মানসিক স্বাস্থ্য: ভুল ধারণা এবং বাস্তব
ভুল ধারণাঃ মানসিক স্বাস্থ্য বলে কিছুই নেই। ওটা আসলে অভিনয়।
বাস্তবঃ মানসিক স্বাস্থ্য সুস্থ জীবন যাপনের অংশ। আপনার শরীরের অন্যান্য অংশ যেমন অসুস্থতার সন্মুখীন হতে পারে, ঠিক তেমনই আপনার মস্তিষ্ক মানসিক অসুস্থতার কারণে প্রভাবিত হতে পারে। যার ফলে স্বাভাবিক জীবন যাপন করা আপনার পক্ষে দুরহ হয়ে উঠতে পারে।
মানসিক অসুস্থতার বহু উদাহরণ পাওয়া যায়। বিভিন্ন মানুষের বিভিন্ন ধরনের মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্যা দেখা যায়। এই সমস্যাগুলির নিবারণ হয় না বলেই মানুষ দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় ছন্দ হারিয়ে ফেলে। আমাদের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যাকে বাস্তব হিসেবে গ্রহণ করা উচিত এবং এই সমস্যাটিকে পেশাদারি সহায়তা ও হস্তক্ষেপের মাধ্যমে সুরাহা করা প্রয়োজন।
ভুল ধারনাঃ আর্থিকভাবে সচ্ছল মানুষেরা বলে থাকেন, "তাঁদের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা নেই, এই সমস্যাগুলি শুধুমাত্র অভাবে থাকা মানুষদেরই হয়ে থাকে।"
বাস্তবঃ প্রতি ৫ জন মানুষের মধ্যে একজন মানুষ মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছেন এবং এর প্রভাব অন্যদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। সাধারণ মানসিক ব্যাধি যে কোনও বয়সের মানুষের মধ্যেই দেখা দেয়। এই ব্যাধির সঠিক সময়ে চিকিৎসা না হলে খুবই দ্রুত গতিতে বাড়তে থাকে। আমাদের এই ব্যাধির ব্যাপারে সতর্ক থাকাটা খুবই জরুরি এবং এই সমস্যা দূর করতে যা যা প্রয়োজন সেই সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণা অর্জন করাটাও আবশ্যক।
ভুল ধারনাঃ মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্যার কোনও চিকিৎসা নেই।
বাস্তবঃ- মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্যায় জর্জরিত যে কোনও মানসিক রোগী সময়মত চিকিৎসা করালেই সুস্থ হয়ে উঠতে পারেন। সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে এই সমস্যা কাটিয়ে তোলা কখনই কঠিন নয়। যারা দীর্ঘদিন ধরে মানসিক রোগে আক্রান্ত তাদেরও চিকিৎসার মাধ্যমে জীবনের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনা সম্ভব।
ভুল ধারনাঃ দুর্বল মানুষরাই মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় পড়েন।
বাস্তবঃ মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা দুর্বল বা শক্তিশালী মানুষের উপর নির্ভর করে না। মানসিক ভাবে শক্তিশালী মানুষেরাও এই সমস্যায় পড়তে পারেন। সাধারণত দেখা যায় যে জেনেটিক, সাইকোলজিক্যাল ও সামাজিক কারণেই মানুষ এই ধরনের সমস্যায় আক্রান্ত হয়ে থাকেন।
ভুল ধারণাঃ মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দিলে, মানসিক রোগী উগ্র হয়ে ওঠে, অন্যদের আঘাত করে।
বাস্তবঃ মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় আক্রান্ত মানুষ যে সবসময় উগ্র হয়ে থাকে বা ওঠে এমন কোনও কথা নেই। সুস্থ মানুষ যেমন হঠাৎ কোনও কারণে রেগে যান ঠিক তেমনই কোনো কারণে হঠাৎ মানসিক ভাবে অসুস্থ রোগীও রেগে ওঠেন। মানসিক রোগীরা অন্যদের আঘাত করে না বরং দেখা যায় সুস্থ মানুষেরাই এদের বহু আঘাত দিয়ে থাকেন অকারণে।
ভুল ধারনাঃ মানসিক রোগীদের যতশীঘ্র সম্ভব হাসপাতাল বা অ্যাসাইল্যামে পাঠানো উচিত।
বাস্তবঃ মানসিক রুগী বা মানসিক ভাবে অসুস্থ মানুষদের হাসপাতালে পাঠানোর প্রয়োজন নেই। বিশেষ কোনও ক্ষেত্রে চিকিৎসার প্রয়োজনে হাসপাতালে পাঠাতে হয়। অ্যাসাইল্যামে পাঠানোরও প্রয়োজন নেই বললেই চলে। দেখা গিয়েছে বাড়িতে রেখে চিকিৎসা করালে এবং যত্ন সহকারে রাখলে বাড়ির পরিবেশে থেকে রোগীরা দ্রুত সেরে ওঠেন।
ভুল ধারনাঃ মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা হলে চাকরি করা যায় না।
বাস্তবঃ মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা থাকলেও চিকিৎসার পাশাপাশি চাকরি করে সাধারণ জীবন যাপন করা সম্ভব। মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা থাকলেও নিজের পছন্দমতো চাকরি করলে মানসিক বিষাদ দ্রুত কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।
ভুল ধারনাঃ মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা জন্মায় ভূত-প্রেতের কারণে। কোনও অশরীরী আত্মার প্রবেশ ঘটে মানুষের শরীরে, যার ফলে মানুষ নিজের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে।
বাস্তবঃ এই ধারণা বহুকাল ধরেই বহু মানুষ নিজের মনে পুষে রেখেছেন অথচ এর কোনো ভিত্তি নেই। মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার সঙ্গে কোনো অশরীরী বা অলৌকিক ঘটনার যোগাযোগ নেই। এই ভ্রান্ত ধারণা সঠিক শিক্ষার অভাব, এবং অন্ধ কুসংস্কারে আবদ্ধ সমাজেই জন্ম নেয়। এই ধারণার কারণেই মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় আক্রান্ত মানুষের চিকিৎসায় দেরি হয়, যার ফলে রোগীর সুস্থ জীবনে ফিরে আসার পথে বিঘ্ন ঘটে।
ভুল ধারনাঃ মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দিলেই সাইকিয়াত্রিস্ট-এর প্রয়োজন জরুরি।
বাস্তবেঃ সাইকিয়াত্রিস্ট নিঃসন্দেহে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার নিবারণে সিদ্ধহস্ত। কিন্তু সবসময়ই যে সাইকিয়াত্রিস্ট-এর কাছে যেতে হবে এমন কোনও মানে নেই। মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা বহু ধরনের হয় এবং অধিকাংশ সময়েই বহু সমস্যার নিবারণ করে দেন ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট, কাউনসেলার ও থেরাপিস্ট। মনে রাখতে হবে যে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা শুরু হলে প্রথমেই যাওয়া উচিত ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট, কাউনসেলার বা থেরাপিস্ট চিকিৎসকের কাছে।
ভুল ধারনাঃ মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় আক্রান্ত মানুষদের জন্য আমাদের করার কিছুই থাকে না।
বাস্তবঃ আমরা মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় আক্রান্ত মানুষদের জন্য অনেক কিছুই করতে পারি। প্রথমত আমরা রোগীর রোগ উপশমে তাঁকে যত্ন সহকারে রেখে সুস্থ করে তুলতে উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে পারি। রোগীর মনে বিশ্বাস ভরিয়ে তাঁকে আত্মবিশ্বাসী ও ভয়মুক্ত জীবন যাপনের পথ অনায়াসে সুগম করতে পারি। পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে রোগীকে দ্রুত সারিয়ে তুলে আবার জীবনের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনাটা খুবই সহজ এবং আনন্দদায়ক।