কর্মক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্য: কর্মীদের সুস্থতার চিন্তা করা কি ঝামেলাদায়ক বিষয়?

কর্মক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্য: কর্মীদের সুস্থতার চিন্তা করা কি ঝামেলাদায়ক বিষয়?

''যখন আমি প্রথম কাজের জগতে পা রাখি তখন আমার সরাসরি কোনও তত্ত্বাবধায়ক বা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ছিল না। সেই দু'বছরে যখন আমি ঠিকঠাক কাজ করতে পারিনি তখনই একমাত্র তত্ত্বাবধায়করা আমার কাজের তত্ত্বাবধান করেছেন এবং কোম্পানির বয়স্ক অভিজ্ঞ সদস্যদের নিয়ে সংঘটিত দলগত মিটিং-এর মাধ্যমে সেই তত্ত্বাবধানের কাজ করা হত। আমি ঠিক কাজ করেছি নাকি ভুল করেছি সে সম্পর্কে কখনোই ভালোভাবে কিছু জানতে পারিনি। এজন্য আমার মনে হত যে আমি যেন ওই সংস্থার কর্মী নই এবং কোম্পানিতে আমার কোনও গুরুত্বই নেই।''

''আমার শেষ কর্মক্ষেত্রে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছনোর জন্য অনেক বেশি জোর দেওয়া হত। কিন্তু এই কাজ করার জন্য আমরা কীভাবে লাভবান হতে পারব সে সম্পর্কে তেমন কিছুই বোঝা যেত না। এর সঙ্গে যুক্ত হত নানারকম হুমকি। যেমন- 'কাজ কর নাহলে বড় বোনাস মিলবে না।' সেই পরিস্থিতিটা আমার কাছে খুব হতাশাজনক ছিল। কিন্তু আমি এখন উপলব্ধি করি যে, আমি কত নির্বোধ ছিলাম।  আমি কখনও দেখতে পাইনি যে কর্মক্ষেত্রে কঠিন চ্যালেঞ্জ থাকে সেখানে পারস্পরিক বোধগম্যতা বা সাহায্যের পদক্ষেপ করা হয় না।''

''আমার মনে পড়ে যখন আমি একটা খবরের কাগজে ব্যুরোর দায়িত্ব সামলাতাম তখন আমি একেবারে অন্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলাম। আমার দলের সদস্যরা, যারা মূলত হেড কোয়ার্টার নিউ দিল্লির অফিসে বসত, তারা একেধারে ছিল অত্যন্ত চলমান, অল্পবয়সি এবং উৎসাহী কর্মী। তাদের সঙ্গে আমার যোগাযোগ ছিল খুব কম বা একেবারে ছিল না বললেই চলে। সাপ্তাহিক মিটিং-এ আমার উপস্থিতি, তাও আবার ভিডিও-কনফারেন্স-এর মাধ্যমে হত, সেখানে তাদের সঙ্গে আমার আলোচনা হত। আরও পরিষ্কার করে বললে বলতে হয় যে আমি আমার পরিকল্পনাগুলো তাদের বিবেচনার জন্য পাঠাতাম। দলের সদস্যদের সঙ্গে আমার এতটাই যোগাযোগের অভাব ছিল যে দলে আমার অবস্থান নিয়ে আমার মনে নানা প্রশ্ন উঁকি দিত।''

(উপরের তিনটি ঘটনাই কর্মক্ষেত্র বিষয়ক বাস্তব ছবি। অনুরোধের জন্য তিনটি  ক্ষেত্রেই ব্যক্তির নাম উল্লেখ করা হয়নি)

আমাদের কর্মক্ষেত্রে ঘটা বিভিন্ন ঘটনার মধ্যে এই তিনটি উদাহরণ তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে এবং কীভাবে কর্মক্ষেত্রজনিত মানসিক চাপ আমাদের অনুভূতিগত সুস্থতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায় ও উৎপাদনশীলতাকে ব্যাহত করে তা  বোঝানো হয়েছে। কিন্তু এখন প্রশ্ন হল- কীভাবে কর্মীদের সুস্থতার উপর জোর দিয়ে একটা সংস্থা লাভবান হয়ে উঠতে পারে?

এক্ষেত্রে কয়েকটি সমীক্ষার মাধ্যমে বিষয়টি আলোচনা করা যেতে পারে। ২০১৫ সালের একটা সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে যে ভারতে প্রতি দশটা বেসরকারি সংস্থার মধ্যে চারটে সংস্থার কর্মীরা মানসিক অবসাদ এবং উদ্বেগের সমস্যায় ভোগে। আরেকটা সমীক্ষা থেকে জানা গিয়েছে যেসব কর্মীরা কাজের জায়গায় খুব কামাই করে বা প্রায়শই অনুপস্থিত থাকে তাদের ৩৫-৪৫ শতাংশই মানসিক স্বাস্থ্যজনিত সমস্যার শিকার হয়। ২০১৬-তে ভারতে অবস্থিত সোসাইটি ফর হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট দ্বারা করা আরও একটা সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে কর্মীদের চাপের মোকাবিলা করতে গিয়ে যে কোনও জায়গার সংস্থাকে বছরে দশ থেকে একশো কোটি টাকার বোঝা বহন করতে হয়।

টাকার অংক দেখেই এই সমস্যার গুরুত্ব সম্পর্কে একটা ধারণা করা যায় এবং বেসরকারি ক্ষেত্রেই এই পরিস্থিতির ভয়াবহতা লক্ষ করা যায়। অর্থনৈতিক ক্ষতি ছাড়া এই সমস্যার আরও অনেক পরোক্ষ প্রভাব রয়েছে, যেমন- কর্মীদের মধ্যে যোগাযোগের অভাব আর এজন্যই তাদের পারস্পরিক সম্পর্কের অবনতি দেখা যায়, কর্মক্ষেত্রে কর্মীদের দক্ষতার অভাব সর্বাঙ্গীনভাবে কোম্পানির শক্তিজনিত সম্ভাব্যতা নষ্ট করে দেয় প্রভৃতি।

ইদানীং বহু কোম্পানি তাদের কর্মচারিদের মানসিক সুস্থাতার জন্য এম্পলয়ি অ্যাসিসট্যান্স প্রোগ্রামের (ইএপি) ব্যবস্থা করছে। যদিও সব সংস্থা এখনও এই ব্যবস্থা অবলম্বন করেনি। অনেক জায়গায় মানবসম্পদ বিকাশ বিভাগ কর্মক্ষেত্রের মানসিক চাপ প্রতিরোধ করার জন্য কঠোর নীতি চালু করার পদক্ষেপ করেছে।

মানবসম্পদ বিভাগের কয়েকজন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে আমরা কর্মীদের সুস্থতা সংক্রান্ত সহায়তার বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছিলাম। একটা সংস্থার এইচআর ম্যানেজার মণিকা কামাথ জানিয়েছেন যে, এবিষয়ে প্রতিষ্ঠানের উপর থেকে নীচের তলা পর্যন্ত আলোচনা করা জরুরি। কথপোকথন শুরু করতে হবে একদম উপরের স্তরে এবং এভাবেই সমস্যার গভীরে প্রবেশ করা সম্ভব। কোম্পানির সমস্ত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও কর্মীদের মধ্যে সাহায্যের ক্ষেত্রে পূর্ব-নির্ধারিত কলঙ্কের বোধ কাজ করে। একজন ইএপি পরিষেবা দানকারী এবং ওয়ান টু ওয়ান হেল্প-এর ক্লিনিক্যাল ডিরেক্টর ইলেন  শিন্দে বলেছেন, '' দৈহিক স্বাস্থ্যের জন্য এই সমস্যা স্বাভাবিক হওয়া প্রয়োজন।''

মানবসম্পদ বিকাশ বিভাগের সুপারিশ অনুযায়ী নিম্নলিখিত উপায়ে কর্মীদের মানসিক সুস্থতা বজায় থাকা সম্ভব-

  • মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যাগুলো সম্পর্কে সংস্থার কর্মীদের শিক্ষিত করা বা ওয়াকিবহাল করে তোলা জরুরি। এর ফলে তারা নিজেদের বা অন্যদের সাহায্যের প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি চিহ্নিত করতে সক্ষম হবে।

  • কর্মক্ষেত্রে সুস্থতা সংক্রান্ত প্রোগ্রামগুলো সম্পর্কে কর্মীদের নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন।

  • সংস্থায় এমন একদল মানুষের সংগঠন গড়ে তোলা দরকার যারা কর্মক্ষেত্রের চাপ এবং তার মোকাবিলা নিয়ে স্বাস্থ্যকর আলাপ-আলোচনা করবে

  • নির্ধারিত সময়ের বাইরে কাজ না করা এবং জীবনযাপনে ভারসাম্য আনা প্রভৃতি।

কর্মক্ষেত্রে চাপ সমগ্র কাজের পরিবেশে প্রভাব ফেলে। তাই শুধু নিয়ম-নীতির কার্যকরী প্রয়োগই যথেষ্ঠ নয়। সেই সঙ্গে চাই সুস্থতা সম্পর্কে সংস্থার কর্মীদের  সক্রিয় মনোভাব। যদি এটা করা যায় তাহলে কোম্পানির ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হবে।

প্রবন্ধটি লেখার জন্য মণিপাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বুধাদিত্য সুজিরের সাহায্য নেওয়া হয়েছে।           

logo
হোয়াইট সোয়ান ফাউন্ডেশন
bengali.whiteswanfoundation.org