আত্মনির্ভরশীল মানুষের বন্ধুত্ব ও প্রেম
ইতিবাচক মনস্তত্ত্বের আনুষ্ঠানিক প্রকাশ ১৯৯৮ সালে হলেও এর মূল ভিত্তি হল ডঃ আব্রাহাম মাসলো-র গবেষণাধর্মী কার্যকলাপ। আর এজন্যই ভারতে হিউম্যান মোটিভেশন-এর (মানুষের প্রেরণা) গুরু ও তার প্রাতিষ্ঠানিক সাফল্যের জন্য তিনি বিখ্যাত হয়ে আছেন। মাসলো-র সেরা-পরিচিত ধারণাগুলোর মধ্যে অন্যতম হল মানুষের আত্মনির্ভরশীলতা। তাঁর মতে প্রত্যেকটি মানুষের মধ্যে তাদের জন্মগত সম্ভাবনাগুলোকে দক্ষতার সঙ্গে পরিপূর্ণ করতে পারার ক্ষমতা রয়েছে এবং খুব কম শতাংশ মানুষই এই লক্ষ্যে সফল হয়। মাসলো-র সংজ্ঞা অনুযায়ী এমন কিছু পুরুষ ও মহিলা রয়েছেন যাঁরা তাঁদের মৌলিক চাহিদা যেমন- নিরাপত্তা, একাত্মতা, শ্রদ্ধা ও সম্মান নিয়েই তৃপ্ত থাকেন। সেই সঙ্গে প্রাথমিকভাবে কয়েকটি উচ্চতর চাহিদার দ্বারা অনুপ্রেরণা লাভ করতে চান যেমন- কতগুলি উৎকৃষ্ট মূল্যবোধ অর্থাৎ সৃষ্টিশীলতা, ন্যায়বিচার - এবং এগুলোর সাহায্যেই তারা একটি উন্নত পৃথিবী গড়ে তুলতে উদ্যোগী হন।
মাসলো-র মতে এইধরনের আত্মনির্ভরশীল মানুষের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হল তাদের মধ্যে মনুষ্যত্ব বোধের ''সঠিক বিকাশ ঘটানো, যাকে আদর্শ ও দিকনির্দেশক হিসেবে বিবেচনা করা যায়।'' এই কারণেই আমাদের সামাজিক জীবনের চারটি বিষয়ের প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি বা মানসিকতা ভালোভাবে জানা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে। সেই চারটি বিষয় হল- বন্ধুত্ব, প্রেম, বিয়ে এবং শিশুদের লালন-পালন। প্রথম ভাগে বন্ধুত্ব ও প্রেম এবং দ্বিতীয় ভাগে বিয়ে ও শিশুদের লালন-পালনের বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হল।
১) আত্মনির্ভরশীল মানুষের কি বন্ধু থাকে? এটি একটি হয়-সাদা-না-হয়-কালো গোছের প্রশ্ন। এর উত্তরটি খুব সূক্ষ্ম ও তিনটি দিকের বিবেচনার ফল হওয়া উচিত। প্রথমত, মানসিকভাবে সুস্থ মানুষের মধ্যে গড়ে ওঠা বন্ধুত্ব মাসলোর কাছে খুবই সুখকর এবং প্রশংসিত একটি বিষয়। উদাহরণস্বরূপ তিনি বিষয়টিকে নির্দিষ্টভাবে শনাক্ত করেছেন- ভালোবাসা হল ''সর্বোৎকৃষ্ট একটি বিষয়, অর্থাৎ এই ভালোবাসা একজনের সন্তানের প্রতিও থাকতে পারে বা প্রিয় বন্ধুর প্রতিও থাকতে পারে।'' তিনি আরও বলেছেন যে পরিবারের সদস্য এবং বন্ধুদের প্রতি ভালোবাসা এক ধরনের বিশেষ অধিকার যদিও এর ফলে নিজের ব্যথা-বেদনার পাশাপাশি অপরের ব্যথা-বেদনা ভাগ করে নিতে হয়। দ্বিতীয়ত, মাসলো প্রকৃত বন্ধুত্ব এবং নকল বন্ধুত্বের মধ্যে সত্যতা এবং নিজেকে উন্মোচন করার ভিত্তিতে পার্থক্য করেছেন। তৃতীয়ত, যদিও মাসলো দেখেছিলেন যে আত্মনির্ভরশীল মানুষজন নিবিড় বন্ধুত্ব উপভোগ করেন, এমন ব্যক্তিদের ভালো থাকার ক্ষেত্রে এর গুরুত্ব নগন্য কারণ তাদের মধ্যে একাত্ম বোধ ও শ্রদ্ধা-সম্মানের চাহিদা আগে থেকেই পূর্ণ থাকে। মানে এধরনের মানুষের কাছে বন্ধুত্ব কখনোই চাটুকারিতা হয়ে ওঠে না।
মাসলো সম্পর্কের বিশ্বাসযোগ্যতার ক্ষেত্রে সত্যতা ও নিজেকে প্রকাশ করা- এই দুইয়ের উপরেই সমান জোর দিয়েছেন। সত্যতার মধ্যে থাকে জীবনে পারস্পরিক দায়িত্ব-কর্তব্য গ্রহণের ক্ষমতা এবং সেই অনুযায়ী জীবনে অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ। অন্যদিকে আত্মপ্রকাশের মধ্য দিয়ে নিজের অনুভূতি এবং চিন্তাভাবনা সৎ ও মুক্ত ভাবে ব্যক্ত করা সম্ভব হয়ে উঠে। মাসলো এই দুই ধরনের গুণকেই সম্মান করেন। এছাড়া একজন আত্মনির্ভরশীল মানুষের বন্ধুত্বজনিত সম্পর্কের উষ্ণতা ও আন্তরিকতাকেও তিনি সমান গুরুত্ব দিয়েছেন।
২) আত্মনির্ভরশীল মানুষ কি প্রেমে পড়ে? কলেজে পড়ার সময়ে একজনের প্রেমে পড়ে তাকেই বিয়ে করা সত্ত্বেও আশ্চর্যের বিষয় যে মাসলোর এই বিষয়ের প্রতি অত্যন্ত গভীর এবং অনেকদিন ধরে আগ্রহ ছিল। মাসলোর মতে একজন আত্মনির্ভরশীল মানুষের মধ্যে অন্যের কাছ থেকে আনুগত্য পাওয়া, প্রশংসা পাওয়া বা অন্যের উপর আধিপত্য বিস্তারের মনোভাব থাকে না। তাই তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্কগুলো অনেক বেশি সমানুভূতিসম্পন্ন এবং যত্নশীল হয়। মাসলো আরও ভালোভাবে লক্ষ্য করেছেন যে মানসিকভাবে সুস্থ ব্যক্তিরা অনেক বেশি করে নিজেদের প্রকাশ করতে চায়। এছাড়া আত্মনির্ভরশীল হওয়ার কারণে এরা যেহেতু নিজেদের সম্মান ও শ্রদ্ধার চাহিদাগুলো নিয়ে সন্তুষ্ট থাকে তাই তারা তাদের ভালোবাসার মানুষের উপর সম্পূর্ণ মনোযোগ দিতে সক্ষম হন। সমসাময়িক পরিভাষায় বলা যায় যে এধরনের মানুষজন তাদের জীবনে প্রেম বা ভালোবাসার প্রতি অনেক বেশি সচেতন থাকেন।
১৯৬০ সালের একটি প্রাচ্য ভাবনার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মাসলো এই মনোভাবকে 'টাওইস্ট রিসিপটিভিটি' রূপে ব্যাখ্যা করেছিলেন, যার আদর্শ পরিস্থিতির মানদণ্ড হল প্রেমিক-প্রেমিকা একে অপরের চোখে চোখ রেখে বা মা তার সদ্যোজাত সন্তানকে কোলে নিয়ে যে অপার্থিব সুখ, আনন্দ উপভোগ করেন। মাসলোর মতে প্রেমের মনস্তত্ত্বিক দিকের কেন্দ্রে রয়েছে মানুষের বিশ্বাস যে তার ভালোবাসার মানুষটি শুধু সুন্দর ও অসাধারণই নয়, সেই সঙ্গে একেবারে নিখুঁতও। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে এইধরনের মনোভাবকে অবাস্তব বলে মনে হলেও, মাসলোর মতে প্রেমের বিকাশ ও সমৃদ্ধির জন্য এটি অত্যন্ত আবশ্যিক শর্ত।
প্রেমের উপর ইতিবাচক ভ্রম বা মায়ার ভূমিকার গুরুত্ব নিয়ে আধুনিক গবেষণায় কাজ হওয়ার অনেক আগেই মানুষের আদর্শ প্রেমিকের স্বরূপের উপর মাসলো জোর দিয়েছিলেন। একটি গবেষনায় দেখা গিয়েছে যে একজন সদ্যবিবাহিত দম্পতি, যারা একে অপরকে নিজেদের আদর্শ সঙ্গী মনে করে, তারা বিয়ের তিন বছর পরেও সতীর্থদের তুলনায় মনের আনন্দে দাম্পত্য সুখ উপভোগ করছে। অন্য আরেকটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে এমন দম্পতি, যারা সদ্য বিবাহিত রূপে নিজের সঙ্গীকে আদর্শ রূপে দেখেছিল, তাদের মধ্যে বিয়ের তেরো বছর পরেও পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা একটুও কমেনি বরং আরও বেড়েছে। সংক্ষিপ্ত করে বলা যায় যে বিবাহিত জীবনের আবেগ ও প্রেম বজায় রাখার ক্ষেত্রে নিজের সঙ্গীকে আদর্শ মনে করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।