সঙ্গীতের আরোগ্য ক্ষমতা

সঙ্গীতের আরোগ্য ক্ষমতা

মানসিক অসুখ সারিয়ে তোলার পিছনে সঙ্গীত চিকিৎসার ব্যবহার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে
Published on

প্রাচীন কাল থেকেই পৃথিবীর বিভিন্ন সংস্কৃতিতেই সুর ও সঙ্গীত আমাদের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে রয়েছে। শিশুর জন্মগ্রহন থেকে, বিবাহ উপলক্ষে, উৎসবে, ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় বা যে কোনও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেই মানুষ গান বাজনার আয়োজন করে থাকে। সাস্থের ক্ষেত্রেও সঙ্গীত মানুষের শুশ্রূষা করার জন্য ব্যাবহার করা হয়।

সঙ্গীত চিকিৎসা কি?

সঙ্গীত চিকিৎসার মাধ্যমে মানুষের মানসিক চাহিদা পূরণ করা হয়। একজন সঙ্গীত চিকিৎসক রোগীর সাইকোলজিকাল এবং সামাজিক চাহিদা অনুযায়ী সঙ্গীতের মাধ্যমে তাঁর চিকিৎসা করেন। এই জন্য গান গাওয়া, বাদ্যযন্ত্র বাজানো, সঙ্গীত শোনানো বা সঙ্গীত রচনা ইত্যাদি অবলম্বন করা যেতে পারে। সঙ্গীত চিকিৎসার মাধ্যমে একজন রোগীকে তাঁর চিকিৎসা চালিয়ে যেতে অনুপ্রেরিত করা যায়। তাঁদের মোটর স্কিল উন্নত করে (বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে) এবং তাঁদের যোগাযোগ ব্যাবস্থার একটি নতুন পথ দেখানো সম্ভব হয় – বিশেষ করে তাঁদের ক্ষেত্রে যারা নিজেদের অনুভূতির কথাগুলি বলতে পারেন না। ধরা যাক, একজন মানসিক বা শারীরিক আঘাত পাওয়া ব্যক্তি তাঁর খারাপ অভিজ্ঞতার কারণে তাঁর অনুভূতির কথাগুলি কোনও ভাবে ব্যক্ত করতে পারছেন না। সঙ্গীত চিকিৎসা তাঁর এই সমস্যার প্রাচীরটি ভেঙে তাঁর অন্তরদন্ধ বা চেপে রাখা অনুভুতিগুলি বার করে আনা যেতে পারে। 

অন্য রকমের বিনোদনের মত হালকা সঙ্গীত শোনা বা সম্পাদন করার ফলে, মস্তিষ্কে একটি প্রভাব পড়ে যা আমাদের জ্ঞান, অনুভূতি বা শারীরিক কর্মক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে।

সঙ্গীত শিক্ষা ও সঙ্গীত চিকিৎসার পার্থক্য কি?

এই দুই ক্ষেত্রেই সঙ্গীত রচনা করতে হয়, কিন্তু দু’টির কাজ আলাদা।

সঙ্গীত চিকিৎসা

সঙ্গীত শিক্ষা

একজন সঙ্গীত চিকিৎসক একজন মানসিক বা শারীরিক সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তিকে নিয়ে কাজ করেন (যার শেখার অক্ষমতা, মানসিক স্বাস্থ্যজনিত সমস্যা বা বেড়ে ওঠা সংক্রান্ত, ইত্যাদি সমস্যা রয়েছে)।

একজন সঙ্গীত শিক্ষক তথাকথিত উপায়ে একজন স্বাভাবিক ব্যক্তিকে সঙ্গীত শেখান।

 

রোগীকে তাঁর পছন্দ ও ক্ষমতা অনুযায়ী, তাঁকে ভাল লাগানোর জন্য গান শেখানো হয়। তাঁকে এই বিষয়ে শ্রেষ্ঠ করে তোলার জন্য নয়।

যে সঙ্গীত শেখে, তাকে একদম সেই সঙ্গীতের মূল থেকে শেখানো হয়, যাতে সে সেই বিষয়ে সময়ের সাথে অনেক দক্ষতা অর্জন করতে পারে।

চিকিৎসক তাঁর রোগীর সঙ্গে একটি সুস্থ ও বিশ্বাসযোগ্য সম্পর্ক তৈরি করার চেষ্টা করেন যাতে এই চিকিৎসা রোগীকে সুস্থ করে তুলতে সাহায্য করে।

সাধারণত একজন শিক্ষক এবং তাঁর ছাত্রের মধ্যে একটি সম্মানের সম্পর্ক তৈরি হয় এবং ছাত্রটি চেষ্টা করে সেই সঙ্গীতে একটি সম্মানজনক মর্যাদা লাভ করার।

সঙ্গীত চিকিৎসার মাধ্যমে একজন ব্যক্তির জ্ঞ্যান, যোগাযোগ মাধ্যম, মোটর, পড়াশুনা, অনুভুতি, সৃজনশীলতায় উন্নতি হতে পারে। এর ফলে তাঁরা নানা রকম পরিস্থিতি সামলাতে পারে এবং নিজেদের জীবনকে গুছিয়ে তুলতে পারে।

এক্ষেত্রেও সঙ্গীত একজনের জ্ঞ্যান, মনঃসংযোগ, সৃজনশীলতা, সামাজিক দক্ষতা বাড়াতে পারে। কিন্তু এগুলি শুধু তাঁদের সঙ্গীত রচনা করতেই সাহায্য করে।

মানসিক রোগের জন্য সঙ্গীত চিকিৎসা

মানসিক রোগের ক্ষেত্রে, আরও নানা রকম চিকিৎসার পাশাপাশি সঙ্গীত চিকিৎসা ব্যাবহার করা হয়। এর মাধ্যমে বিশেষ কিছু সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করা হয়, যা শুধু মাত্র ওষুধ দিয়ে করা যায় না। একজন অভিজ্ঞ সঙ্গীত চিকিৎসক রোগীর পছন্দ অনুযায়ী তাঁর জন্য সঙ্গীত বেছে নেন, যাতে তা দিয়ে তাঁকে সারিয়ে তোলা যেতে পারে।

অটিজম, এডিএইচডি, ডাউন’স্‌ সিণ্ড্রোম, স্কিৎজোফ্রেনিয়া, দুশ্চিন্তা, হাতাশা, অ্যালঝাইমারস্‌, ইত্যাদি নানা রকম রোগের ক্ষেত্রে সঙ্গীত চিকিৎসা কার্যকরী হতে পারে। রোগীর পরিবারের সদস্যরাও নিজেদের মানসিক জটিলতার জন্যে সঙ্গীত চিকিৎসার সহায়তা নিতে পারেন।

আপনি কি জানেন? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রচুর সঙ্গীতশিল্পী আমেরিকার বিভিন্ন হাসপাতালে গিয়ে, সেখানে ভর্তি হওয়া আহত রোগীদের সঙ্গীত পরিবেশনা করে শোনাতেন। এর ফলে রোগীদের সাস্থে বেশ উন্নতি দেখা যায়, এবং ডাক্তাররা সঙ্গীতশিল্পীদের হাসপাতালে স্থায়ী সদস্য হিসাবে রাখতে শুরু করেন।

সঙ্গীত চিকিৎসার বিভিন্ন ধরণ

একজন রোগীর সঙ্গীতের গ্রহণ ক্ষমতা ও বোঝার ক্ষমতা অনুযায়ী তাঁর চিকিৎসক নিম্নলিখিত তালিকাগুলির মধ্যে থেকে যে কোনও ধরণের সঙ্গীত ব্যবহার করতে পারেন।

আবহ সঙ্গীত চিকিৎসা: শান্ত একটি পরিবেশ তৈরি করার জন্য অনেক সময় হাসপাতালে রেডিওতে বা অডিয়ো টেপে হালকা কোনও সঙ্গীত বাজানো হয়। এই সঙ্গীত একজন রোগীকে দুশ্চিন্তা ও চাপ মুক্ত করে, তাঁকে সাবলীল হতে সাহায্য করে, বিশেষ করে যাদের শারীরিক অবস্থা আশঙ্কাজনক।

চিন্তাশীল সঙ্গীত চিকিৎসা: এর সাহায্যে ব্যক্তিটিকে সঙ্গীতের গুরুত্ব ও সৌন্দর্য বোঝাতে সাহায্য করা হয়। সঙ্গিতটি শুরু করার আগে, ব্যাক্তিটিকে সেই সঙ্গীতশিল্পীর জীবনী বা অন্য তথ্য দিয়ে দেওয়া হয়। এই চিকিৎসার মাধ্যমে রোগীর রাগ ও দুঃখ কমানোর চেষ্টা করা হয়।

দলগত সঙ্গীত চিকিৎসাঃ একজন চিকিৎসক একটি দলকে গান বা একটি বাদ্যযন্ত্র শেখানোর চেষ্টা করেন। এটি সাধারণত হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের জন্য ব্যাবহার করা হয়। এর মাধ্যমে একজন ব্যক্তির আত্মমর্যাদা বাড়াতে সাহায্য করা হয়।  

শিল্পীদের দ্বারা সঙ্গীত পরিবেশনাঃ এই ক্ষেত্রে একজন শিল্পী হাসপাতালে সঙ্গীত পরিবেশন করেন। এটি বাচ্চাদের ক্ষেত্রে, অটিজম রোগীদের ক্ষেত্রে এবং অনুভূতিগত সমস্যায় আক্রান্ত একটি ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে ব্যাবহার করা হয়।

সৃজনশীল সঙ্গীত চিকিৎসাঃ এক একজন ব্যক্তিকে গান লেখানো, সুর তৈরি করা বা বাদ্যযন্ত্র বাজাতে দেওয়া হয়, যাতে তাঁদের একটু চাপমুক্ত করা যেতে পারে। সঙ্গীতের মধ্যে দিয়ে তাঁদের ক্ষোভ, ভয়, হতাশা ইত্যাদি বেরিয়ে আসে।

সঙ্গীত চিকিৎসার উপাদানঃ

সঙ্গীত চিকিৎসার নানা রকম উপাদান রয়েছে, যার প্রত্যেকটি নিজের মত করে উপকারী। একজন চিকিৎসক রোগীর জন্য তাঁর প্রয়োজন অনুযায়ী উপাদানগুলি বেছে নেন, যা তাকে সারিয়ে তুলতে সাহায্য করে।

গান লেখা: একটি গান লিখে একজন মানুষ নিজের চিন্তাভাবনা অনুভূতিগুলিকে ব্যাক্ত করতে পারেন। একজন সঙ্গীত চিকিৎসক ছন্দ ও তাল মিলিয়ে তাঁদের গানের কথা লিখতে সাহায্য করেন। উদাহরণ হিসাবে দেখতে গেলে একটি বিশেষ কোনও গানের কথাগুলি বদলে তাঁদের নিজেদের অনুভূতিগুলি লেখা হয় এবং একটি ছোট কবিতা তৈরি করা হয়।

গানের কথা বিশ্লেষণ করা: একজন চিকিৎসক তাঁর রোগীদের একটি পছন্দসই গানের বিভিন্ন কথা বা অংশ বিশ্লেষণ করতে শেখান। এর ফলে সেই রোগী তাঁর মনের কথাগুলি তাঁর চিকিৎসককে বলতে পারেন। যদি একটি গানের কথা রোগীর জীবনের কাহিনীর সাথে মেলে, তা হলে তাঁদের মনের কথা বুঝতে সুবিধা হয়।

গান শোনা: একজন ব্যক্তি গান শুনে তাঁর প্রতিক্রিয়া জানান। বিভিন্ন মাধ্যম যেমন বিনোদন, ধ্যান, হাঁটাচলা, ছবি আঁকা, ও ইত্যাদি দিয়ে তাঁরা নিজেদের প্রতিক্রিয়া ব্যাক্ত করেন। 

বাদ্যযন্ত্র বাজানো: যে ব্যক্তি নিজের কথার মাধ্যমে নিজের অনুভূতিগুলিকে প্রকাশ করতে পারেন না, তিনি তাঁর কোনও একটি পছন্দমত বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে তাঁর চিন্তা ও অনুভূতিগুলি মেলে ধরেন। এর মাধ্যমে তাঁরা তাঁদের মোটর স্কিল গড়ে ওঠে কারণ এর জন্য হাত ও চোখের একটি ভাল সমন্বয়ের প্রয়োজন হয়। (বিশেষ করে অটিজম, এডিএইচডি আক্রান্ত বাচ্চাদের ক্ষেত্রে) বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে নিজের এবং অন্যদের সঙ্গে  একটি সুন্দর সম্পর্ক তৈরি হয়। এর ফলে স্মৃতিশক্তি, সামাজিক দক্ষতা, আত্মসম্মান ও সৃজনশীলতা বৃদ্ধি পায়। 

সঙ্গীত তৈরি করা: চিকিৎসকের সঙ্গে নিজের মত করে সঙ্গীত তৈরি করা হয়, যা নিজেকে মেলে ধরার একটি উপায়। একজন ব্যক্তি নিজের ক্ষমতা অনুযায়ী বিভিন্ন শব্দ, বা গলার স্বর, বা কিছু বাজিয়ে, বা ছবি ও গল্পের মাধ্যমে সঙ্গীত সৃষ্টি করেন। এর ফলে সঙ্গীতের মাধ্যমে তিনি তাঁর চেপে থাকা অনুভূতিগুলিকে প্রকাশ করেন। এর পর চিকিৎসক তাঁর অনুভূতিগত সমস্যাগুলির সমাধান বার করার চেষ্টা করেন।

গানের সুর, তাল, ছন্দের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে একটি ইতিবাচক প্রভাব পড়ে যা তাঁদের অসুস্থতা ও দৈনন্দিন জীবনের নানা পরিস্থিতি সামলাতে সাহায্য করে।

এই প্রচ্ছদটি ব্যাঙ্গালোরের মীরা সেন্টার ফর মিউজিক থেরাপির প্রতিষ্ঠাতা ডাঃ মীনাক্ষী রবি’র সাহায্য নিয়ে তৈরি করা হয়েছে।

logo
হোয়াইট সোয়ান ফাউন্ডেশন
bengali.whiteswanfoundation.org