্ভূত আবেগ হিসেবে ধরা হয়। ডাক্তারি পরিভাষায় একে এক ধরনের বিকার হিসেবেই দেখা হয়। আমরা বিশ্বাস করি যে শোক হল জটিল পরিস্থিতিতে এক সাময়িক প্রতিক্রিয়া, যা কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই কেটে যাবে।”
শোক কী? কোনও কিছু চিরতরে হারালে আমরা যে আবেগ অনুভব করি — কোনও প্রিয় ব্যক্তি বা কোনও প্রিয় বস্তু, যার অভাব কোনও ভাবেই পূরণ করা যায় না, তাকেই বলে শোক। এই জন্যেই মানুষ প্রেমে বিচ্ছেদের পরে, প্রিয়জনকে হারিয়ে, নিজের পোষা প্রাণীটি মারা গেলে অথবা কোনও দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হলে, শোকস্তব্ধ হয়ে পড়ে। কারণ তাঁদের মনের মাঝে আঁকা জীবনের সুন্দর ছবিটা তখন ভেঙ্গে যায়।
আমাদের মধ্যে শোককে চেপে বা দমিয়ে রাখার একটা প্রবণতা রয়েছে। অনেকেই মনে করেন নিজের আদরের পোষ্যটি মারা গেলে অথবা কোনও ঘনিষ্ট বন্ধু দূরে সরে গেলে, শোকাকুল হয়ে পড়ার কোনও মানেই হয় না। কিন্তু আপনাকে সবার আগে সেই শোকস্তব্ধ ব্যক্তির মানসিক পরিস্থিতি ও হারিয়ে যাওয়া ব্যক্তি বা বস্তুর সাথে তাঁর সম্পর্কটা বুঝতে হবে। ব্যক্তির অনুভব করা শোকের গভীরতা এই সম্পর্কই নির্ধারণ করে।
শোকের আঁচ পাওয়া এবং প্রতিক্রিয়া করার সময় আমাদের মস্তিষ্কে কী ঘটে?
একটানা শোক আমাদের মস্তিষ্ক ও দেহের উপরে প্রভাব ফেলে। শোকাচ্ছন্ন একজন ব্যক্তির শরীরে নিম্নলিখিত সমস্যাগুলি ফুটে উঠতে পারে:
মনঃসংযোগের অভাব, কুয়াশাচ্ছন্ন মস্তিষ্ক
বাস্তবের সঙ্গে বিচ্ছেদ
মাথাব্যাথা
খিটখিটে ভাব
সময়ানুবর্তিতার অভাব
সামাজিক বিচ্ছিন্নতা
পরিবার/বন্ধুদের থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া
অনিয়মিত খাদ্যাভ্যাস — অত্যধিক খাবার খাওয়া বা না খাওয়া
কিন্তু এরকম কেন হয়? বিভিন্ন গবেষণা থেকে জানা গিয়েছে যে, একজন শোকাচ্ছন্ন ব্যক্তির মস্তিষ্কে নিউরনগুলো বদলে যায়।এর ফলে শুধু মস্তিষ্কেই না, আমাদের বাকি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গেও নানা রকমের পরিবর্তন দেখা দেয়। উদাহরণস্বরূপ, মানসিক কষ্টের দরুণ আমাদের হজমের সমস্যা বা হৃদপিণ্ডের গোলযোগ দেখা দিতে পারে।
শোকের বিভিন্ন পর্যায় কী কী?
মনস্তত্ত্ববিদ এলিজাবেথ কুবলার রস তাঁর ডেথ অ্যান্ড ডাইং বইটিতে শোক এবং তাঁর বিভিন্ন পর্যায় নিয়ে আলোচনা করেছেন:
অস্বীকার: শোকাকুল ব্যক্তির পক্ষে নিজের পরিস্থিতি মেনে নিতে না পারা এবং নিজেকে ক্রমাগত বোঝানো, “আমি ঠিক আছি, আমার কিছু হয়নি।”
রাগ: শোকাকুল অবস্থায় ব্যক্তির নিজের উপরে বা নিজের আশেপাশে থাকা লোকজনদের উপরে রেগে যাওয়া। এই ক্ষেত্রে তাঁর আশেপাশে থাকা লোকজনদেরকে সেই ব্যক্তির রাগের অন্তর্নিহিত কারণ বোঝা উচিত, যাতে তাঁরা সেই ব্যক্তির মানসিক পরিস্থিতি আরও ভাল ভাবে বুঝতে পারেন।
দর কষাকষি: অনেক সময় আমরা দেখি যে কোনও দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত ব্যক্তি ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করছেন যে, “আমার মেয়ের বিয়ে হয়ে যাওয়া অবধি যেন আমি বেঁচে থাকি ঠাকুর!” এই ক্ষেত্রে তিনি যে ধর্মে বিশ্বাস করেন, সেই ঈশ্বরের কাছে নিজের জীবন-মরণ নিয়ে দর কষাকষি করছেন! প্রেমে বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে হয়ত এই দর কষাকষির বয়ান হবে, “আমরা কি পুরানো অতীত ভুলে শুধু বন্ধু হতে পারি না?”
অবসাদ: এই পর্যায় ব্যক্তি প্রকৃত অর্থে নিজের ক্ষতির মাত্রা উপলব্ধি করতে শুরু করেন। এই সময়ে তাঁরা পরিবার পরিজনদের এড়িয়ে চলতে পারেন বা সব সময় বিষণ্ণ থাকতে পারেন। তাঁদের হয়তো সব সময় কান্না পায় বা দিনের অনেকটা সময় কান্নাকাটি করে কাটাতে পারেন। এই রকম পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক ভাবেই লোকজন তাঁকে কাঁদতে বারণ করবেন এবং হাসিখুশি থাকতে বলবেন। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে যেহেতু এই সময়টাতে সেই ব্যক্তি তাঁর শোককে উপলব্ধি করছেন, সেহেতু তাঁকে তাঁর মতন করে সময় দেওয়া উচিত এবং কোনও বাধা ছাড়াই তাঁদের আবেগের জোয়ারে ভাসতে দেওয়া উচিত।
স্বীকার: এই পর্যায়ে, ব্যক্তি তাঁদের হারানোর যন্ত্রণাকে স্বীকার করে বা মেনে নিয়ে সেই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা বা তার মোকাবিলা করার রাস্তা খুঁজতে থাকেন। উদাহরণস্বরূপ, তিনি হয়ত আর্থিক বিপর্যয়ে হারিয়ে যাওয়া টাকা পুনরুদ্ধার করার উপায় খুঁজবেন বা প্রেমে বিচ্ছেদের পড়ে একাকী জীবনে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করবেন।
সাধারণ ভাবে শোককে এই ক’টি পর্যায়ে ভাগ করা গেলেও, সবাই সব পর্যায় বা পর পর সবকটির মুখোমুখি নাও হতে পারেন।
ব্যাঙ্গালোর শহরে অবস্থিত মনোবিজ্ঞানী ডা: পূর্বা রানাডে বলছেন, “প্রত্যেকের শোকের অভিজ্ঞতা একে অপরের থেকে আলাদা — কাজেই পুঁথিগত নিয়ম অনুযায়ী সবাই একই পর্যায়গুলি অনুভব করবেন না। এর অনেকটাই নির্ভর করবে সেই ব্যক্তির সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশের উপরে, এবং শোকের মোকাবিলা করার জন্যে তাঁদের মানসিক স্থিতিস্থাপকতার উপরে।”
শোকাকুল ব্যক্তির সাথে কথা বলা
অনেক সময়, আমরা বুঝতে পারি না যে একজন শোকাকুল ব্যক্তির সাথে কীভাবে কথা বলব। আমরা ভয় পাই যে হয়ত কথা বলতে গিয়ে তাঁদের পুরানো জখম আবার তাজা করে দেব এবং তিনি আমাদের দূরে সরিয়ে দেবেন। কিন্তু অপর দিকে এরকম অনেকেই রয়েছেন যারা তাঁদেরকে শোকাকুল অবস্থা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করেন এবং এক রকম জোর করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনেন। বিশেষজ্ঞদের মতে এই দু’টিই ভুল রাস্তা। তার চেয়ে শোকাচ্ছন্ন ব্যক্তির সাথে আমরা নিম্নলিখিত উপায়গুলিতে কথা বলতে পারি —
সহানুভূতি ও তার প্রতিফলন: “সব ঠিক আছে” বা “তোমাকে ঘুরে দাঁড়াতে হবেই” না বলে আপনি বলবেন, “আমি বুঝতে পারছি যে তোমার মন মেজাজ ঠিক নেই কারণ তুমি খুবই কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছ।”
উদার মানসিকতার সাথে উপদেশ বা পরামর্শ দিন: “আমার মনে হয় তোমার উচিত...” না বলে আপনি বলতে পারেন, “তুমি কি এমনটা করে দেখবে একবার?”
তাঁদের পাশে থাকুন: যদি আপনি দেখেন যে সে ব্যক্তি কথা বলতে ইচ্ছুক নন, তাহলে আপনি বলতে পারেন, “তুমি কখনও কোনও কথা বলতে চাইলে আমাকে পাশে পাবে।”
সাহায্য নেওয়া
কোনও কারণে অনেক দিন ধরে মনের মধ্যে জমিয়ে রাখা কষ্ট আর অবসাদের লক্ষণ এক রকমের হলেও তাদের মধ্যে এক সূক্ষ্ম তফাৎ রয়েছে। আমেরিকান সাইকায়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশন বলছে যে স্বাভাবিক নিয়মে শোকে তলিয়ে যাওয়ার সময়টা তীব্র অবসাদের মতন হলেও, শোক এবং অবসাদ একে অপরের চেয়ে অনেক আলাদা।
শোক |
অবসাদ |
ঘন ঘন মনের মধ্যে কষ্ট দলা পাকিয়ে ওঠে আর মনের মধ্যে হারানোর (সাধারণত কোনও প্রিয়জন) যন্ত্রণা চেপে বসে |
ক্রমাগত নেতিবাচক আবেগ এবং চিন্তা |
আত্মসম্মান বোধ বজায় থাকে |
নিজেকে ঘৃণা করা এবং ক্রমাগত নিজেকে অপদার্থ বলে মনে করা |
অনেকটা সময় অতিবাহিত হয়ে যাওয়ার পরেও, কোনও ব্যক্তি যদি শোকের অনুভূতি ছাড়াও, তার দৈনন্দিন জীবনে স্বাভাবিক ছন্দে কাজ করতে না পারেন বা আত্মহত্যার কথা চিন্তাভাবনা করেন (তাদের প্রিয়জনের কাছে চলে যাওয়ার জন্য), তাহলে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের চিকিৎসার প্রয়োজন হতে পারে।
সূত্র
– ফাইভ স্টেজেস অফ গ্রিফ, http://sde.ok.gov/sde/sites/ok.gov.sde/files/Five%20Stages%20of%20Grief.pdf
– কুবলার-রস মডেল, https://hdsa.org/wp-content/uploads/2015/02/13080.pdf
এই রচনাটি ব্যাঙ্গালোরে অবস্থিত মনোবৈজ্ঞানিক ডা: পূর্বা রানাডের সাথে আলোচনা করে লেখা হয়েছে।