বিভিন্ন ধরণের চিকিৎসা

বিভিন্ন ধরণের চিকিৎসা

একজন চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে গেলে আপনার কোনও “গুরুতর” সমস্যা না থাকলেও চলবে
Published on

সাইকোথেরাপি কি?

সাইকোথেরাপি একটি বিজ্ঞ্যানসম্মত চিকিৎসা পদ্ধতি যা দিয়ে একজন মানুষের চিন্তাভাবনা, অনুভূতি নিয়ন্ত্রণ করা যায় এবং তাঁকে কিছু স্বাস্থ্যকর অভ্যাস শেখানো যায়। এর মধ্যে দিয়ে একজন চিকিৎসক একটি ব্যক্তির চার পাশে একটি সহজাত পরিবেশ তৈরি করেন, যাতে সেই ব্যক্তি নির্দ্বিধায় তাঁকে তাঁর মনের কথা, সমস্যার কথা বলতে পারেন। এই চিকিৎসা একজন মানুষের মনের অস্বাস্থ্যকর চিন্তাগুলি দূরে সরিয়ে তাঁকে নতুন কৌশল শিখিয়ে বিভিন্ন পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে শেখায়। কার্যকর সংযোগ ব্যবস্থা তৈরি করা, সমস্যা সমাধান করতে পারা, সিদ্ধান্ত নিতে শেখা, নতুন কৌশল শেখা, এবং নানা রকম বিনোদনের পথ ধরে সাইকোথেরাপি মানুষকে তাঁদের সমস্যাগুলি সামলাতে শেখায়।

সাইকোথেরাপির জন্য একজন ব্যক্তি অনেক কিছু শিখতে পারেনঃ

  • বর্তমান ও অতীতের সম্পর্কগুলির সঙ্গে সমস্যার মিটমাট করতে পারা

  • জীবনের বিভিন্ন পরিস্থিতি ও কাজের কারণে যে দুশ্চিন্তা বা চাপ সৃষ্টি হয়, সেগুলিকে দূরে সরিয়ে রাখা

  • চাকরি চলে যাওয়া, প্রিয়জনের মৃত্যু ঘটা বা ডিভোর্সের মত বড় কিছু যদি জীবনে ঘটে, সেই পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া।

  • রাগ হওয়ার বা ক্ষুব্ধ হওয়ার মত বিভিন্ন অস্বাস্থ্যকর আচরণ যা ব্যক্তিগত জীবন বা সম্পর্কে প্রভাব ফেলে, সেগুলিকে কমানো

  • নিজের বা পরিবারের কোনও সদস্যের ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশন, ক্যান্সার বা এইডসের মত কোনও দুরারোগ্য ব্যাধি হলে, সেটির সাথে মানিয়ে নেওয়া.

  • খারাপ অভ্যাস ত্যাগ করে ভাল অভ্যাস তৈরি করা। উদাহরণ, হাইপারটেনশন, ডায়াবেটিস, মাদকাসক্তি থেকে মুক্তি পেতে গেলে মানুষকে তাঁর অনেক অভ্যাস বদলাতে হয়।

  • নেতিবাচক চিন্তাভাবনা করা, যৌন নির্যাতন, গৃহস্থ অত্যাচারের ভয় থেকে সামলে ওঠা

কিছু ক্ষেত্রে সাইকোথেরাপি ওষুধের মত কাজ করে। যদিও পরিস্থিতির অবস্থা বুঝেই চিকিৎসকরা ঠিক করেন একজন ব্যক্তির জন্য কোন জিনিসটি বেশি কার্যকর হবে।  অন্যান্য চিকিৎসার সঙ্গেও একজন ব্যক্তিকে সাইকোথেরাপি দেওয়া যেতে পারে।

সাইকোথেরাপিস্ট কে?

সাইকোথেরাপিস্ট হলেন একজন মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ যার সাইকোথেরাপি ও অন্যান্য সাইকোলজিকাল চিকিৎসা নিয়ে বিশেষ প্রশিক্ষণ নেওয়া আছে। এর সাথে তাঁদের মানসিক রোগ মূল্যায়ন, ও তার পরিচর্যা নিয়ে বিশেষ শিক্ষা জ্ঞ্যান থাকতে পারে।

সাইকোথেরাপির বিভিন্ন ধরণগুলি কি কি?
অনেক ধরণেরই চিকিৎসা রয়েছে, যা রোগের মাত্রা অনুযায়ী একজন মানুষকে বিশেষজ্ঞরা করতে পরামর্শ দিয়ে থাকেন। যেমন অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিসঅর্ডারের ক্ষেত্রে আচরণগত চিকিৎসা করার পরামর্শ দেওয়া হয়, হাতাশায় আক্রান্ত একটি মানুষকে জ্ঞ্যানীয় চিকিৎসা করতে বলা হয়। 

এখানে কিছু চিকিৎসার সম্পর্কে বর্ণনা দেওয়া রয়েছেঃ

আচরণগত চিকিৎসাঃ এই চিকিৎসার মাধ্যমে একজন ব্যক্তিকে নিজের চিন্তাভাবনা ও আচরণ বুঝতে সাহায্য করা হয়। নেতিবাচক চিন্তাভাবনা বদলে ইতিবাচক চিন্তাভাবনা করতে শেখানো হয়। এই চিকিৎসা পদ্ধতি দিয়ে একজন মানুষকে নিজের আচরণগুলিকে উন্নত করা এবং  বিভিন্ন পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে শেখানো হয়। উদাহরণ, একজন মানুষকে ধূমপান ছাড়ানোর জন্য তাঁর আচরণে পরিবর্তন নিয়ে আসা।  

জ্ঞ্যানীয় চিকিৎসাঃ এই চিকিৎসা পদ্ধতি মূলত মানুষের আবেগ ও চিন্তাকে ঘিরে তৈরি করা। এই চিকিৎসা দিয়ে মানুষকে পুনর্বাসন, পুরস্কার, শাস্তি, আচরন বদলের পরিকল্পনা, বিনোদন ও কৌশল তৈরি করার মাধ্যমে নানা নতুন জিনিস শেখানো হয়। এই চিকিৎসা দিয়ে মানুষের মনের কিছু ভুল ধারণা ও ইতিবাচক অনুভূতি যেমন রাগ, হতাশা, দুশ্চিন্তা প্রভৃতি সারিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়। উদাহরণ, হতাশাগ্রস্থ মানুষকে জ্ঞ্যানীয় চিকিৎসার মাধ্যমে সারিয়ে তুলতে সাহায্য করা হয়।  

ইন্তার-পার্সোনাল চিকিৎসা/ থেরাপি (আইপিটি) :  এই চিকিৎসা পদ্ধতির মাধ্যমে মানুষের আন্তঃব্যক্তিগত সম্পর্ক উন্নত করে তোলার চেষ্টা করা হয়। যেমন বৈবাহিক সমস্যা, অভিভাবক ও তাঁর সন্তানের সমস্যা ইত্যদি।

এটি একটি সময়সাপেক্ষ চিকিৎসা যার তিনটি পর্যায় রয়েছে – প্রাথমিক, মধ্যম এবং প্রান্তিক পর্যায়।

  • প্রাথমিক পর্যায়ে একজন চিকিৎসক রোগীর সাথে সাক্ষাৎকার করেন এবং নির্ণয় করেন তাঁকে কি ধরণের আইপিটি দিতে হবে। চিকিৎসক রোগীর সম্পর্কের ধরণ, মেলামেশা করার ক্ষমতা, এবং বর্তমানের সম্পর্কগুলির মূল্যায়ন করেন।

  • মধ্যম পর্যায়ে, চিকিৎসক আইপিটি’র বিভিন্ন পদ্ধতির মাধ্যমে রোগীর সমস্যাগুলির স্মাধান বার করার চেষ্টা করেন

  • প্রান্তিক পর্যায়ে, চিকিৎসক রোগীর সমস্যাগুলির মূল্যায়ন করে দেখেন সেগুলি কতটা সমাধান করা গিয়েছে এবং ভবিষ্যতের চিকিৎসা পরিকল্পনাগুলি নিয়ে ভাবেন।

প্রিয়জনের মৃত্যু ঘটা, স্বামী-স্ত্রী’র অশান্তি, পরিস্থিতির পরিবর্তনের জন্য মানুষের মধ্যে যে সমস্যাগুলি দেখা যায় সেগুলিও আইপিটি চিকিৎসার অন্তর্গত।

সাইকোডাইনামিক চিকিৎসাঃ এটিকে অন্তর্দৃষ্টি ভিত্তিক চিকিৎসাও বলা হয়ে থাকে। মানুষের অবচেতন মনে চিন্তাভাবনার কারণে তাঁদের মধ্যে যে আচরণগুলি দেখা যায়, সেই আচরণের উপরই নির্ভর করে এই সাইকোডাইনামিক চিকিৎসা। এই চিকিৎসা মানুষকে নিজেদের সম্পর্কে সচেতন করতে সাহায্য করে এবং তাঁদেরকে বোঝাতে চেষ্টা করে, কিভাবে পূর্বের কোনও ঘটনা তাঁদের বর্তমানের আচরণের উপর প্রভাব ফেলে। নিজেকে মূল্যায়ন করা শিখতে পারলে একজন ব্যক্তি বুঝতে পারবেন বর্তমানে তাঁর অদ্ভুত আচরণ করার পিছনে পূর্বের কোন অভিজ্ঞতা লুকিয়ে রয়েছে।  

বিঃ দ্রঃ এই চিকিৎসা সফল হয়েছে তাঁদের ক্ষেত্রে, যারা এই চিকিৎসা সম্পর্কে জেনে নিজের চিকিৎসককে সবরকম ভাবে সহযোগিতা করেছেন। ওসিডি বা স্কিৎজোফ্রেনিয়ার মত মারাত্মক কিছু মানসিক অসুস্থতার ক্ষেত্রে এই চিকিৎসা ফলপ্রদ হয় না। এটি আবেগজনিত, সম্পর্কজনিত কিছু সমস্যার ক্ষেত্রেই বেশি ফলপ্রদ হয়।  

পারিবারিক চিকিৎসাঃ পরিবারের সম্পর্কগুলি ঘিরে থাকা সমস্যার সামাধান করতে সাহায্য করে। যেমন ধরুন একজন স্ত্রী হতাশায় ভুগছেন তাঁর বৈবাহিক জীবনে সমস্যার কারণে। একজন চিকিৎসক সেই সম্পর্কটি বা সেই সম্পর্কের পুরনো কোন ঘটনা যা থেকে অশান্তির সৃষ্টি হয়েছে, তার মূল্যায়ন করে থাকেন। একজন চিকিৎসক পরিবারের মধ্যে সংযোগ ব্যাবস্থা ঠিক করার চেষ্টা করেন, একজন ব্যক্তির মধ্যে সহানুভূতি জাগিয়ে, তাঁদেরকে প্রশ্ন করা শিখিয়ে, এবং রাগ না করে কোনও বিষয়ে প্রতিক্রিয়া দেওয়া শিখিয়ে। যে পরিবারের সদস্যরা একজন ব্যক্তির চিকিৎসার দায়িত্ব নেন এবং যে পরিবারের সদস্যরা একজন ব্যক্তির মানসিক রোগের কারণ, উভয় ক্ষেত্রেই এই চিকিৎসা তাঁদের সহায়তা করতে পারে।   

দলগত চিকিৎসাঃ  ৬-১২ জন, যারা একই সমস্যায় ভুগছেন, তাঁদের একত্রিত করে দলগত ভাবে তাঁদের চিকিৎসা করা হয়। রোগের ধরণ অনুযায়ী একজন ব্যক্তিকে দলগত চিকিৎসা নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।
এটি অনেক ভাবে উপকারী। অংশগ্রহণকারীদের অন্যসকলের সঙ্গে মেলামেশা করার সুযোগ তৈরি করে দেওয়া হয়, যারা সকলেই তাঁদের মত সমস্যায় ভুগছেন। তাঁরা দলের এক অপরের কাছ থেকে মতামত আদান প্রদান করতে পারেন। এই চিকিৎসা মাদকাসক্তি ছাড়াতে সাহায্য করে, যেখানে এক জন অন্য আরেকজনকে নেশা ছাড়তে অনুপ্রেরিত করতে পারেন।

.চিকিৎসা সম্পর্কে সাধারণত যে প্রশ্নগুলি করা হয়

আমাকে কতদিন ধরে চিকিৎসা তে করাতে হবে?

সাইকোথেরাপি করতে কখনও কখনও অনেক দিন, বা সপ্তাহ বা মাস লেগে যেতে পারে। গুরুতর কোনও মানসিক সমস্যার ক্ষেত্রে কখনও কিছু বছরও লেগে যায়। এক একটি সাক্ষাৎকারের সংখ্যা কিছু জিনিসের উপর নির্ভর করেঃ 

  • মানসিক রোগের লক্ষণগুলির মাত্রা

  • লক্ষণগুলির সময়কাল এবং সমস্যাগুলির অস্তিত্ব থাকা

  • আপনার এই সমস্যাগুলি থেকে মুক্তি পাওয়ার স্বদিচ্ছা ও অনুপ্রেরণা

  • সাইকোথেরাপির একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারক হল আপনার পরিবারের সদস্যদের সমর্থন

  • চিকিৎসা ক্ষেত্রে আপনার নিজের নিয়ম নিষ্ঠা

আমার দেওয়া তথ্যগুলি কি গোপন রাখা হবে?

চিকিৎসকের সঙ্গে আপনার সমস্ত কথাবার্তা গোপন রাখা হবে। কিন্তু যদি চিকিৎসকের মনে হয় যে আপনার জন্য আপনার নিজের বা অন্য কারও মৃত্যু ঘটতে পারে, তাহলে তাঁরা আপনার পরিবারের সদস্যদেরকে বা একজন বিশেষজ্ঞকে সেই তথ্য প্রদান করতে পারেন।

কোনটি বেশি উপকারী, চিকিৎসা না ওষুধপত্র?

গবেষণা করে দেখা গিয়েছে যে চিকিৎসা ও ওষুধ দুটিই সমান ভাবে মানসিক রোগ সারাতে কার্যকরী। কিন্তু একজন বিশেষজ্ঞ রোগের মাত্রা ও ধরণ অনুযায়ী চিকিৎসা করার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। সাংঘাতিক হতাশা, স্কিৎজোফ্রেনিয়া, বাইপোলার ডিসঅর্ডার বা প্যানিক ডিসঅর্ডারের ক্ষেত্রে সাধারণত ওষুধপত্র দেওয়া হয়ে থাকে। ওষুধপত্রের মাধ্যমে রোগের লক্ষণগুলি সারিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়। আর চিকিৎসার মাধ্যমে মানুষকে জ্ঞ্যান প্রদান করা হয়, কি ভাবে লক্ষণগুলিকে তাঁরা সামলাতে পারবেন।  

logo
হোয়াইট সোয়ান ফাউন্ডেশন
bengali.whiteswanfoundation.org