একজন মনোরোগীর সামাজিক দক্ষতার প্রশিক্ষণ
সমাজবদ্ধ মানুষ হিসেবে আমরা একে অপরের সঙ্গে কথা বলি। একে অপরের কাছ থেকে শেখার চেষ্টা করি এবং আমরা একে অপরের উপর নির্ভরশীল। সামাজিক দক্ষতা বা কৌশল হল আমাদের আচার-আচরণের এমন একটা উপাদান, যা আমাদের শিখতে, বুঝতে এবং নানা সামাজিক পরিস্থিতিকে মানিয়ে চলতে সাহায্য করে। নিউইয়র্কের দ্য অ্যালব্যার্ট এলিস ইনস্টিটিউটের মতে সামাজিক দক্ষতা হল এমন এক ধরনের কৌশল,যার সাহায্যে মানুষ সামাজিক ভাবনাচিন্তার আদান-প্রদান, সামাজিক পরিচিতি এবং একে অন্যের সঙ্গে মনের ভাব দেওয়া-নেওয়া করতে পারে। এর সাহায্যে বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলির সঙ্গে যোগাযোগও রক্ষা যায়।
মোটের উপর, সামাজিক কৌশল বা দক্ষতা মানুষের মধ্যে শেখার ক্ষমতা বাড়ায়। এবং এর সাহায্যেই বৃহত্তর ক্ষেত্রে মানুষে-মানুষে সম্পর্ক গড়ে ওঠে ও মানুষ গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে বাঁচতে পারে।
মানসিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তির ক্ষেত্রে সামাজিক দক্ষতার গুরুত্ব
একজন মানসিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তির মধ্যে সামাজিক দক্ষতার অভাব থাকলে সে তার চিন্তাভাবনা, অনুভূতি বা মনের ভাব যথাযথভাবে প্রকাশ করতে পারে না। এই ধরনের সমস্যা কিছু মনোরুগির ক্ষেত্রে (সবার ক্ষেত্রে নয়) তার অসুখের অঙ্গ হিসেবেই দেখা দিতে পারে বা অসুস্থতার প্রাথমিক পর্বে তাদের সামাজিক কৌশল বা দক্ষতা শেখার ক্ষেত্রে অথবা ব্যবহার করার ক্ষেত্রে অনেক বাধানিষেধ থাকতে পারে। অনেকসময় মানসিক অসুস্থতার লক্ষণগুলো, যেমন- উদ্বিগ্নতা সামাজিক কৌশল বা দক্ষতা শেখার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। বহু গবেষণায় মনোরুগির সামাজিক দক্ষতার সঙ্গে কগনিটিভ সমস্যার, যেমন- মনোযোগের অভাব, অসংলগ্ন কথাবার্তা, শেখার ক্ষেত্রে সমস্যা প্রভৃতির পারস্পরিক সম্পর্ক দেখানো হয়েছে। সামাজিক দক্ষতার প্রশিক্ষণের উপর গুরুত্ব দিয়ে নিমহ্যান্সের সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডঃ পূর্ণিমা ভোলা বলেছেন, ''সামাজিক কৌশল বা দক্ষতা রুগির অসুখ সারানোর প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় এবং এই কৌশল রপ্ত করার প্রশিক্ষণ একজন মানসিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তিকে জীবনে বাঁচতে শেখায় ও তাকে গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে সহায়তা করে। একজন মনোরুগির রোগ নির্ধারণের ক্ষেত্রে তার সামাজিক দক্ষতার অভাবকে চিহ্নিত করা চিকিৎসা পদ্ধতির অপরিহার্য অঙ্গ হিসেবে ধরা হয়।''
সামাজিক দক্ষতা অর্জনের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে একজন মানসিকভাবে অসুস্থ মানুষ তার জীবনে কাজ করতে সক্ষম হয়।
সামাজিক দক্ষতাগুলির মধ্যে রয়েছে:
ভার্বাল বা মৌখিক - কথা বলার ধরন, গঠন, বিষয়বস্তু এবং কথা বলার পরিমাণ
অঙ্গ সঞ্চালনগত - চোখের চাউনি, মুখমণ্ডলের ভাবপ্রকাশ, চালচলন এবং ব্যক্তিগত দূরত্ব বজায় রাখা
কথা বলার ধরনের তারতাম্য - স্বর, কথা বলার গতি, স্বরের তীক্ষ্ণতা এবং তার গভীরতা
সামাজিক বোধ বা উপলব্ধি - সমাজ সম্পর্কে যথাযথ তথ্য পরিবেশন করে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাকে জাগিয়ে তোলা
মতপ্রকাশ করা বা দৃঢ়তা প্রকাশ করা
কথপোকথন সম্পর্কিত দক্ষতা - কথাবার্তা শুরু করা ও তা চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার কৌশল
সহানুভূতি, সহমর্মিতা, দুঃখপ্রকাশ করা এবং সমাজের চাহিদা মতো মনের ভাব প্রকাশ করার ক্ষমতা
অন্যান্য কৌশলগুলির মধ্যে রয়েছে কারোর অসুস্থতার বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখা
একজন মানসিকভাবে অসুস্থ লোকের নিজস্ব বা তার পরিবারের প্রয়োজন বা চাহিদার উপর ভিত্তি করে তার সামাজিক দক্ষতা আয়ত্তের ব্যবস্থা করা হয়। এক্ষেত্রে কয়েকটি বৈশিষ্ট্যমূলক সামাজিক দক্ষতার উপর জোর দেওয়া হয়। যেমন- কাউকে শুভেচ্ছা জানানো বা অনুরোধ করা। আবার কয়েকটি নির্দিষ্ট সামাজিক কৌশলও রয়েছে, যা মূলত কাজের সঙ্গে যুক্ত। যেমন- জোরালোভাবে মতপ্রকাশ করার ক্ষমতা, পারস্পরিক বোঝাবুঝির দক্ষতা, নিজেকে ফিটফাট করে রাখার শিক্ষা, অফিসের কর্তৃপক্ষ ও সহকর্মীদের সঙ্গে আলাপচারিতা করা। এই প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা সহজ থেকে কঠিন পর্যায়ে ধাপে ধাপে বাড়ে।
ব্যক্তিগত এবং দলগত প্রশিক্ষণ
সামাজিক দক্ষতার প্রশিক্ষণ ব্যক্তিগত বা দলগত- দু'ভাবেই হয়ে থাকে। ভারতের মতো দেশে, যেখানে একজন রুগির সংস্কৃতি ও ভাষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়, সেখানে ব্যক্তিগতভাবে প্রশিক্ষণের প্রবণতাই বেশি থাকে। কিন্তু যে পুনর্বাসন ব্যবস্থায় বেশীরভাগ মানুষ সমভাষী বা দক্ষতার অভাবের পরিমাণ যেখানে মোটামুটি সমান সেখানে দলগত প্রশিক্ষণই হয়। এইধরনের প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে একজন উদ্যোক্তা থাকেন। আর ইনিই প্রশিক্ষণের নেতৃত্ব দেন ও দলের সব সদস্যদের প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণের জন্য উৎসাহ যোগান।
পরিবারের ভূমিকা
ভারতের মতো দেশে সামাজিকতার ক্ষেত্রে পরিবারের গুরুত্ব অপরিসীম। একজন মানুষের সামাজিক দক্ষতার অভাব প্রথম চিহ্নিত করে পরিবারের লোকজন। প্রশিক্ষণের প্রক্রিয়া চলাকালীন সময়ে পরিবারের সদস্য বা পরিচর্যাকারীরা থেরাপির খুঁটিনাটি কাজে সাহায্য করতে পারে। পরিবারই সুনিশ্চিত করতে পারে একজন অসুস্থ মানুষকে একটা নিরাপদ পরিবেশের সন্ধান দিতে যেখানে সেই মানুষটি তার শেখা সামাজিক কৌশল প্রয়োগ করতে পারে।
বাস্তব জগতে সামাজিক দক্ষতা বা কৌশলের প্রশিক্ষণ
সামাজিক দক্ষতার প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে মানুষে-মানুষে পার্থক্য দেখা যায়। তাই একজন ব্যক্তি বিশেষের উপরই এই প্রশিক্ষণের গঠন বা ধরন-ধারণ নির্ভর করে–
-
কাজের মাত্রা
-
দক্ষতা বা কৌশলের অভাবজনিত সমস্যা
-
চাহিদা বা প্রয়োজনীয়তা
-
অসুস্থতার আগে একজন মানুষের ব্যক্তিত্বের ধরন-ধারণ
এসবের পর সামাজিক দক্ষতার প্রশিক্ষণের প্রভাব পড়ে একজন মানুষের সর্বাঙ্গীন জীবন, তার সংস্কৃতি, লিঙ্গ এবং মৌলিক ব্যক্তিত্বের উপর। যখন এই প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় তখন খেয়াল রাখা অবশ্যই উচিত যে তাতে একজন রুগি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে কিনা।
সামাজিক দক্ষতার অভাবগুলি চিহ্নিতকরণের পর কতগুলি সহজ দায়িত্ব পালন করতে হয়। একজন অসুস্থ মানুষকে সামাজিক আচার-ব্যবহারে শিক্ষিত করে তোলার ক্ষেত্রে তার সামনে কোনও আদর্শ মানুষের জীবনচর্চার উদাহরণ তুলে ধরা এবং তা থেকে সাড়া পাওয়াটা খুবই জরুরি বিষয়। ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে এই কৌশল নানাভাবে ফলপ্রসূ হয়। প্রশিক্ষণ এবং বাস্তবে তার প্রয়োগের ক্ষেত্রে ব্যবধান কমাতে একজন মানুষের দরকার যথাযথ সুযোগ, উৎসাহ এবং দক্ষতার সঠিক অনুশীলন।
এই প্রবন্ধটি লেখা হয়েছে নিমহ্যান্সের ক্লিনিকাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডঃ পূর্ণিমা ভোলার সক্রিয় সহযোগিতার উপর নির্ভর করে।